× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিকাশ এবং এর প্রভাব

রাশেদুল হক রঞ্জন

প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৫ ০৭:০০ পিএম

চিত্র - কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে প্রস্তুতকৃত

চিত্র - কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে প্রস্তুতকৃত

বাংলাদেশ, সাংস্কৃতিকভাবে ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ এবং ঐতিহাসিকভাবে জটিল রাজনৈতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসা একটি দেশ। যা এখন একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের সন্ধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে রয়েছে। গত তিন দশকে কিছু অগ্রগতি হলেও, দেশটি এখনও একটি উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, এবং ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। অশিক্ষা, মিথ্যাচারিতা, অপপ্রচারমূলক কার্যকলাপ, ফ্যাসিবাদ, একনায়কতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বড় বাধা সৃষ্টি করছে। একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এখন অতীব জরুরি যা জনগণের মতামত, স্বাধীনতা, এবং প্রযুক্তিগত অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দেয়—যেখানে সরকার সত্যিকার অর্থে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত এবং পরিচালিত হয়। এই প্রবন্ধটি সেই বাধাগুলি পর্যালোচনা করে এবং সেগুলি অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা, বিভিন্ন মিডিয়া বা প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা, জনগনের সাক্ষরতাহার বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, এবং প্রযুক্তির মতো কার্যকর কৌশলগুলির প্রস্তাবনা করে, যা একটি প্রকৃতরূপে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের পথ দেখায়, যেখানে জনগণের ইচ্ছা ও স্বাধীনতার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে।  

সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য এবং এর বিকাশ
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর প্রাথমিক বছরগুলি সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিল, যা ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিফলিত হয়েছিল। তবে, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং সামরিক শাসনের উত্থানের পর এই সমাজতান্ত্রিক মূলনীতিগুলি থেকে ধীরে ধীরে দেশটির বিচ্যুতি ঘটে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে Neoliberal নীতির প্রবর্তন দেশের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বাজার ভিত্তিক পুঁজিবাদের দিকে পরিবর্তিত করেছিল। 
এই পরিবর্তনগুলি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিলেও, সামাজিক বৈষম্য এতে বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং জনকল্যাণমুলক রাষ্ট্র হিসেবে এর ভিত্তি দুর্বল হয়েছিল। ধনী এবং গরীবের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়েছিল, এবং বহু মানুষের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সেবাসমূহের প্রাপ্তি সীমিত হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য - যদিও দুর্বল হয়েছিল, তা এখনও জনসমাজকে কল্যাণমুলক করার আলোচনাকে প্রভাবিত করে এবং তা বিকাশের বিকল্প পদ্ধতির জন্য একটি কাঠামো প্রদান করে।
প্রতিবন্ধকতাসমূহ

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং স্বৈরাচারী প্রবণতা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে প্রায়শই অস্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়, যা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে তীব্র ক্ষমতার লড়াই দ্বারা চালিত হয়। এই পরিবেশ স্বৈরাচারী প্রবণতাগুলিকে উৎসাহিত করে, যেখানে নেতারা জাতীয় কল্যাণের চেয়ে ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলিকে দুর্বল করে, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে প্রান্তিকীকরণ করে, এবং কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় চেক এবং ব্যালেন্সকে দুর্বল করে। গণতান্ত্রিক নীতি এবং সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থা ঘটায়, যা প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ কঠিন করে তোলে।

অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার
মিথ্যাচারিতা এবং অপপ্রচারের ব্যাপক বিস্তার গণতান্ত্রিক উন্নয়নের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা। রাজনৈতিক দলগুলি এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলি তাদের এজেন্ডা পূরণের জন্য তথ্যের অপব্যবহার করে, মিথ্যাচারিতা করে যার ফলশ্রুতিতে জনগনের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিভক্তি। এই তথ্যের অপব্যবহার নেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষমতা সীমিত করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে। সোশ্যাল মিডিয়া এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়, যার মাধ্যমে ভুল বিবরণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রকৃত জনমত গঠনের উপর প্রভাব ফেলে। মিথ্যাচার কেবল জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে না, বরং বিভাজনকে উসকে দেয়, যা সমাজকে অস্থিতিশীল করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলস্বরূপ, একটি বিভক্ত সমাজ তৈরি হয় যেখানে তথ্য উৎসগুলির প্রতি মানুষ তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, যা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়গুলিকে সঙ্গতিপূর্ণ করা কঠিন করে তোলে।

শিক্ষাগত বৈষম্য এবং অশিক্ষা 
শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার সত্ত্বেও, বাংলাদেশ এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে শিক্ষাগত বৈষম্যের মুখোমুখি, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি হল অশিক্ষা। ২০২১ সালের UNESCO প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৭৬.৩৬%। এর মানে হলো, জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পড়তে বা লিখতে অক্ষম। অশিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা, যা নাগরিকদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়গুলিতে অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ এবং সঠিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমালোচনা করার ক্ষমতা সীমিত করে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায়ই প্রকৃত সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ক্ষমতার চেয়ে রট লার্নিংকে (মুখস্থবিদ্যা) গুরুত্ব দেয়, যা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক সমাজে অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। এই ধরনের শিক্ষাগত ব্যবস্থা অপপ্রচারমূলক মিথ্যাচারকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা এবং জাতির গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে, একটি সজাগ এবং সক্রিয় নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার প্রয়াসকে কঠিন করে তোলে।

অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য
অর্থনৈতিক বৈষম্য বাংলাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তোলে। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের ফলে দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশের বঞ্চনা ও প্রান্তিকীকরণ ঘটে। এই অর্থনৈতিক বিভাজন প্রায়ই রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো সম্পদের বিষয়গুলিতে অসম অংশগ্রহন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, যা সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল করে এবং ক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বৈষম্যগুলি একটি ঐক্যবদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা কঠিন করে তোলে, কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রায়শই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যায়। প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলির জন্য অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব তাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তি আরও কঠিন করে তোলে।

দুর্নীতি এবং জবাবদিহির অভাব
দুর্নীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থায় গভীরভাবে প্রোথিত, যা প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তোলে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত কার্যক্রম ফুলেফেঁপে উঠে, যা প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলি থেকে সম্পদ সরিয়ে নেয় এবং আইনের শাসনকে দুর্বল করে। দুর্নীতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনসাধারণের বিশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এবং গণতন্ত্র ও সুশাসনকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার মত সংস্কার বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে। দুর্নীতির ব্যাপক প্রকৃতি কেবলমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতাকে ক্ষুন্ন করে না বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকেও বাধাগ্রস্ত করে।

ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বিভাজন
বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, যা সম্ভাব্যভাবে একটি শক্তির উৎস, প্রায়শই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। ধর্মীয় বিভাজন, বৈষম্য এবং সহিংসতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়, যা জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশে ফ্যাসিবাদ ও অত্যাচারের উত্থানে অবদান রাখে। এই বিভাজন একটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে, যেখানে সমস্ত নাগরিক, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই বিভাজনগুলির ব্যবহার সামাজিক বিভাজনকে চিরস্থায়ী করে এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করে।

এই প্রতিবন্ধকতাগুলি অতিক্রম করার উপায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ভূমিকা
গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এই চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করার জন্য এমন একটি কাঠামো প্রদান করে যা সামাজিক মালিকানা, জনকল্যাণ, এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের উপর জোর দেয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা সমাজতন্ত্রের উপাদানগুলিকে গণতান্ত্রিক শাসনের সাথে একত্রিত করে। এটি একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যেখানে উৎপাদন, বিতরণ এবং বিনিময়ের উপায়গুলি সমগ্র সম্প্রদায় (প্রায়শই রাষ্ট্রের মাধ্যমে) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, একই সাথে নিশ্চিত করে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা জনগণের দ্বারা গণতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। এই ধরনের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান-স্টাইলের কল্যাণ রাষ্ট্র এবং আরও অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের অর্থনীতির মডেলগুলিই তার উদাহরণ যার মাধ্যমে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায্যতা অর্জন করার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক শাসন বজায় রাখা যায়।

সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ:
• সরকারি মালিকানা: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে, মূল শিল্প ও সম্পদ সাধারণত রাষ্ট্র বা সমবায় দ্বারা মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রিত হয়, যার লক্ষ্য হল দেশের ধনসম্পদ সমগ্র জনসংখ্যার মধ্যে সামগ্রিকভাবে এবং আরও সমভাবে বিতরণ করা।
• গণতান্ত্রিক শাসন: সমাজতন্ত্রের স্বৈরাচারী রূপগুলির বিপরীতে, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র মুক্ত নির্বাচন, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ এবং নাগরিক স্বাধীনতার সুরক্ষার মতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলির উপর গুরুতারোপ করে। নাগরিকদের নীতি প্রণয়নে অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করে এবং 
সরকারী নীতি প্রনয়নকে প্রভাবিত করে।
• সামাজিক কল্যাণ: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হল সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলির প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা। সমস্ত নাগরিকের জন্য একটি উচ্চ জীবনমান নিশ্চিত করতে সরকার প্রায়শই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আবাসন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা প্রদান করে।
• অর্থনৈতিক পরিকল্পনা: দেশের বাজারগুলি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রায়শই অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি হস্তক্ষেপের সাথে জড়িত, যা বৈষম্য প্রতিরোধ করে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমসমূহ সমাজের সার্বিক মঙ্গল অনুযায়ী নিশ্চিত করে।
• শ্রমিকদের অংশগ্রহণ: বিভিন্ন ধরনের সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে, শ্রমিকরা তাদের কর্মক্ষেত্র পরিচালনায় কাউন্সিল বা সমবায়ের মাধ্যমে সরাসরি ভূমিকা রাখে। এটি কর্মীদের ক্ষমতায়িত করার এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাধারণ অনুক্রমিক (hierarchical) কাঠামো কমানোর উদ্দেশ্যে করা হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, একটি সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক মডেল যা সামাজিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠা, প্রধান শিল্পগুলির জনস্বত্বের সঠিক বণ্টন, এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে অগ্রাধিকার দেয়ার মাধ্যমে দেশটির জরুরি চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গুণগত স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, দুর্বলদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, শ্রমিকদের অধিকার ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও শাসন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ 
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং স্বৈরাচারী প্রবণতাগুলি মোকাবেলায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালীকরণ এবং আইনের শাসনকে প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় এমন অবাধ, সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে ব্যাপক নির্বাচন সংস্কার প্রয়োজন। স্থানীয় সরকারগুলিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সরকারি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করা, সকলের জন্য ন্যায্য এবং একটি সমতল মঞ্চ তৈরি করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সকলের কণ্ঠস্বর শোনা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং গণমাধ্যম জ্ঞানের প্রচার 
মিথ্যাচার, বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের বিস্তার রোধ করার জন্য জনগনকে গণমাধ্যম জ্ঞানসম্পন্ন করা অপরিহার্য। নাগরিকদের ভুয়া খবর চিহ্নিত করার ও প্রাপ্ত তথ্যের উৎসগুলি সমালোচনামূলকভাবে মূল্যায়ন করার এবং এর অপব্যবহার প্রতিরোধ করার জন্য প্রকৃত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান, সচেতনতাবোধ তৈরি, তথ্যের বিশ্লেষণ ও গণমাধ্যম জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করা প্রয়োজন। ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের এবং প্রশাসনকে জবাবদিহিতার আওতায় রাখা এবং জনগণের কাছে সঠিক তথ্যের উপলব্ধতা নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীন গণমাধ্যম এবং অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা সমর্থন করাও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এবং সুশীল সমাজকে মিথ্যাচারের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে একসাথে কাজ করা প্রয়োজন।

শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার 
নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষা সংস্কার অপরিহার্য। সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধান এবং সুনাগরিক হওয়ার শিক্ষার উপর জোর দিতে পাঠ্যক্রমসমূহের সংশোধন করা উচিত। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, গুণগত শিক্ষা পৌঁছানোর সুযোগ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ যাতে সকল নাগরিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে। এবং এজন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করা, দেশের সামগ্রিক শিক্ষার গুণমান উন্নত করা এবং নাগরিকদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করা যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আরও তথ্যসমৃদ্ধ এবং সক্রিয় নাগরিক গোষ্ঠী তৈরি করতে পারে যা জাতির অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক বিকাশে অবদান রাখতে সক্ষম।

অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করা
অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবেলা করতে এমন লক্ষ্য ও নীতির বাস্তবায়ন প্রয়োজন যা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে প্রসার করে এবং সকল সম্পদের উপর সকলের সমঅধিকার নিশ্চিত করে। প্রগতিশীল করের বাস্তবায়ন, সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচিসমূহের বৃদ্ধি, নতুন নতুন চাকরি সৃষ্টি এবং দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সকল নাগরিকের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক পরিষেবাগুলিতে সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, আন্ত বৈষম্য হ্রাস করা এবং সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। অর্থনৈতিক নীতিগুলি প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলিকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা এবং সকল নাগরিককে অর্থনীতিতে সম্পূর্ণরূপে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করার উপর ফোকাস করা উচিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলা করে, বাংলাদেশ একটি আরও ঐক্যবদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে পারে।

দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা জোরদার করা 
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরি, উভয়েরই প্রয়োজন। দুর্নীতি-প্রতিরোধী সংস্থাগুলিকে শক্তিশালী করা, দুর্নীতি রোধে কঠোর শাস্তির বিধান ও প্রয়োগ করা, এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে সততার সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার করা দুর্নীতি হ্রাসের জন্য অপরিহার্য। প্রসাশনিক শাসনে জনসাধারণের অংশগ্রহণ, কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা এবং সরকারি সম্পদ কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নাগরিক তদারকি কমিটি এবং তথ্য উন্মুক্তকরণ উদ্যোগের মতো প্রক্রিয়াগুলির বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে উল্লেখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহনের মাধমেই জনসাধারণের প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি তাদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ তৈরি করতে সাহায্য করবে।

ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ঐক্য প্রচার
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজন কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক বন্ধনকে উৎসাহিত করতে হবে। সকল নাগরিক, তাদের ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পটভূমি নির্বিশেষে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেন সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য বৈষম্য বিরোধী আইন এবং নীতির বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তঃসম্প্রদায় সংলাপ, শান্তি শিক্ষার কর্মসূচি এবং একে অপরের প্রতি সহনশীলতার সংস্কৃতি তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় কিন্তু ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে পারে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধর্মের ব্যবহার এবং সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয় এমন বক্তব্য সমালোচনামূলকভাবে পরীক্ষা করা উচিত এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিকে আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা করা উচিত। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে, বাংলাদেশ একটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার
ডিজিটাল যুগে, প্রযুক্তি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে। সরকারকে এমন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করা উচিত যা নাগরিকদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে, মতামত প্রদান করতে, এবং নেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। অনলাইন ভোটিং সিস্টেম, ডিজিটাল টাউন হল, এবং নীতিগত বিষয়ে পাবলিক পরামর্শের প্ল্যাটফর্মগুলি ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ যা একটি আরও সংযুক্ত এবং সক্রিয় নাগরিক সমাজ তৈরি করতে পারে। প্রশাসনে এধরনের ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদের এবং তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে যা নিশ্চিত করবে একটি সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।

পরিশেষে 
বাংলাদেশের জন্য এই ধরনের একটি উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রাটি জটিল কিন্তু একটি অপরিহার্য লক্ষ্য। জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় এমন একটি শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক সংস্কার, গণমাধ্যম জ্ঞানের প্রচার, শিক্ষাসংস্কার, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস, দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচারের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই বাধাগুলির সমাধান করার মাধ্যমে, বাংলাদেশ একটি আরও ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করতে পারে, একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তার নাগরিকদের ক্ষমতায়িত করতে পারে, যেখানে প্রত্যেকের মতামত জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্যতা পাবে এবং গণতান্ত্রিক আদর্শসমৃদ্ধ হবে। প্রযুক্তি, শিক্ষা, এবং সকল সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের জন্য উল্লেখিত প্রক্রিয়াসমূহের বাস্তবায়ন এবং যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে দেশীয় সম্পদসমূহের সুষম বণ্টন ও সদ্ব্যবহার করে, বাংলাদেশ এমন একটি জাতি হিসাবে পরিণত হতে পারে যা শুধুমাত্র তার নাগরিকদের আকাঙ্খাকেই প্রতিফলিত করবে না, বরং সকলের অন্তর্ভুক্তি এবং বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে।

Writer (লেখক):

রাশেদুল হক রঞ্জন
Phone: +88-01918180309 (WhatsApp) 
LinkedIn: https://www.linkedin.com/in/rashedul-haque-ronjon 
Email: rashedul.haque.ronjon@outlook.com
 

  • শেয়ার করুন-
 একদিনের ব্যবধানে ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম

একদিনের ব্যবধানে ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম

 যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবেলায় মহড়া: সারাদেশে তৎপর ভারত

যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবেলায় মহড়া: সারাদেশে তৎপর ভারত

 জৈন্তাপুরে সেনাবাহিনীর অভিযানে ভারতীয় পণ্য আটক

জৈন্তাপুরে সেনাবাহিনীর অভিযানে ভারতীয় পণ্য আটক

 আমটি ক্ষতিকর কেমিক্যাল মুক্ত তো!

আমটি ক্ষতিকর কেমিক্যাল মুক্ত তো!

 দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন বিএনপি’র চেয়ারপার্সন : ডা. জাহিদ

দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন বিএনপি’র চেয়ারপার্সন : ডা. জাহিদ

সংশ্লিষ্ট

বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিকাশ এবং এর প্রভাব

বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিকাশ এবং এর প্রভাব

প্রজন্ম জেড-ই গণতন্ত্র রক্ষা করবে

প্রজন্ম জেড-ই গণতন্ত্র রক্ষা করবে

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের এক অনন্য পরিচয়

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের এক অনন্য পরিচয়

রুদ্ধ হতে পারে রাজনীতির পথ

রুদ্ধ হতে পারে রাজনীতির পথ