বিশেষ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৫ ১০:৩৮ এএম
সংশয়ের নেপথ্যে কী
রাখাইনের জন্য ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে অনেক প্রশ্ন, নানা আলোচনা-সমালোচনার মুখে অন্তর্বর্তী সরকার যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তাতে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো সন্তুষ্ট হতে পারেনি। সন্দেহ-অবিশ্বাস এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সংশয় কাটেনি তাদের। অন্যদিকে ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম অংশীজন সেনাবাহিনীরও ভিন্ন বক্তব্যও সামনে এসেছে।
বিশেষ করে গত বুধবার ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান গত বুধবার এ-সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, করিডর নিয়ে সরকার কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেনি এবং বলবেও না। তবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ত্রাণ সরবরাহের একটি ‘চ্যানেল বা পাথওয়ে’ তৈরির জাতিসংঘের প্রস্তাব বাংলাদেশ বিবেচনা করছে।
নিরাপত্তা উপদেষ্টার ওই বক্তব্যের পরই বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ওই বক্তব্যকে শুধু ‘কথার বা শব্দের মারপ্যাঁচ’ বলে মনে করছেন। কারণ তারা মনে করেন; ত্রাণ সরবরাহের চ্যানেল বা পাথওয়ে এবং করিডরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিষয়টাকে একইভাবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকদের অনেকে।
তাদের মতে, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে এখন দুটি পক্ষ, মিয়ানমার জান্তা সরকার এবং রাখাইনের সশস্ত্র আরাকান আর্মি। জান্তা সরকার চীনের ঘনিষ্ট। আর আরাকান আর্মিকে পশ্চিমারা মদদ দিচ্ছে। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশকে একটি অনাকাক্সিক্ষত যুদ্ধের মুখোমুখি করা হচ্ছে। ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে দেশে এখন সক্রিয় সব দল আপত্তি জানিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য অংশীজনদেরও ভিন্ন বক্তব্য আছে। ফলে এক ধরনের চাপের মুখে সরকারের পক্ষ থেকে কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হলো।
সংশয়ের নেপথ্যে কী
দেশে সক্রিয় সব রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার বিরোধিতা করে আসছে। এই বিরোধিতার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বেশি সোচ্চার। দলটির নেতারা বিভিন্ন সময় প্রকাশ্যেই এ ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছেন। গত ২৩ এপ্রিল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে গাজা বানানোর চক্রান্ত চলছে।
বিএনপির অন্য একাধিক সূত্র বলছে, সরকারের কারও কারও ব্যক্তিস্বার্থ থেকে এবং দেশের বাইরের কোনো পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সীমান্তে একটা পরিস্থিতির তৈরির চেষ্টা আছে কিনা- এ নিয়েও দলটির ভেতরে আলোচনা রয়েছে। নির্বাচনকে অগ্রাধিকার না দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কেন এ ধরনের বিষয় নিয়ে তৎপর, সেই প্রশ্নও তুলছেন বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ। সরকারের এখতিয়ার নিয়েই প্রশ্ন আছে বিএনপির। নিরাপত্তা উপদেষ্টার সর্বশেষ বক্তব্য অনুযায়ী, চ্যানেল, পাথওয়ে এবং করিডরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই বলেই বিএনপি মনে করে।
দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তারা এখনো মনে করেন যে বাংলাদেশকে একটা অনাকাক্সিক্ষত যুদ্ধের মুখোমুখি করা হচ্ছে। রাখাইনে ত্রাণ সহায়তার জন্য যখন বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবহার করা হবে, তখন জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন আসবে। কীভাবে সীমান্ত ব্যবহার হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকবেই। যেখানে জাতীয় নিরাপত্তার মতো স্পর্শকাতর বিষয় রয়েছে, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের বাংলাদেশের ভূখণ্ড কোনোভাবেই ব্যবহার করতে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। এটা তাদের দায়িত্ব হতে পারে না। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে বিএনপির সুরেই কথা বলছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামি দলগুলো এবং অন্যদিকে বামপন্থি ও উদারপন্থি কোনো দলই সরকারের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্য বা সরকারের ব্যাখ্যা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশের সীমান্ত বা ভূখণ্ড অন্য কারও ব্যবহারের প্রশ্নে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, এটাই তাদের অবস্থান। এমনকি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপিও এ বিষয়টির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সীমান্ত ব্যবহার করে ত্রাণ চ্যানেল বা পাথওয়ে হিসেবে যে ধরনের উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে, তার প্রত্যেকটা বিষয়ে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে আঁধারে রেখে এটা করা যাবে না। সীমান্ত ব্যবহারের বিষয়টা কীভাবে পরিচালিত হবে, নিরাপত্তার বিষয় কী হবে- এ ধরনের বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য তৈরি করা প্রয়োজন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবিক করিডর বা ত্রাণ সহায়তার জন্য যে সব চ্যানেল ব্যবহার হয়েছে, তার বেশির ভাগ জায়গাতেই যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ছিল বলে তারা মনে করেন। তিনি গাজা ও ইউক্রেনের উদাহরণ তুলে ধরেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটা হচ্ছে কিনা- তা খতিয়ে দেখতে হবে।
যদিও সংবাদ সম্মেলনে সংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা কোনো দিক থেকে কোনো চাপ নেই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।
ওই সংবাদ সম্মেলনে করিডর ও চ্যানেলের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, ‘মানবিক করিডর হচ্ছে একটা জরুরি সময়ে দুর্যোগপূর্ণ জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। এখানে কাউকে সরানো হচ্ছে না। যেটা করা হচ্ছে তাতে এখানে ত্রাণসামগ্রী ও উপকরণ অন্য রুটে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জাতিসংঘ আমাদের এতটুকু বলেছে, পণ্যটি বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে রাখাইনে নেওয়ার জন্য।’ কিন্তু মানবিক করিডর বা ত্রাণ সরবরাহ চ্যানেল- এই দুটোর ক্ষেত্রে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলের নেতারা কোনো পার্থক্য দেখেন না। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকদেরও একই মত। তারাও বলছেন, দেশের ভেতরে বিরোধিতা ও চাপের মুখ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্যে শুধু শব্দের পরিবর্তন করা হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের বক্তব্য অস্বচ্ছ। কারণ বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবহার করে সংঘাতময় রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা যাবে, সেখানে অবশ্যই নিরাপত্তা ঝুঁঁকি থাকবে।’
নির্বাচিত সরকার থেকেই সিদ্ধান্ত আসতে হবে : সেনাপ্রধান
মানবিক করিডর নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মতপার্থক্য হচ্ছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ও সামাজিক মাধ্যমে কয়েকদিন ধরে এমন আলাচনা চলছে। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, মানবিক সহায়তা নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের কোনো মতপার্থক্য আছে কিনা- এর জবাবে খলিরুল রহমান বলেছিলেন, ‘সেনাপ্রধানের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই।’
এর মধ্যেই গত বুধবার ঢাকা সেনানিবাসে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মানবিক করিডর, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করাসহ সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। ওই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, ঢাকা সেনানিবাসের সেনাপ্রাঙ্গণে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন সেনাপ্রধান। এতে বাহিনীটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা সরাসরি ও ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
সূত্রগুলো জানায়, ওই অনুষ্ঠানে মানবিক করিডর নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে। এখানে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। যা করার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই করতে হবে। যা-ই করা হোক না কেন, রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে সেটা হতে হবে।
চীন-ভারত কীভাবে নেবে : মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। সেখানে ভূ-রাজনীতিতে চীনের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মিয়াানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তায় বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হলে চীন ও ভারত সেটাকে কীভাবে নেবে, সেই প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে একটা ঝুঁকি থাকে।
যদিও উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, কোন পথে, কীভাবে ত্রাণ সহায়তা যেতে পারে, এসব বিষয়ে এখনো আলোচনা হয়নি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ছাড়া এ ধরনের পদক্ষেপ নেয় না। আর নিরাপত্তা কাউন্সিলে চীন রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, এমন বক্তব্যের মাধ্যমে উপদেষ্টা বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভূ-রাজনীতির কোনো প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বে না। কিন্তু তারা এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তারা ঝুঁকি দেখছেন।
বিতর্কের শুরু যেভাবে : মিয়নমারের সামরিক জান্তা সরকারের বাহিনীর সঙ্গে ২০২১ সাল থেকে বিদ্রোহীদের গৃহযুদ্ধ চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সশস্ত্র আরাকান আর্মি। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি গত বছরের নভেম্বরে রাখাইন রাজ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে- তাতে মিয়ানমারে দুর্ভিক্ষ আসন্ন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে গত মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস।
এরপর প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান মানবিক সহায়তা চ্যানেলের ব্যাপারে প্রথম ধারণা দেন। তার ওই বক্তব্যের পর গত ২৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মানবিক প্যাসেজ’ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে। কিন্তু এটাতে আমাদের কিছু শর্ত আছে, সেটার বিস্তারিততে যাচ্ছি না, সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা এটাতে অবশ্যই সহযোগিতা করব, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অবশ্যই।’
তৌহিদ হোসেনের ওই বক্তব্যের পর সর্বত্রই এই মানবিক করিডর নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক চলছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ