আব্দুর রহিম
প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৫ ০৫:৩২ পিএম
ফাইল ছবি
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতির পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। নানা গুঞ্জনেরও ডালপালা মেলে। অনেকের মনে ছিল অজানা আশঙ্কা। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে বৃহস্পতিবার। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভিডিও বার্তা পাঠান। সেই বার্তায় বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে কষে চড় মেরেছে ইরান’। শুধু তা-ই নয়, ইরানের পারমানবিক স্থাপনায় হামলা মূল উদ্দেশ্য ছিল না। মূল উদ্দেশ্য ছিল তেহরানকে ভয় দেখানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করানো। কিন্তু ইরান আত্মসমর্পণ করবে না। তারা সাহসী জাতি এবং লড়ে যাবে। তার এই বক্তব্য রাজনৈতিক বৈ কী। দেশের মানুষকে সাহস দেওয়া, দৃঢ় ঐক্যবদ্ধতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ ছিল অন্যতম লক্ষ্য।
রাজনীতিকদের অনেক কথাই বলতে হয়। তারা পরিস্থিতি অনুসারে অনেক কথাই বলে থাকেন। সেগুলো কেবল কথার কথা। কিন্তু ‘যুক্তরাষ্ট্রকে কষে চড় মেরেছে ইরান’- খামেনির এই বক্তব্য নিছক কথার কথা নয়। কেননা, বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। সুপার পাওয়ার এই যুদ্ধবাজ দেশটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সহিংসতা লাগিয়ে রাখে কেবল নিজেদের স্বার্থে। তারা কারণে অকারণে বিভিন্ন দেশে হামলা করে। সাধারণ মানুষের প্রাণ নিয়ে তারা খেলায় মেতে উঠে। মানুষের প্রাণহানি হলে তারা উল্লাস করে।
আবার বিভিন্ন দেশে মানবাধিকারের তাবিজও তারাই বিক্রি করে। তাদের স্বার্থে আঘাত হেনে কেউ সুস্থ থেকেছে- এমন নজির মেলা ভার। কিন্তু ইরান এবার দেখিয়ে দিল- সবাই এক নয়। সবাই মুখ বুজে মার খায় না। কেউ কেউ উল্টো মার দেয়। বলছিলাম মধ্যপ্রাচ্যের চার দেশে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা।
১৩ জুন ভোরে ইসরায়েল ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। পরে শনিবার ইরানের নাতাঞ্জ, ফর্দো ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ১৭টি বাংকার–বিধ্বংসী বোমা ও দুই ডজন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরায়েলকে সহায়তা করার জন্যই এ হামলা চালানো হয়। মার্কিন হামলার পর ইরানের পাল্টা জবাব আসে। গত সোমবার সন্ধ্যায় তারা কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সেন্ট্রাল কমান্ড ঘাঁটি আল-উদেইদে ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে।
এ হামলায় ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কাতারের রাজধানী দোহার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা ছিল একেবারেই প্রত্যাশিত। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোর কয়েকটি ইরানের আশপাশেই অবস্থিত।
আল-উদেইদ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর বাহরাইনে অবস্থিত। এ দুটির অবস্থান ইরান থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি দূরত্বে। এ ছাড়া সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি, ইরাকে তিনটি এবং কুয়েত ও জর্ডানে একটি করে মার্কিন বিমানঘাঁটি আছে। ওমানে চারটি লজিস্টিকস–সংক্রান্ত মার্কিন বিমানঘাঁটি আছে।
ইরানে মার্কিন হামলার পর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করেন, এ হামলায় ভয়ানক প্রতিশোধের চক্র তৈরি হতে পারে। কিন্তু এমন কিছু ঘটেনি। উল্টো হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন ট্রাম্প। এ যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছিল কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে। কিন্তু মার্কিন ঘাঁটিতে এমন একটি হামলার পরও কীভাবে যুদ্ধবিরতি সম্ভব হলো? সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
আল–জাজিরার সাংবাদিক দোরসা জাব্বারি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯টি ঘাঁটিতে ৪০ হাজার সেনা রয়েছেন। ঘাঁটিগুলোর আটটি স্থায়ী। ইরান আগে থেকেই বলে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানে হামলা চালায়, তবে এসব ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু করা হবে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) এক বিশ্লেষণে বলেছে, আগে যখন কেউ ইরানকে আঘাত করেছে, তখন তেহরান নিজেদের সেনা না পাঠিয়ে সমর্থক মিলিশিয়া গোষ্ঠী দিয়ে (যেমন ইয়েমেনের হুতি, লেবাননের হিজবুল্লাহ) প্রতিশোধ নিয়েছে। এটাই ছিল তাদের প্রধান কৌশল। সেই হিসেবে হুতি মিলিশিয়ারা লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা চালাতে পারত কিংবা ইরান নিজেই হরমুজ প্রণালিতে জাহাজে হামলা করতে পারত। আর এমনটি ঘটলে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বাণিজ্যিক নৌপথ হুমকির মুখে পড়ত। কিন্তু এবার সে ধরনের কোনো হামলা হয়নি। এটা ইঙ্গিত করে যে ইরানের ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ বা এক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স দুর্বল হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে কয়েক মাস ধরে চলা যুদ্ধের কারণে তারা ক্লান্ত।
আইএসডব্লিউ তাদের ওয়েবসাইটে এমনটাই বলেছে। তবু পুরো বিশ্ব যখন ইরানের পক্ষ থেকে বড় প্রতিশোধের অপেক্ষায় ছিল, তখন সোমবার ব্রিটেনের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আনসারি আল–জাজিরাকে বলেছিলেন, তিনি মনে করেন- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর একটা পথ খোলা থাকতে পারে। বাহ্যিকভাবে অনেক হুমকি আসবে। কিন্তু পর্দার আড়ালে আলোচনা চলবে। স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যা সাতটায় ইরান কাতারের দিকে হামলা চালায়।
কাতার এ হামলাকে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক ও কাতারের সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন’ বলে নিন্দা জানায় এবং দোহায় ইরানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে। তবে বিশেষজ্ঞ আনসারির বলা ‘পর্দার আড়ালের যোগাযোগ’ সম্ভবত আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। তবে হামলা যে ইরান করবে সেটা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। এ কারণে বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে বিমান এবং লোকজন সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ফলে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে ট্রাম্পের কথাতেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, ‘আমাদের আগেভাগে জানানোয় ইরানকে ধন্যবাদ। এতে কোনো প্রাণহানি হয়নি, কেউ আহতও হননি।’ এই সতর্কতার ফলে কাতারও প্রস্তুতি নিতে পেরেছিল। তারা ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ১৩টি ভূপাতিত করে এবং ১টি ক্ষেপণাস্ত্র ‘নিরাপদ’ পথে যেতে দেয়। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র আগেই আল-উদেইদ ঘাঁটি থেকে বিমান ও কর্মীদের সরিয়ে নেয়। তাই হামলাটি প্রাণহানির দিক থেকে কম ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি বা কাতার বিমানবাহিনীর উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
হামলার তিন ঘণ্টা পর ট্রাম্প লেখেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, কোনো মার্কিন নাগরিক আহত হননি। তেমন কোনো ক্ষতিও হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, তারা (ইরান) তাদের ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলেছে।’ এর মাত্র দুই ঘণ্টা পরই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। তিনি লেখেন, ‘সবাইকে অভিনন্দন! ইসরায়েল ও ইরান পুরোপুরি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’
যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ট্রাম্প কাতারের আমিরকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘আমি কাতারের অত্যন্ত সম্মানিত আমিরকে ধন্যবাদ জানাই, যিনি এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনেক সাহায্য করেছেন।’ এখন প্রশ্ন হলো মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার পরও ট্রাম্প কেন চুপ আছেন? তিনি পাল্টা হামলা না করে যুদ্ধবিরতিতে গেলেন? এই প্রশ্নের তিনটি উত্তর হতে পারে। প্রথমত, ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি শঙ্কিত। যুদ্ধ চলতে থাকলে ইসরায়েল এক সময় শেষ হয়ে যাবে। কারণ ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের দেশটিতে ব্যাপক হামলা শুরু করে ইরান। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারি স্থাপনাতেও হামলা হয়। এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। যুদ্ধ বন্ধের দাবি জোরালো হতে থাকে। বিপুল স্যংখক মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বিভিন্ন দেশে চলে যান।
এই যুদ্ধ চলতে থাকলে গাজার মতো ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হতে ইসরায়েলের খুব একটা সময় লাগবে না। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প ইরানে হামলা চালিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছেন। যেটা উঠে এসেছে খামেনির বক্তব্যে। এ হামলায় ইরান পরমাণু চুক্তিতে যেতে বাধ্য হবেন বলে মনে করা হয়। ফলে হামলার পরও তিনি চুপ থেকেছেন। তৃতীয়ত, শান্তিতে নোবেল পাওয়ার আশা তো রয়েছেই। তিনি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ থামিয়ে দিলেন। অনেক মানুষের প্রাণ বেঁচে গেল। এ জন্য তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতেই পারেন।
লেখক: সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/এসএইচ