জাহিদুল ইসলাম শিশির
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৫ ০১:৩৮ পিএম
লন্ডন বৈঠকে দায় বাড়ল বিএনপি’র
লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস ও বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যন তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অনেকটাই চাপমুক্ত হয়েছে সরকার। বলা চলে, কিছুদিন আগ থেকে সরকারের ভেতরে যে অস্থিরতা ছিলো; তা পুরোমাত্রায় কেটে গেল। সরকার এখন থেকে রুটিন ওয়ার্কসহ সংস্কার কাজে পূর্ণ মনোযোগ দেয়ার সুযোগ পাবেন। এতে আইন শৃঙ্খলা, কুটনীতিসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ার আশা করা যায়।
বলা যায়, লন্ডন বৈঠক সরকারের জন্য শতভাগ ইতিবাচক হয়েছে। একই সাথে দায় বাড়ে বিএনপির। সে দায় একই সাথে রাজনৈতিক, কুটনৈতিক এবং সামাজিক। দল হিসেবে বিএনপি যদি সমান্তরালে সে দায় পালনে দক্ষতার পরিচয় দিতে সামান্য ভুল করে, তাহলে রাজনীতির সমীকরণে অনেক কিছুই পাল্টে যেতে পারে। যার আভাস ইতোমধ্যে সামনে আসতে শুরু করেছে।
লন্ডন বৈঠকের পর স্বস্তি নিয়ে প্রফেসর ইউনূস দেশে ফিরেছেন। এর আগেই বৈঠকের কালচারকে ইতিহাসের নজিরবিহীন হিসেবে বক্তব্য দিয়েছে জুলাই বিপ্লব বা গণাভ্যুথ্থ্যানে সরাসরি অবদান রাখা এবং একই সাথে বিএনপির দীর্ঘ পরীক্ষিত মিত্র রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। তারা বলেছেন, একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সরকার প্রধানের বৈঠক হতেই পারে। কিন্তু সেই বৈঠকের বিষয়বস্তু যৌথ ঘোষণা আকারে আসা ইতিহাসের নজিরবিহীন। এতে সরকার একটি পক্ষের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। যা সামনের দিনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের যে আকাঙ্খা তা বাস্তবায়নে সংশয় সৃষ্টি হতে বাধ্য।
একই বার্তা দিয়েছে জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা রাখা এনসিপি। তারা বলেছে, এতে সরকার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক হওয়া দোষের কিছু নয়, কিন্তু জাতীয় ইস্যুতে কোন সিদ্ধান্ত হতে হলে সরকল পক্ষের মতামতের ভিত্তিতেই হতে হবে। আর জুলাই আন্দোলনের যে আকাঙ্খা তাকে পাশ কাটিয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এর বাইরে থাকা ইসলামী দলগুলোও একই প্রকার বার্তা দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণও একই প্রকার কথা বার্তা বলছেন।
লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, সরকার প্রধান বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর করতে চেয়েছেন। সে কারণে আগের অবস্থান থেকে অনেক ছাড় দিয়ে এখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দশ মাসে মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির নানা অভিযোগ বিভিন্ন সময় যেমন উঠেছে, একইসঙ্গে অর্থনীতি সামাল দেওয়াসহ দেশ পরিচালনায় দুর্বলতা এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার চিন্তা এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের জন্য মানবিক করিডরের প্রশ্নসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্কের মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভক্তি সরকারকে অস্থিরতায় ফেলেছিল বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। কিন্তু সরকার যদি রাজনৈতিক শক্তিসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে তিক্ততায় যায় এবং একটা অস্থির পরিবেশের সৃষ্টি হয়, তাহলে সেই সরকারের ‘এক্সিট’ নিয়েও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশংকা থাকে। সেক্ষেত্রে সরকারের নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া এবং পরে নিরাপত্তার প্রশ্নে বন্দোবস্ত কী হবে, সেটিই বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার ক্ষেত্রে সরকারের বিবেচনার বড় বিষয় ছিল। যার একটি গ্যারান্টি কোলাজ পেয়েছে সরকার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা হাফিজ গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে প্রকৃত অর্থে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। এপ্রিলের মধ্যে ভোট হবে তার এমন ঘোষণায় তিনি অনড় আছেন। বিএনপির সঙ্গে সরকারের যে টানাপোড়েন ছিল সেটির অবসান হয়েছে যা ছিল এ বৈঠকের বিশেষ বার্তা। তবে বৈঠকে সংস্কার ও বিচারসহ নানা বিষয়ে বিএনপির অবস্থান অস্পষ্ট। এছাড়া বিএনপি যে ঐক্যের কথা বলছে সেখানেও কিছুটা হলেও অনৈক্য তৈরি হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাজনীতির মাঠে এই যে অসন্তুষ্টি বা অনৈক্য তৈরী হলো তা সমাধান করে একটি সুষ্ঠুু ও গ্রহণ যোগ্য নির্বাচনের দিকে দেশকে নিয়ে যাওয়ার দায়তো বিএনপির ঘাড়ে গিয়ে বর্তালো। কারণ সরকার কোন ভাবেই রাজনৈতিক আবেগ মিটিয়ে ফেলার কাজে মনোযোগ দিবে না বা দায় নিবে না।
দল হিসেবে বিএনপি কোন কৌশলে অন্যান্য সকল রাজনৈতিক শক্তিকে আস্থায় এনে সামনের নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে তা একান্তই তাদের ব্যাপার হযে দাঁড়ালো। আবার জুলাই সনদ ঘিরে যে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে তাতেও এখন বিএনপির স্পষ্ঠ অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আবার দেশকে অস্থিতিশীল করে যে দেশীয় বা বহিশক্তি সুবিধা নিতে চায়, তাদের ষড়যন্ত্র বা চক্রান্ত যে থেমে যাবে তাওতো নয়।
কুটনৈতিক অঙ্গনে যদি এমন বার্তা যায় যে, দেশে রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবে নির্বাচন দেয়া যাচ্ছে না। তাহলে কাঙ্খিত নির্বাচনের ভাগ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থেকে যাবে। সব মিলে ঘরে এবং বাইরে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে সকলের আস্থা সৃষ্টির মোটা দাগের দায়টি লন্ডন বেঠকে কাঁধে তুলে নিয়েছে বিএনপি। এখন দেখার বিষয় রাজনৈতিক আস্থা সৃষ্টিতে বিএনপি কতটা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে।
ভোরের আকাশ/জাআ