রেজাউল করিম
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৫ ০৭:০৩ পিএম
করিডর : খাল কেটে কুমির আনছি না তো?
কয়েক দিন ধরে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে ‘করিডর’ ইস্যু। বিভিন্ন দল বিশেষ করে বিএনপি এই করিডরের তুমুল বিরোধিতা করে আসছে। কডিরের কারণে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে- এমন আশঙ্কাও করেছেন অনেকে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার- ২৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন তার দপ্তরে সাংবাদিকদের এই কথা জানানোর পর থেকেই চলছে তুমুল আলোচনা। চায়ের দোকান থেকে রাজনীতির মঞ্চ- সব জায়গাতেই একই বিষয় ‘করিডর’।
এখন প্রশ্ন হলো মিয়ানমারকে কেন করিডর দিতে হবে? নেইপিদো কী করিডর চেয়েছে? না, চায়নি। যে রাখাইন রাজ্যে করিডর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেই রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সেখানকার নিয়ন্ত্রক। তারা কী করিডর চেয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরও ‘না’। তাহলে করিডর চাইল কে? সেই প্রশ্নের উত্তর মিলেছে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায়। তার ভাষ্য, ‘এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ) হবে।
কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’ অর্থাৎ করিডর চেয়েছে জাতিসংঘ। বিষয়টি নতুন না। এ বছরের প্রথমার্ধে রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করেছিল জাতিসংঘ। এ জন্য মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের কাছে ‘করিডর’ দেওয়ার অনুরোধ করেছিল সংস্থাটি। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা। বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তকে সাদা চোখে দেখলে বেশ ভালই মনে হবে। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলেই অন্যচিত্র বের হয়ে আসবে।
প্রথমত, মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলছে বিদ্রোহীদের। এই রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ এখন বিদ্রোহীদের হাতে (আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের তথ্য)। বিদ্রোহীদের কোণঠাসা করতে সরকার সব সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সেখানে দুর্ভিক্ষের অবস্থা বিরাজ করছে। এখন যদি বাংলাদেশ করিডর দেয়; তাহলে সেটা হবে বিদ্রোহীদের সহায়তা; যা দুই দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আবার যে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে; সেই সহায়তা রোহিঙ্গাদের হাতে পৌঁছবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। ধরেই নিতে হবে- এই ত্রাণ সামগ্রী রোহিঙ্গারা পাবেন না।
কেননা, রোহিঙ্গাদের অনেকে সরকারি বাহিনীর হয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করছে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে- এমন খবরও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। সুতরাং এই ত্রাণ সহায়তা যে রোহিঙ্গারা পাবেন না, তা নিশ্চিত। করিডর চালুর আগেই সোয়া লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।
করিডর চালু হলে সেখানে থাকা বাকি আরও লাখ দশেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসতে পারে। কারণ তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন এদেশে ক্যাম্পে রয়েছে। তারা তাদের আনার চেষ্টাও করছে। মাঝেমধ্যেই সীমান্তের ওপারে জড়ো হন রোহিঙ্গারা। দালালের মাধ্যমে তারা এ দেশে আসেন। কোনওভাবেই তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় করিডর চালু হলে রোহিঙ্গার ঢল নামবে। করিডরকে আসা-যাওয়ার পথ বলা হলেও তা মূলত আসার পথ হবে; যাওয়ার পথ নয়।
করিডর দিয়ে আরাকান আর্মি রোঙ্গিাদের এ দেশে ঠেলে দিতে পারে। আরাকান আর্মি জান্তা বাহিনীর শত্রু হলেও একটা জায়গায় তাদের মিল আছে। উভয় বাহিনীই রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে চায়। কারণ রোহিঙ্গাদের সিংহভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আর জান্তা ও আরাকান আর্মি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা মুসলমানদের সহ্য করতে পারে না। এই করিডর দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আরাকান আর্মি প্রবেশ করলে ঠেকানোর উপায় আছে?
তারা যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং অপরাধ করে ফিরে যায়, তাহলে আমাদের করার কী আছে? কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনেকে রাখাইনে গিয়ে যুদ্ধ করে অস্ত্র নিয়ে ফিরে আসছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন তো বিজিবির পাহারা আছে। তারা বাধা দিচ্ছে। তারপরও অপরাধী রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। করিডর চালু হলে রোহিঙ্গারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। এই জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশ কক্সবাজারে মাদকদ্রব্য পাচার, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই করছে। তাদের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষকে অপরহরণেরও প্রমাণ মিলেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের খুব কম মানবিক করিডরই নিরাপত্তাঝুঁকির বাইরে থেকেছে। যদিও মানবিক করিডর দেওয়া হয় সাধারণ নাগরিকদের সহায়তার জন্য। তবে এ ধরনের করিডর চালু হলে সেই অঞ্চলে থাকা বিদ্রোহী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসহ অপরাধীরা সেটাকে নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে থাকে। এ অঞ্চল বিশ্বে মাদকদ্রব্য, অবৈধ অস্ত্র পাচারসহ নানা আন্তঃসীমান্ত অপরাধের অন্যতম রুট হিসেবে পরিচিত। করিডর দিলে মাদক বা অবৈধ অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা থাকবে। এ ছাড়া মিয়ানমারের রাখাইনে বর্তমানে কোনো স্বীকৃত প্রশাসন নেই। ফলে সেখানকার অস্বীকৃতদের সঙ্গে কোনো ধরনের দর-কষাকষির আলাদা ঝুঁকি রয়েছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকি তো রয়েছেই।
বিকল্প হতে পারে সিতওয়ে: রাখাইন রাজ্যের রাজধানী হলো সিতওয়ে। কালাদান, মায়ু ও লে ম্রো নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত এটি। ২০২৩ সালের ১২ মে সেখানে নতুন পোর্ট টার্মিনাল উদ্বোধন করা হয়। ভারতের সহায়তায় এটি নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে। মানবিক করিডর অর্থাৎ ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে কিংবা বেসামরিক নাগরিকদের সেখান থেকে সরিয়ে নিতে এই বন্দর ব্যবহার করতে পারে জাতিসংঘ। ভারত ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। এসব সীমান্তকে করিডর হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দিতে জাতিসংঘ অনুরোধ করতে পারে। বাংলাদেশের মতো একটা ছোট দেশের কাছে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এতো আবদার কেন? এমনিতেই ১৩ লাখ রোহিঙ্গার চাপে বাংলাদেশ ন্যূজ¦। তাদের অনুরোধেই মিয়ানমারের বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তারা এখন আমাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু চেষ্টা তদবির করেও তাদের ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস থাইল্যান্ড সফরে গিয়ে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নেবে বলে আশ্বাস পাওয়ার কথা জানালেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখলাম? মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও নেয়নি। বরং কয়েক দিন আগে সোয়া লাখের বেশি রোহিঙ্গা এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এ তো গেল তালিকার কথা। তালিকার বাইরে কতজন এসেছে; সেই হিসাব কারো কাছে আছে? বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর খেলা বন্ধ করা উচিত। আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে। তারা যেন কিছু আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে না পারে। আমরা যেন তাদের খেলার ঘুঁটি না হই। করিডর ইস্যুতে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িত এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় (করিডর) সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিন্তু জনগণকে জানায়নি। এমনকি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও কোনো আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেনি।
দেশের জনগণকে না জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না কিংবা নেওয়া উচিত কি না, এই মুহূর্তে সে বিতর্ক আমি তুলতে চাই না। তবে দেশের স্বাধীনতা প্রিয় জনগণ মনে করে, করিডর দেওয়া না দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের কাছ থেকে, সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের মাধ্যমে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক বিশ্বের দেশে দেশে এটাই নিয়ম, এটাই রীতি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার যে ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে (করিডর ইস্যু) তাতে দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির’ মুখে পড়বে। এক্ষেত্রে সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটি ঠিক হয়নি। উচিৎ ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
এছাড়া জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদসহ প্রায় সব দলের নেতারা করিডর ইস্যুতে বিরোধিতা করছেন। এ কারণে সরকারের উচিত এখান থেকে সরে আসা। সরকারকে মনে রাখতে হবে করিডর দিয়ে যেন আমরা নতুন বিপদ ডেকে না আনি; যেমনটা আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে করেছি। লেখক: সাংবাদিক।
ভোরের আকাশ/এসএইচ