জাতি হিসেবে আমরা দুর্ভাগা বটে। এ কারণে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে চলছে নানা ষড়যন্ত্র। মূলত স্বাধীনতা বিরোধীরাই এ ষড়যন্ত্রের খলনায়ক। তারা মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখের বদলে ৩ লাখ বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে। অথচ মুক্তিযুুদ্ধের সময়েই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে নিহতের সংখ্যা লাখ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়।২০০৫ সালের ২৩ জুন প্রকাশিত এশিয়া টাইমস’র নিবন্ধে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়ার কথা প্রথম বলেছেন তখনকার পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ইয়াহিয়া খান। তাহলে এখন কারা নতুন তথ্য হাজির করছে? তাদের উদ্দেশ্য কী? এর পেছনে কারা আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা জরুরি। মোটাদাগে বলা যায়, এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীরা। এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কেবল মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখা, দেখানো। তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে চাচ্ছে ১৯৭১ সালে তেমন কিছু ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। হয়েছে ভাইয়ে ভাইয়ে গন্ডগোল! এর মধ্যদিয়ে তারা মূলত পাকবাহিনীর অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এটা যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের একটা অংশ, তা হয়তো আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না। কারণ পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালের পরাজয়ের গ্লানি এখনো ভোলেনি।পাকহানাদার বাহিনীর গণহত্যা, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, আমাদের মা-বোনকে ধর্ষণ-হত্যার খবর যখন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছিল, তখন তাদের দোসররা উল্লাস করছিল। লুটপাটে ব্যস্ত সময় পার করছিল তারা। এদেশের অনেক সংবাদ মাধ্যমকে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে সংবাদ পরিবেশন করতে বাধ্য করছিল। এমনভাবে সংবাদ প্রকাশ করা হতো যে পাকিস্তানি বাহিনী বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। আর কয়দিন পরই তারা বিজয়ের ঘোষণা দেবেন। সর্বহারা মানুষের গগণবিদারী আহাজারি তারা উপভোগ করছিল। তারা এদেশের মানুষ নয়, মাটি চেয়েছিল। সেই শকুনের দল ফের মানচিত্রে থাবা বসাতে উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের মানুষ সেটা হতে দেব না। স্বাধীনতা রক্ষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রয়োজনে আমরা আবারও যুদ্ধে যাব।৩০ লাখ শহীদের প্রাণ, এক সাগর রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এটা কারো দয়া নয়, আমাদের অর্জন। এ দেশের দামাল ছেলেরা বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল দেশ-মাতৃকাকে স্বাধীন করতে। জীবনটা তাদের কাছে তুচ্ছ ছিল মাতৃভূমি রক্ষার জন্য। সহযোদ্ধাকে হারিয়েও দমে যাননি আরেক যোদ্ধা। তিনি পূর্ণ উদ্যমে এগিয়ে গেছেন। শত্রুর বুকে গুলি চালিয়েছেন, ছুঁড়েছেন গ্রেনেড। কিন্তু এ দেশীয় পাকবাহিনীর দোসরদের মতো ভারতও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে! মুক্তিযুুদ্ধে তাদের অবদান অনস্বীকার্য বটে। তারা আমাদের এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল। এই যুুদ্ধে তাদের ১ হাজার ৬০০ সেনা শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। তারা কূটনীতিকভাবেও আমাদের সহায়তা করেছিলেন- এ কথা সত্য। ভারতকে আমরা বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবেই জানি। কিন্তু ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এ কী বললেন?‘অপারেশন সিঁদুরে’ নৌবাহিনী সক্রিয় হলেই পাকিস্তানকে চার টুকরো করে দেওয়া যেত বলে তিনি হুংকার দিয়েছেন। ভারতের প্রথম দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্ত পরিদর্শনে গিয়ে নৌবাহিনীর শক্তি নিয়ে এমনই হুঙ্কার দেন তিনি। সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে তিনি যা বললেন, তা আমাদের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। তার ভাষ্য, ১৯৭১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর পরাক্রমে দুই টুকরো হয়েছিল পাকিস্তান। এবারও ভারতের নৌবাহিনী সরাসরি সংঘাতে নামলে পাকিস্তান আরও টুকরো টুকরো হত। শুক্রবার আরব সাগরে মোতায়েন আইএনএস বিক্রান্তে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও সেনাদের সঙ্গে দেখা করেছেন রাজনাথ।যুদ্ধজাহাজে দাঁড়িয়েই রাজনাথ বলেন, ‘১৯৭১ সাল সাক্ষী, ভারতীয় নৌবাহিনী যখন অভিযানে নামল, তখন পাকিস্তান দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। অপারেশন সিঁদুরেও যদি ভারতের নৌবাহিনী সংঘাতে নামত, তাহলে এবার পাকিস্তান আর দু’টুকরো নয়, চার টুকরো হয়ে যেত।’ মি. সিং আপনার এই বক্তব্য আষাঢ়ে গর্জন ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনার এই বক্তব্যে আপনার নৌবাহিনীর সদস্যরা তাৎক্ষণিক মনোবল পেয়েছে বটে; কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে মুচকি হাসে, তা কি আপনি বোঝেন? বুঝলে অবশ্য এমন বক্তব্য দিতেন না। কেন কথাগুলো বলছি, তা স্পষ্ট করছি। পাকিস্তানে আপনারা আক্রমণ করলেন। পাকিস্তানও পাল্টা আক্রমণ করলো। আপনাদের অত্যাধুনিক রাফাল যুদ্ধ বিমান ভূপাতিত করলো চীন-পাকিস্তানের তৈরি যুদ্ধ বিমান। এটা নিয়ে আপনারা চুপ হয়ে গেলেন।বারবার সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলেন। কেন? তার মানে সামথিং রং। এই যুদ্ধ আপনারা বিজয়ী দাবি করছেন। পাকিস্তানও বিজয়ী দাবি করছে। তাহলে হারলো কে? নৈতিকভাবে আপনারাই হেরেছেন। কেননা, আপনাদের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এতো শক্তিশালী বলে দাবি করেন; অথচ কাশ্মিরের মতো একটা জায়গায় জঙ্গি হামলা হলো; ২৬ পর্যটকের প্রাণ গেল আর আপনারা জানতে পারলেন না? বিষয়টি হাস্যকর বটে। নাকি পাকিস্তানের মিডিয়ার দাবিই সত্য। এটা ছিল নাটক। সেখানে কোনও হামলা-ই হয়নি। মোদী সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য যুদ্ধ যুদ্ধ লেখা করলেন? সেটা যা-ই হোক, আপনাদের ব্যাপার।আবার আসি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। আপনি বলেছেন, ভারতের নৌবাহিনীর হামলায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দুই টুকরো হয়েছিল। এটা সম্পূর্ণ ভুল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলে পড়েছিল পাকবাহিনী। তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই খবর ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা সময় লেগেছিল। এরপরই থেকেই এদেশের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে; তাদের সঙ্গে লড়াই করে। বাঙালিরা যুদ্ধ করতে করতে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল। বিজয়ের ঠিক কিছুদিন আগে আপনাদের সামরিক বাহিনী সরাসরি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।এতে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়। কারণ পিঁপড়ার বলও বল। বিপদের সময় পিঁপড়ার বলও কাজে আসে। আপনারা না এলে আমাদের বিজয়ী হতে হয়তো আরও কিছুদিন সময় লাগতো। সেটা হতে পারতো এক মাস, দুমাস কিংবা আরও কিছুটা বেশি সময়। বিজয়ী আমরা হতাম-ই। এদেশের ৩০ লাখ মানুষ যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। আপনাদের শহীদ হয়েছে মাত্র ১৬০০ জন। এটা কিন্তু কোনও পার্সেন্টেজে পড়ে না। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধে আপনাদের অবদান অস্বীকার করছি না। সেটা করারও সুযোগ নেই। কারণ সত্যকে তো আর লুকানো যায় না। তবে একটা কথা বলতে চাই, মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের, কেবলই আমাদের। লেখক: সাংবাদিক।ভোরের আকাশ/এসএইচ
১ সপ্তাহ আগে
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে থেকেই আন্দোলনের শহরে রূপ নেয় ঢাকা। গত বছরের জুলাই শুরু হওয়া কোটাবিরোধী আন্দোলনের রেশ কিছুতেই কাটছে না। ৫২ গলি আর ৫৩ রাস্তার শহরটিতে যে যেভাবে পারছে, আন্দোলন করছে। কিন্তু এতে যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা কারো মাথায় নেই।সরকার বিষয়টি ভালোভাবে হ্যান্ডেল করতে পারছে না। ফলে আজ এ দল তো, কাল ও দল, গোষ্ঠী আন্দোলন করে তাদের শক্তি জানান দিচ্ছে। মাঝখানে বলির পাঠা হচ্ছে জনগণ। এখন আবহাওয়ার মতো কোন রাস্তায় কে কখন আন্দোলন করছে, সেটা জেনে রাস্তায় বের হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। এই পরামর্শকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ এই আন্দোলনের কারণে ৩০ মিনিটের রাস্তা যেতে কারো কারো চার ঘণ্টাও লাগছে। বৃহস্পতিবার (২২ মে) একটি জাতীয় দৈনিক অনলাইন ভার্সনে ‘আজ ঢাকায় কোথায় কী’ শিরোনামে একটি ফটোকার্ড প্রকাশ করেছে। এতে লেখা হয়েছে- সকাল ১০টা থেকে নগর ভবন (ডিএসসিসি), হাইকোর্ট এলাকা, মৎস্য ভবন ও কাকরাইলে ইশরাক সমর্থকদের সড়ক অবরোধ। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শাহবাগ মোড় ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে সাম্য হত্যা মামলার তদন্তে গাফিলতির প্রতিবাদে ছাত্রদলের অবস্থান কর্মসূচি। বিকেল ৪.৩০ যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তায় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির বিক্ষোভ মিছিল।’প্রিয় পাঠক, হয়তো বলবেন- আন্দোলন করা তো গণতান্ত্রিক অধিকার। হ্যাঁ, অবশ্যই গণতান্ত্রিক অধিকার। আমিও এই অধিকারের পক্ষে। কিন্তু একজন তার অধিকার আদায় করতে গিয়ে আরও হাজারো মানুষকে দুর্ভোগে ফেলবেন- এটা কেমন গো? আপনি কারো যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি করলেন মানে তার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করলেন। আপনি যদি এই তীব্র যানজটে কখনো আটকে পড়েন, তাহলে দুর্ভোগের মাত্রা বুঝতে পারবেন।গত ৯ মাসে ঢাকা শহরে পাঁচ শতাধিক আন্দোলন হয়েছে। এই মুহূর্তে পাঁচটির বেশি পক্ষ রাজপথে আছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হিসাবে, ঢাকায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে তিনটি আন্দোলন কর্মসূচি পালিত হয়। সে হিসেবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে পাঁচ শতাধিক আন্দোলন হয়েছে ঢাকার বুকে। কিছু কিছু আন্দোলন হাস্যরও সৃষ্টি করেছে। যেমন এর আগে কিছু শিক্ষার্থী অটোপাসের দাবিতে আন্দোলন করে।গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অটোরিকশার চালু; আনসারদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো; চাকরিচ্যুত সেনা ও পুলিশ সদস্যদের পুনর্বহাল; বিডিআর বিদ্রোহে কারাবন্দি সদস্যদের মুক্তি, ক্ষতিপূরণ ও চাকরিতে পুনর্বহাল; নিয়োগ বঞ্চিত বিসিএস ক্যাডারদের নিয়োগ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজ পৃথকীকরণ এবং স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠন; এবতেদায়ী শিক্ষকদের জাতীয়করণ; সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে মিছিল, সমাবেশ ও বিক্ষোভ হয়েছে।পলিটেকনিক্যালের শিক্ষার্থীদের অবরোধ, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন, রেলের কর্মচারীদের আন্দোলনও হয়েছে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ওয়াসা, ডেসা, সচিবালয় কর্মচারি থেকে বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান মাঠে নামে।আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপির আন্দোলন শেষ না হতেই ডিপ্লোমা ইন নার্সিং এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্সকে স্নাতক সমমানের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে মাঠে শিক্ষার্থীরা। ৭০ শতাংশ আবাসন ভাতাসহ তিন দফা দাবিতে রাজধানীর কাকরাইল মোড় অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা।ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে ‘মার্চ টু গাজা’ কর্মসূচিতেও মানুষের ঢল নামে। ১৮ মে চাকরিচ্যুত সেনাসদস্যরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। একই দিনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদে ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা করাতে চতুর্থ দিনের মতো বিক্ষোভ করেন তার অনুসারীরা।বৃহস্পতিবারও ইশরাক সমর্থকরা কাকরাইল ও মৎস্য ভবন এলাকায় বিক্ষোভ করেন। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগ থানা ঘেরাও, শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এখন প্রশ্ন হলো- আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে এতো আন্দোলন হয়নি। তখন সরকারের পেটুয়া বাহিনী পুলিশ সব আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করেছে। সেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন যেহেতু আন্দোলনে হয়েছে, সেহুতু এখনই দাবি আদায়ের মোক্ষম সময় মনে করছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। কিন্তু এখন আন্দোলন মানেই মিছিল, সমাবেশ, অবরোধ।বিশেষ করে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কোনো সড়কে বা মোড় অবরোধ করা হলে তার ফলে ওই এলাকায় যে তীব্র যানজট তৈরি হয়। আশপাশের সকল সড়কে, অলি-গলিতে এবং ধীরে ধীরে সেই ভোগান্তি ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে। কেননা, সবাই তখন বিকল্প পথে গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়। এখন আন্দোলনের মোক্ষম জায়গা হলো শাহবাগ মোড়।দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বারডেম হাসপাতাল সেখানে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। অসংখ্য রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা যান। ফলে শাহবাগ মোড়ে যখন অবরোধ হয়, তার প্রধান ভিকটিম হন এই মানুষগুলো। অনেক সময় চিকিৎসক ও হাসপাতালের অন্যান্য কর্মীরাও সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না। তাতে রোগীদের সেবা ব্যাহত হয়।যারা আন্দোলন করছেন, তাদের বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। সরকারের উচিত শাহবাগ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সড়কে আন্দোলন নিষিদ্ধ করা। এক্ষত্রে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা-সমাবেশ করতে পারে আন্দোলনরতরা। এতে কিছুটা হলেও মানুষের দুর্ভোগ কমবে।লেখক: সাংবাদিক।ভোরের আকাশ/এসএইচ
৩ সপ্তাহ আগে
এক সুপার পাওয়ারের নাম চীন। অর্থনীতি থেকে সামরিক শক্তি- অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। প্রতিবেশী আরেক সুপার পাওয়ার রাশিয়া তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শত্রু কেবল যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও তাদের পাওয়ার যথেষ্ট। এ কারণে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক তার বিপরীত অবস্থানে থাকে চীন। সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও দেশটির অনানুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ ছিল। প্রকাশ্যে বন্ধু পাকিস্তানের পক্ষে থাকার ঘোষণা দেয় বেইজিং। অন্যদিকে ভারতের পাশে থাকার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে যায়। এর পর থেকে উভয় দেশ অর্থাৎ ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করেছে। দেশ দুটি বিজয়ও উদযাপন করেছে। বিষয়টি অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। অথবা পাগলের সুখ মনে মনে, কাগজ কুড়ায় আর টাকা ভাবে। তবে এই যুদ্ধে জিতে গেছে চীন। এখন প্রশ্ন হলো- যুদ্ধ করলো ভারত-পাকিস্তান, চীন জিতলো কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। চীনের প্রতিরক্ষা শিল্প এই যুদ্ধ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে বিজয়ী হয়েছে। এই যুদ্ধ শুরু হয় ৭ মে।ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন এবং এ ঘটনার জেরে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ লক্ষ্য করে হামলা চালায় ভারত। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে ভারতের চালানো এ হামলার পরপরই উভয় পক্ষ পাল্টাপাল্টি সামরিক অভিযান শুরু করে। এসব অভিযানে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হয়। পাকিস্তান তার পাল্টা অভিযানের নাম দেয় ‘অপারেশন বুনইয়ান-উন-মারসুস’। সংঘর্ষে ভারত ফরাসি ও রুশনির্মিত যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে।অন্যদিকে, পাকিস্তান ব্যবহার করে চীনের সঙ্গে তাদের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত জে-১০ ও জে-১৭ যুদ্ধবিমান। ইসলামাবাদের দাবি- তাদের যুদ্ধবিমান অন্তত ছয়টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। এগুলোর মধ্যে নতুন করে কেনা ফরাসি রাফালও রয়েছে। দিল্লি এ দাবির কোনো জবাব দেয়নি। ‘ক্ষতি যুদ্ধের অংশ’- ভারতীয় বিমানবাহিনীর (আইএএফ) এয়ার মার্শাল এ কে ভারতি ওই দাবি প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন। তবে পাকিস্তান ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে, নির্দিষ্ট এ দাবি নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।তাদের বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদন বলছে, পাকিস্তান সম্ভবত চীনা-নির্মিত জে-১০ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ভারতীয় যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে আকাশ থেকে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এ সক্রিয় যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ব্যাপকভাবে চীনা অস্ত্র ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে পাকিস্তানের বিজয় দাবি করাকে কিছু বিশেষজ্ঞ বেইজিংয়ের প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন। যদিও অনেকে এ দাবির সঙ্গে একমত নন। কিছু বিশেষজ্ঞ এটিকে চীনের অস্ত্রশিল্পের জন্য একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেন। এ বক্তব্যের মাধ্যমে চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি চীনা এআই স্টার্টআপ তাদের সাশ্রয়ী প্রযুক্তি দিয়ে মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টদের চমকে দেওয়ার ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে। ‘এ আকাশযুদ্ধ ছিল চীনা অস্ত্রশিল্পের জন্য এক বিশাল বিজ্ঞাপন। এখন পর্যন্ত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজের প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষার কোনো সুযোগ চীনের হয়নি বলে মনে করেন চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্নেল ঝৌ বো। তার ভাষ্য, এ আকাশযুদ্ধের ফলাফল এটিই দেখিয়েছে, ‘চীনের এমন কিছু ব্যবস্থা রয়েছে, যেগুলো তুলনাহীন।’ ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে জে-১০ যুদ্ধবিমানের কার্যকারিতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর গত সপ্তাহে এ বিমান নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান অ্যাভিক চেংদু এয়ারক্রাফট নামের প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। তবে অন্য কয়েকজন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, চীনা অস্ত্র ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার সময় এখনো আসেনি।লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বলেন, চীনা যুদ্ধবিমানগুলো প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমানগুলো, বিশেষ করে রাফালকে কৌশলে হার মানিয়েছে কি না, তা এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। ‘সামরিক কৌশলের সাধারণ নীতি হলো, স্থলভাগের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগে শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আক্রমণ করে আকাশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় বিমানবাহিনীর অভিযানের লক্ষ্য স্পষ্টতই পাকিস্তানকে কোনো সামরিক জবাব দিতে উসকানি দেওয়া ছিল না। তার মতে, পাকিস্তানের পুরো বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যখন সর্বোচ্চ সতর্কতাবস্থায় ছিল এবং তাদের যুদ্ধবিমান আকাশে ছিল, তখন ভারতীয় পাইলটদের অভিযানে যাওয়ার নির্দেশে দেওয়া হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী তাদের মিশনের বিস্তারিত বা কৌশলগত তথ্য প্রকাশ করেনি।জে-১০ যুদ্ধবিমান রাফালসহ ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, এমন প্রতিবেদনগুলোর বিষয়ে বেইজিং এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে জে-১০ একটি পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে, এ অনিশ্চিত খবরাখবর চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজয়োল্লাস তৈরি করেছে।ইতালির ভেরোনাভিত্তিক আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা গবেষণা দল ‘স্টাডি অব সিকিউরিটি’র চীনবিষয়ক গবেষক কার্লোত্তা রিনাউডো বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য থেকে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে (জে-১০ দিয়ে পশ্চিমা অস্ত্রব্যবস্থা ধ্বংস করা) পৌঁছানো কঠিন হলেও চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জাতীয়তাবাদী বার্তায় ভরে গেছে।এ মুহূর্তে বাস্তবতার চেয়ে ধারণাই বেশি প্রভাব বিস্তারকারী হয়ে উঠেছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে প্রকৃত বিজয়ী আসলে চীনই। পাকিস্তান চীনের একটি কৌশলগত ও অর্থনৈতিক মিত্র। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের অংশ হিসেবে চীন পাকিস্তানে অবকাঠামো নির্মাণে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করছে। অতএব, দুর্বল পাকিস্তান চীনের স্বার্থ নয়।ভারত-পাকিস্তান এই সাম্প্রতিক সংঘাতে চীন গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য গড়ে দিয়েছে বলে মনে করেন পাকিস্তানি নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইমতিয়াজ গুল। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় পরিকল্পনাকারীদের জন্য এটা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তারা সম্ভবত পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে এতটা গভীর সহযোগিতার বিষয়টি কল্পনাও করেননি।’বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি বাস্তব যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীনা যুদ্ধবিমানগুলোর নৈপুণ্য পশ্চিমা দেশগুলোতে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর প্রভাব বিশ্ব অস্ত্রবাণিজ্যে পর্যায়ক্রমিকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ, আর চীন রয়েছে চতুর্থ স্থানে। চীন সাধারণত মিয়ানমার ও পাকিস্তানের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে অস্ত্র বিক্রি করে। এর আগে চীনা অস্ত্রব্যবস্থাকে নিম্নমান ও কারিগরি সমস্যার জন্য সমালোচিত হতে হয়েছে।২০২২ সালে চীন ও পাকিস্তানের যৌথ নির্মিত জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমানগুলোর বেশ কয়েকটি কারিগরি ত্রুটির কারণে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। নাইজেরিয়ার সামরিক বাহিনীও চীনের তৈরি এফ-৭ যুদ্ধবিমান নিয়ে একাধিক কারিগরি সমস্যার অভিযোগ করেছে। তবে, বেইজিং হয়তো সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের বিস্তারিত নিয়ে মন্তব্য না করতে পারে; কিন্তু তারা এটা দেখাতে আগ্রহী যে তাদের অস্ত্রব্যবস্থা দ্রুত পশ্চিমা দেশের সমকক্ষ হয়ে উঠছে।চীন পাকিস্তানকে যে যুদ্ধবিমান দিয়েছে, সেগুলো তুলনামূলকভাবে আগের মডেলের। বেইজিং ইতিমধ্যে আরও উন্নত জে-২০ স্টিলথ যুদ্ধবিমান নিজেদের বাহিনীতে যুক্ত করেছে; যা রাডার এড়াতে সক্ষম। লেখক: সাংবাদিক।
৩ সপ্তাহ আগে
কয়েক দিন ধরে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে ‘করিডর’ ইস্যু। বিভিন্ন দল বিশেষ করে বিএনপি এই করিডরের তুমুল বিরোধিতা করে আসছে। কডিরের কারণে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে- এমন আশঙ্কাও করেছেন অনেকে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার- ২৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন তার দপ্তরে সাংবাদিকদের এই কথা জানানোর পর থেকেই চলছে তুমুল আলোচনা। চায়ের দোকান থেকে রাজনীতির মঞ্চ- সব জায়গাতেই একই বিষয় ‘করিডর’।এখন প্রশ্ন হলো মিয়ানমারকে কেন করিডর দিতে হবে? নেইপিদো কী করিডর চেয়েছে? না, চায়নি। যে রাখাইন রাজ্যে করিডর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেই রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সেখানকার নিয়ন্ত্রক। তারা কী করিডর চেয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরও ‘না’। তাহলে করিডর চাইল কে? সেই প্রশ্নের উত্তর মিলেছে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায়। তার ভাষ্য, ‘এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ) হবে।কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’ অর্থাৎ করিডর চেয়েছে জাতিসংঘ। বিষয়টি নতুন না। এ বছরের প্রথমার্ধে রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করেছিল জাতিসংঘ। এ জন্য মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের কাছে ‘করিডর’ দেওয়ার অনুরোধ করেছিল সংস্থাটি। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা। বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তকে সাদা চোখে দেখলে বেশ ভালই মনে হবে। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলেই অন্যচিত্র বের হয়ে আসবে।প্রথমত, মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলছে বিদ্রোহীদের। এই রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ এখন বিদ্রোহীদের হাতে (আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের তথ্য)। বিদ্রোহীদের কোণঠাসা করতে সরকার সব সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সেখানে দুর্ভিক্ষের অবস্থা বিরাজ করছে। এখন যদি বাংলাদেশ করিডর দেয়; তাহলে সেটা হবে বিদ্রোহীদের সহায়তা; যা দুই দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আবার যে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে; সেই সহায়তা রোহিঙ্গাদের হাতে পৌঁছবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। ধরেই নিতে হবে- এই ত্রাণ সামগ্রী রোহিঙ্গারা পাবেন না।কেননা, রোহিঙ্গাদের অনেকে সরকারি বাহিনীর হয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করছে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে- এমন খবরও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। সুতরাং এই ত্রাণ সহায়তা যে রোহিঙ্গারা পাবেন না, তা নিশ্চিত। করিডর চালুর আগেই সোয়া লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।করিডর চালু হলে সেখানে থাকা বাকি আরও লাখ দশেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসতে পারে। কারণ তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন এদেশে ক্যাম্পে রয়েছে। তারা তাদের আনার চেষ্টাও করছে। মাঝেমধ্যেই সীমান্তের ওপারে জড়ো হন রোহিঙ্গারা। দালালের মাধ্যমে তারা এ দেশে আসেন। কোনওভাবেই তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় করিডর চালু হলে রোহিঙ্গার ঢল নামবে। করিডরকে আসা-যাওয়ার পথ বলা হলেও তা মূলত আসার পথ হবে; যাওয়ার পথ নয়।করিডর দিয়ে আরাকান আর্মি রোঙ্গিাদের এ দেশে ঠেলে দিতে পারে। আরাকান আর্মি জান্তা বাহিনীর শত্রু হলেও একটা জায়গায় তাদের মিল আছে। উভয় বাহিনীই রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে চায়। কারণ রোহিঙ্গাদের সিংহভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আর জান্তা ও আরাকান আর্মি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা মুসলমানদের সহ্য করতে পারে না। এই করিডর দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আরাকান আর্মি প্রবেশ করলে ঠেকানোর উপায় আছে?তারা যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং অপরাধ করে ফিরে যায়, তাহলে আমাদের করার কী আছে? কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনেকে রাখাইনে গিয়ে যুদ্ধ করে অস্ত্র নিয়ে ফিরে আসছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন তো বিজিবির পাহারা আছে। তারা বাধা দিচ্ছে। তারপরও অপরাধী রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। করিডর চালু হলে রোহিঙ্গারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। এই জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশ কক্সবাজারে মাদকদ্রব্য পাচার, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই করছে। তাদের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষকে অপরহরণেরও প্রমাণ মিলেছে।নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের খুব কম মানবিক করিডরই নিরাপত্তাঝুঁকির বাইরে থেকেছে। যদিও মানবিক করিডর দেওয়া হয় সাধারণ নাগরিকদের সহায়তার জন্য। তবে এ ধরনের করিডর চালু হলে সেই অঞ্চলে থাকা বিদ্রোহী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসহ অপরাধীরা সেটাকে নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে থাকে। এ অঞ্চল বিশ্বে মাদকদ্রব্য, অবৈধ অস্ত্র পাচারসহ নানা আন্তঃসীমান্ত অপরাধের অন্যতম রুট হিসেবে পরিচিত। করিডর দিলে মাদক বা অবৈধ অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা থাকবে। এ ছাড়া মিয়ানমারের রাখাইনে বর্তমানে কোনো স্বীকৃত প্রশাসন নেই। ফলে সেখানকার অস্বীকৃতদের সঙ্গে কোনো ধরনের দর-কষাকষির আলাদা ঝুঁকি রয়েছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকি তো রয়েছেই।বিকল্প হতে পারে সিতওয়ে: রাখাইন রাজ্যের রাজধানী হলো সিতওয়ে। কালাদান, মায়ু ও লে ম্রো নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত এটি। ২০২৩ সালের ১২ মে সেখানে নতুন পোর্ট টার্মিনাল উদ্বোধন করা হয়। ভারতের সহায়তায় এটি নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে। মানবিক করিডর অর্থাৎ ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে কিংবা বেসামরিক নাগরিকদের সেখান থেকে সরিয়ে নিতে এই বন্দর ব্যবহার করতে পারে জাতিসংঘ। ভারত ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। এসব সীমান্তকে করিডর হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দিতে জাতিসংঘ অনুরোধ করতে পারে। বাংলাদেশের মতো একটা ছোট দেশের কাছে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এতো আবদার কেন? এমনিতেই ১৩ লাখ রোহিঙ্গার চাপে বাংলাদেশ ন্যূজ¦। তাদের অনুরোধেই মিয়ানমারের বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তারা এখন আমাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু চেষ্টা তদবির করেও তাদের ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না।অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস থাইল্যান্ড সফরে গিয়ে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নেবে বলে আশ্বাস পাওয়ার কথা জানালেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখলাম? মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও নেয়নি। বরং কয়েক দিন আগে সোয়া লাখের বেশি রোহিঙ্গা এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এ তো গেল তালিকার কথা। তালিকার বাইরে কতজন এসেছে; সেই হিসাব কারো কাছে আছে? বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর খেলা বন্ধ করা উচিত। আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে। তারা যেন কিছু আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে না পারে। আমরা যেন তাদের খেলার ঘুঁটি না হই। করিডর ইস্যুতে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িত এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় (করিডর) সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিন্তু জনগণকে জানায়নি। এমনকি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও কোনো আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। দেশের জনগণকে না জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না কিংবা নেওয়া উচিত কি না, এই মুহূর্তে সে বিতর্ক আমি তুলতে চাই না। তবে দেশের স্বাধীনতা প্রিয় জনগণ মনে করে, করিডর দেওয়া না দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের কাছ থেকে, সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের মাধ্যমে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক বিশ্বের দেশে দেশে এটাই নিয়ম, এটাই রীতি।বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার যে ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে (করিডর ইস্যু) তাতে দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির’ মুখে পড়বে। এক্ষেত্রে সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটি ঠিক হয়নি। উচিৎ ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।এছাড়া জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদসহ প্রায় সব দলের নেতারা করিডর ইস্যুতে বিরোধিতা করছেন। এ কারণে সরকারের উচিত এখান থেকে সরে আসা। সরকারকে মনে রাখতে হবে করিডর দিয়ে যেন আমরা নতুন বিপদ ডেকে না আনি; যেমনটা আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে করেছি। লেখক: সাংবাদিক।ভোরের আকাশ/এসএইচ
৩ সপ্তাহ আগে