আব্দুর রহিম
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে রাজনীতির গতিপথ পাল্টে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করে আসছিল কিছু ছোট দল। তারা নানাভাবে সরকারের কাছ থেকে লাভবান হচ্ছিল। অন্যদিকে বিরোধীদল বলতে কিছু ছিল না। বিএনপি ২০০৯ সালের পর থেকে বিরোধী দলের আসনে থেকে সরকারের ভুল-ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা-আন্দোলন করে আসছিল। কিন্তু তাদের কঠোর হাতে দমন করে সরকার। যুক্তিতর্কের পাশাপাশি দলীয় পেটুয়া বাহিনী আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তাদের দমন করে আসছিল। মামলার ভারে ন্যুব্জ ছিল দলটির নেতাকর্মীরা। একইভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিল জামায়াতে ইসলামী। ফলে অন্য দলগুলো কেবল বিবৃতি দিয়েই দায় সারছিল। তাদের তেমন রাজপথে দেখা যায়নি। পরের সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেছিল জাতীয় পার্টি। দলটিকে অনেকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলতো। মূলত তারা সরকারেরই অংশ। কেবল নিয়ম রক্ষার জন্য তারা বিরোধী দলে বসেছিল। এসব কারণে অনেকটা বিরোধীদল বিহীনভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার দেশ শাসন করে আসছিল। এক কথায় রাজনীতি ছিল কেবল আওয়ামী ধারার।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর থেকে রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন আসতে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। সেই নির্বাহী আদেশ সরকার তুলে নেয়। ফলে প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পায় জামায়াত-শিবির। সন্ত্রাসী তালিকায় থাকা হিযবুত তাহরীরও প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু এই সময়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ঝিমিয়ে পড়ে। তাদের কার্যক্রম চোখে পড়ে না। মাঝেমধ্যে ঝটিকা মিছিল করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু জাতীয় পার্টি একেবারে চুপ হয়ে যায়। এখনও তাদের কার্যক্রম নেই। কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকার।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের জোরালো দাবি উঠে। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে পরে শাহবাগ অবরোধ করে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বে দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। পরে জামায়াত-শিবিরসহ আরও কিছু দল এতে অংশ নেয়। একপর্যায়ে সরকার আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করে। এ নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। দলটি কার্যত নিষিদ্ধ হওয়ায় কার লাভ হলো কিংবা কার লোকসান হলো- এই হিসাবনিকাশও চলছে। রাজনীতির মোড় কোন দিকে ঘুরছে বা কী ধরনের মেরুকরণ হচ্ছে, সেই প্রশ্নও উঠছে?
লাভ-লোকসানের হিসাবনিকাশের আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে সক্রিয় দলগুলোর মধ্যে লাভের খাতায় নাম আসছে বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনে নিয়ন্ত্রণ ছিল এনসিপি এবং জামায়াতসহ ইসলামপন্থী বিভিন্ন দল ও সংগঠনের হাতে। অন্যতম প্রধান দল বিএনপি সেই আন্দোলনে অংশ নেয়নি। যদিও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে, এরপর সেই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন ‘তারা আনন্দিত’।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে বিভিন্ন সময় বিএনপি নেতাদের বক্তব্য ছিল, তারা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নন। ফলে শেষ পর্যন্ত দলটির দোটানা অবস্থান ছিল বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন। তবে রাজনীতির সমীকরণ, লাভ-ক্ষতির আলোচনা যাই হোক না কেন- এমন পটভূমিতে নির্বাচন কবে হবে, সেই প্রশ্নে সন্দেহ বেড়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলে। এমনকি এই দলগুলোর নেতাদের অনেকে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথাও বলছেন। রাজনীতিকদের কেউ কেউ বলছেন, বিরাজনীতিকরণের কোনো চেষ্টা হচ্ছে কি না, তাদের মধ্যে এখন এই প্রশ্নেও আলোচনা হচ্ছে।
নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় আওয়ামী লীগ যেহেতু নির্বাচন করতে পারবে না, সে প্রেক্ষাপটে বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী একজন কমলো। সেটিই বিএনপির জন্য লাভের বিষয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থীদের লাভের অঙ্ক ভারী হয়েছে। কারণ এসব দল ও সংগঠন গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার শাসনের পতনের পর থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করে আসছিল। এখন তাদের আন্দোলনের মুখে দাবি পূরণ হলো।
এছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসব দলের প্রভাব নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা আলোচনা ছিল। এখন আওয়ামী লীগ কার্যত নিষিদ্ধ হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার ও পরিস্থিতির ওপর এনসিপি এবং জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দল ও সংগঠনের প্রভাবের বিষয়টা আবার সামনে এসেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে এসব দল ও সংগঠনের লাভের খতিয়ানেও তারতম্য আছে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন। তাদের মতে, এই আন্দোলন শুরু করেছিল এনসিপি।
কিন্তু জামায়াতসহ ইসলামপন্থীদের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল। এর প্রমাণ হিসেবে শাহবাগের অবস্থান কর্মসূচিতে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধা দেওয়া এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার হওয়া জামায়াতের নেতা গোলাম আজম ও মতিউর রহমান নিজামীর নামে স্লোগান দেওয়ার ঘটনাগুলোও উল্লেখ করেন বিশ্লেষকরা। ওই ঘটনাগুলো এনসিপিকে বিতর্কের মুখে ফেলেছে।
যদিও দলটি বিবৃতি দিয়ে এর দায় অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, যারা এ ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে দায় তাদের। লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে যেখানে কিছুদিন আগে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন এলাকায় পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে আন্দোলনকারীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। সরকারের প্রশ্রয় সেখানে স্পষ্ট হয়েছে।
এদিকে, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবির ক্ষেত্রে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকে বলে আসছিলেন, তারা দল নিষিদ্ধের পক্ষে নন। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার হচ্ছে, সেই বিচারে বা আদালতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে ছিল বিএনপি। এছাড়া জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে, দলটির নেতারা এমন বক্তব্যও দিয়ে আসছিলেন।
শেষ পর্যন্ত এনসিপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের আন্দোলনের মুখে যে প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে, সেই প্রক্রিয়া নিয়েও বিএনপি নেতাদের অনেকে আপত্তি ছিল। তারা মনে করেন, ওই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার বা বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ আছে। তবে সেই আন্দোলনে অংশ না নিলেও বিএনপি পরে সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছে। সংস্কার ও নির্বাচনের সময়সহ বিভিন্ন ইস্যুতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে বিভক্তি দৃশ্যমান হচ্ছিল কিছুদিন ধরে। এখন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে সেই বিভক্তির জায়গায় পক্ষগুলো আবার এক হয়েছে বলে দাবি করছে এনসিপি।
দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ভাষ্য, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সব অংশীজন বা সব দলের ঐক্য একটা পরিণতি পেলো আওয়ামী লীগ ইস্যুতে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটা বার্তাও গেলো। এটিই লাভের বিষয় বলে মনে করেন তিনি। আলোচনায় আছে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক। আওয়ামী লীগের ভোট বিএনপি-কে বাদ দিয়ে অন্য কোনো দলের পক্ষে যায় কি না, এটি বিএনপির জন্য চিন্তার বিষয় হতে পারে। আবার বিএনপির বাক্সেই ওই ভোট যায় কি না, জামায়াত ও এনসিপির এই বিপরীত চিন্তা রয়েছে।
এছাড়া এই দলগুলো আওয়ামী লীগের ভোট নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করবে, তাদের দিক থেকেই এমন ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন। এসব দলের পক্ষ থেকে কখনো বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়াতে আলাদা নির্বাচনি জোট করার চেষ্টা আলোচনায় আসছে। আবার এনসিপিসহ এসব দল বিএনপির সঙ্গেই নির্বাচনে আসন সমঝোতার প্রশ্নে আলোচনা চালাচ্ছে বলেও জানা যাচ্ছে। তবে রাজনীতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে- এই প্রশ্নের জবাব দৃশ্যমান হতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
সংশ্লিষ্ট
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে রাজনীতির গতিপথ পাল্টে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করে আসছিল কিছু ছোট দল। তারা নানাভাবে সরকারের কাছ থেকে লাভবান হচ্ছিল। অন্যদিকে বিরোধীদল বলতে কিছু ছিল না। বিএনপি ২০০৯ সালের পর থেকে বিরোধী দলের আসনে থেকে সরকারের ভুল-ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা-আন্দোলন করে আসছিল। কিন্তু তাদের কঠোর হাতে দমন করে সরকার। যুক্তিতর্কের পাশাপাশি দলীয় পেটুয়া বাহিনী আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তাদের দমন করে আসছিল। মামলার ভারে ন্যুব্জ ছিল দলটির নেতাকর্মীরা। একইভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিল জামায়াতে ইসলামী। ফলে অন্য দলগুলো কেবল বিবৃতি দিয়েই দায় সারছিল। তাদের তেমন রাজপথে দেখা যায়নি। পরের সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেছিল জাতীয় পার্টি। দলটিকে অনেকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলতো। মূলত তারা সরকারেরই অংশ। কেবল নিয়ম রক্ষার জন্য তারা বিরোধী দলে বসেছিল। এসব কারণে অনেকটা বিরোধীদল বিহীনভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার দেশ শাসন করে আসছিল। এক কথায় রাজনীতি ছিল কেবল আওয়ামী ধারার।গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর থেকে রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন আসতে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। সেই নির্বাহী আদেশ সরকার তুলে নেয়। ফলে প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পায় জামায়াত-শিবির। সন্ত্রাসী তালিকায় থাকা হিযবুত তাহরীরও প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু এই সময়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ঝিমিয়ে পড়ে। তাদের কার্যক্রম চোখে পড়ে না। মাঝেমধ্যে ঝটিকা মিছিল করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু জাতীয় পার্টি একেবারে চুপ হয়ে যায়। এখনও তাদের কার্যক্রম নেই। কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকার। সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের জোরালো দাবি উঠে। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে পরে শাহবাগ অবরোধ করে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বে দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। পরে জামায়াত-শিবিরসহ আরও কিছু দল এতে অংশ নেয়। একপর্যায়ে সরকার আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করে। এ নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। দলটি কার্যত নিষিদ্ধ হওয়ায় কার লাভ হলো কিংবা কার লোকসান হলো- এই হিসাবনিকাশও চলছে। রাজনীতির মোড় কোন দিকে ঘুরছে বা কী ধরনের মেরুকরণ হচ্ছে, সেই প্রশ্নও উঠছে?লাভ-লোকসানের হিসাবনিকাশের আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে সক্রিয় দলগুলোর মধ্যে লাভের খাতায় নাম আসছে বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনে নিয়ন্ত্রণ ছিল এনসিপি এবং জামায়াতসহ ইসলামপন্থী বিভিন্ন দল ও সংগঠনের হাতে। অন্যতম প্রধান দল বিএনপি সেই আন্দোলনে অংশ নেয়নি। যদিও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে, এরপর সেই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন ‘তারা আনন্দিত’।আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে বিভিন্ন সময় বিএনপি নেতাদের বক্তব্য ছিল, তারা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নন। ফলে শেষ পর্যন্ত দলটির দোটানা অবস্থান ছিল বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন। তবে রাজনীতির সমীকরণ, লাভ-ক্ষতির আলোচনা যাই হোক না কেন- এমন পটভূমিতে নির্বাচন কবে হবে, সেই প্রশ্নে সন্দেহ বেড়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলে। এমনকি এই দলগুলোর নেতাদের অনেকে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথাও বলছেন। রাজনীতিকদের কেউ কেউ বলছেন, বিরাজনীতিকরণের কোনো চেষ্টা হচ্ছে কি না, তাদের মধ্যে এখন এই প্রশ্নেও আলোচনা হচ্ছে।নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় আওয়ামী লীগ যেহেতু নির্বাচন করতে পারবে না, সে প্রেক্ষাপটে বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী একজন কমলো। সেটিই বিএনপির জন্য লাভের বিষয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থীদের লাভের অঙ্ক ভারী হয়েছে। কারণ এসব দল ও সংগঠন গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার শাসনের পতনের পর থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করে আসছিল। এখন তাদের আন্দোলনের মুখে দাবি পূরণ হলো। এছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসব দলের প্রভাব নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা আলোচনা ছিল। এখন আওয়ামী লীগ কার্যত নিষিদ্ধ হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার ও পরিস্থিতির ওপর এনসিপি এবং জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দল ও সংগঠনের প্রভাবের বিষয়টা আবার সামনে এসেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে এসব দল ও সংগঠনের লাভের খতিয়ানেও তারতম্য আছে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন। তাদের মতে, এই আন্দোলন শুরু করেছিল এনসিপি। কিন্তু জামায়াতসহ ইসলামপন্থীদের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল। এর প্রমাণ হিসেবে শাহবাগের অবস্থান কর্মসূচিতে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধা দেওয়া এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার হওয়া জামায়াতের নেতা গোলাম আজম ও মতিউর রহমান নিজামীর নামে স্লোগান দেওয়ার ঘটনাগুলোও উল্লেখ করেন বিশ্লেষকরা। ওই ঘটনাগুলো এনসিপিকে বিতর্কের মুখে ফেলেছে। যদিও দলটি বিবৃতি দিয়ে এর দায় অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, যারা এ ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে দায় তাদের। লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে যেখানে কিছুদিন আগে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন এলাকায় পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে আন্দোলনকারীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। সরকারের প্রশ্রয় সেখানে স্পষ্ট হয়েছে। এদিকে, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবির ক্ষেত্রে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকে বলে আসছিলেন, তারা দল নিষিদ্ধের পক্ষে নন। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার হচ্ছে, সেই বিচারে বা আদালতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে ছিল বিএনপি। এছাড়া জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে, দলটির নেতারা এমন বক্তব্যও দিয়ে আসছিলেন। শেষ পর্যন্ত এনসিপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের আন্দোলনের মুখে যে প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে, সেই প্রক্রিয়া নিয়েও বিএনপি নেতাদের অনেকে আপত্তি ছিল। তারা মনে করেন, ওই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার বা বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ আছে। তবে সেই আন্দোলনে অংশ না নিলেও বিএনপি পরে সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছে। সংস্কার ও নির্বাচনের সময়সহ বিভিন্ন ইস্যুতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে বিভক্তি দৃশ্যমান হচ্ছিল কিছুদিন ধরে। এখন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে সেই বিভক্তির জায়গায় পক্ষগুলো আবার এক হয়েছে বলে দাবি করছে এনসিপি। দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ভাষ্য, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সব অংশীজন বা সব দলের ঐক্য একটা পরিণতি পেলো আওয়ামী লীগ ইস্যুতে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটা বার্তাও গেলো। এটিই লাভের বিষয় বলে মনে করেন তিনি। আলোচনায় আছে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক। আওয়ামী লীগের ভোট বিএনপি-কে বাদ দিয়ে অন্য কোনো দলের পক্ষে যায় কি না, এটি বিএনপির জন্য চিন্তার বিষয় হতে পারে। আবার বিএনপির বাক্সেই ওই ভোট যায় কি না, জামায়াত ও এনসিপির এই বিপরীত চিন্তা রয়েছে। এছাড়া এই দলগুলো আওয়ামী লীগের ভোট নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করবে, তাদের দিক থেকেই এমন ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন। এসব দলের পক্ষ থেকে কখনো বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়াতে আলাদা নির্বাচনি জোট করার চেষ্টা আলোচনায় আসছে। আবার এনসিপিসহ এসব দল বিএনপির সঙ্গেই নির্বাচনে আসন সমঝোতার প্রশ্নে আলোচনা চালাচ্ছে বলেও জানা যাচ্ছে। তবে রাজনীতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে- এই প্রশ্নের জবাব দৃশ্যমান হতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
আমরা এখন প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প বিপ্লবের যুগে এসে প্রতীয়মান। যেখানে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এবং আর্থিক সাফল্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তুঙ্গে, সেখানে একাডেমিক বা পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি মানুষ হওয়ার শিক্ষার্জন অনেকটা অবহেলিত বলা চলে। কিন্তু কথা হচ্ছে জীবনে সত্যিকারের সফল ও স্বার্থক হয়ে পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে হলে কি শুধুমাত্র উপার্জন বা পেশাগত দক্ষতা অর্জনই আমাদের জন্য যথেষ্ট? সামাজিক জীব হিসেবে একজন মানুষের পেশাগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি মানবিক গুণাবলি অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। তবে এই শিক্ষিত সমাজের যেন এদিকে রয়েছে চরম অনীহা। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে এ ধরনের তথাকথিত শিক্ষিত লোকের সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। ছাত্রজীবন থেকে যাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো ভালো একাডেমিক রেজাল্ট অর্জনের মাধ্যমে ভালো বা বড় কোন চাকরি প্রাপ্তি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ (বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুষদ) থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা অনেক ছাত্ররাও বিএটি-তে চাকরির স্বপ্ন দেখছে, অন্যরা দেখছে বিসিএস সহ অন্যান্য চাকরির স্বপ্ন। সংগত কারণেই আমাদের দেশে কোনো ইলন মাস্ক, আইনস্টাইন তৈরি তো হয়ই না বরং বেকারত্বের হার বাড়ে। বেকারত্বের তালিকায় শুধু তারাই স্থান পায় যারা ৭ দিনে ১ ঘন্টাও কাজ করেন না তবে কাজ পেলে করতে আগ্রহী এবং যারা ৩০ দিনে বেতন, মজুরি বা কোনো মুনাফার বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজ খুঁজছেন এবং এরা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। পরবর্তীতে দেখা যায় এরা দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্থ হয়ে বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে, না হয় কোনো সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। আর যারা পেশাগত সফলতা পায় তারা অর্থ উপার্জনের নেশায় এমনভাবে মত্ত হয়ে পরে যে, তাদের এই উপার্জনের খেলার কাছে মানবিকতাও হার মেনে যায়।অন্যদিকে আবার দেশের অভ্যন্তরে দুই একটি নয়- হাজার হাজার যৌন নির্যাতন, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতাসহ সমাজের নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকান্ডে শিক্ষিত লোকেরা জড়িত হচ্ছে যেগুলো আগে অশিক্ষিত বা মূর্খ লোকদের কর্মকান্ড বলে বিবেচিত হত। অথচ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের পরিশোধিত হওয়ার কথা ছিলো। বিবেকবোধ ও জ্ঞানের সমন্বয়ে একজন দেশপ্রেমিক ও মানবিক চরিত্রবান মানুষ সৃষ্টিইতো ছিলো শিক্ষার উদ্দেশ্য কিন্তু বাস্তবতা তার থেকে অনেকটাই উল্টো। কারণ আমরা মানুষ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণে নারাজ, উপার্জনের বিদ্যা শিখতে মরিয়া। বাংলাতে একটা কথা আছে যে, পানি ছাড়া জাহাজ চলেনা কিন্তু সেই পানি যদি জাহাজের উপরে উঠে তাহলে জাহাজই ডুবে যায় সুতরাং পানি যেন জাহাজের নিচেই থাকে। ঠিক তেমনি মানুষের জীবন ধারণের জন্য পেশাগত দক্ষতা বা উপার্জনের বিদ্যা শেখার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই রয়েছে কিন্তু কোনভাবেই যেন সেটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধকে ছাড়িয়ে না যায়। অন্যথায়, শুধু সংখ্যাগত দিক দিয়েই শিক্ষিত মানুষ বাড়বে এবং প্রকৃত মানুষ তৈরি হবেনা।আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন। কেননা এটি প্রকৃত মানুষ তৈরির সবচেয়ে বড় উপযুক্ত মাধ্যম। আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে এমন এক কার্যকরী শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যেখানে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটিয়ে একজন মানুষকে যোগ্য মানুষে রূপান্তর করা যায় এবং কেবলমাত্র চাকরি বা ব্যবসাই নয় বরং কিভাবে একজন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হওয়া যায় সে শিক্ষাও প্রদান করা হবে। এমন শিক্ষাতেই যেন আমরা শিক্ষিত হই, যে শিক্ষায় একজন ব্যক্তির আত্মোন্নয়ন, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক দায়িত্ব, সহানুভূতি ও সৃজনশীলতা গড়ে ওঠে। সাধারণত, পরিবারই মানুষের জীবনচরিতের মূল ভিত্তি। পরিবারে ছোটবেলা থেকে শিক্ষা, স্নেহ এবং সহানুভূতির পরিবেশ একজন ব্যক্তির চরিত্রের বিকাশ ঘটাতে সহায়ক তাই সন্তানকে শুধুমাত্র পেশাগতভাবে সফল হওয়ার দিকে নয়, বরং মানবিক দিক দিয়ে যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা প্রদানের কাজটাও পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। কেননা সামাজিক দায়িত্ববোধও কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন না করলে আমাদের সমাজে ধীরে ধীরে ক্ষত সৃষ্টি হবে ও দুর্গন্ধ তৈরি হবে। সৃষ্টি হবে নানা রকম ক্ষতিকর রোগ-জীবাণু (সামাজিক অপরাধ)। আর এই রোগে আক্রান্ত হবে সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। সমাজের প্রতি সহানুভূতি, অন্যের দুঃখে দুঃখিত হওয়া এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে কাজ করা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলো একজন মানুষের প্রকৃত শিক্ষা ও মানবিকতার ধারক। সমাজের কল্যাণে কাজ করা এবং অন্যদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা একজন মানুষকে শুধুমাত্র ভালো নাগরিকই নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে এবং প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মানুষেরাই কেবল পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সুস্থ সমাজ উপহার দিতে পারে। আমরা এখন প্রযুক্তি নির্ভর যুগে আছি। প্রযুক্তি ও যন্ত্রের সাথে থাকতে থাকতে মানুষের জীবন-যাপনও অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে সাথে আমাদের অনুভূতিও যান্ত্রিকতায় রূপ নিচ্ছে। এমতাবস্থায় এই যান্ত্রিকতার মাঝে মানবিকতা ও মূল্যবোধের জায়গা করে নেওয়াটা দুষ্কর একটি কাজ। যেখানে প্রতিনিয়তই প্রযুক্তি এবং উপার্জনের পেছনে ছুটে চলা মানুষদের সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে মুল্যবোধের শিক্ষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। মুল্যবোধের শিক্ষা আমাদের মনে শান্তি, ধৈর্য্য এবং সহিষ্ণুতা আনতে সাহায্য করে। এটি আমাদের আত্মবিশ্বাসী, সৎ এবং নির্লোভ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। মানুষ হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হলো নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। এগুলো ছাড়া আমাদের সমাজ বা মানবিক সম্পর্ক কোনোভাবেই টিকবে না। সৃজনশীল সাহিত্য সাময়িকী ‘রূপান্তর’ সূচনা সংখ্যায় প্রকাশিত ‘শুদ্ধাচার’ নামক গবেষণামূলক প্রবন্ধটি থেকে জানা যায়, একজন মানুষকে যোগ্য মানুষ হতে হলে অন্তত ২৪১ টি ইতিবাচক গুণাবলী অর্জন ও ১৭৬ টি নেতিবাচক গুণাবলী বর্জন করা উচিত। কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা প্রকৃতপক্ষে অনুধাবনই করতে পারেন না যে, একজন মানুষের জন্য এ মানবিক গুণাবলীসমূহ কতোটা প্রয়োজন। সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং অন্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, মিথ্যাচার বা প্রতারণা থেকে দূরে থাকা, সমাজের নৈতিক দায়িত্ব পালন করা এসব গুণাবলী আমাদের মানসিক শান্তি প্রদান করে ও অবসাদমুক্ত রাখে এবং পাশাপাশি একটি বিকৃত মস্তিষ্ক সৃষ্টিতে বাঁধা দেয়।অবশ্যই, জীবনে চলার পথে উপার্জন বা পেশাগত সাফল্য প্রয়োজন। কিন্তু যদি সেই উপার্জন আমাদের মানবিক গুণাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তবে তা এক সময় ব্যক্তির আত্মসন্তুষ্টি এবং সুখের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। একজন প্রকৃত সুখী মানুষ হতে হলে শুধু অর্থ উপার্জনই নয়, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনও জরুরি। এবার কথা হচ্ছে, কীভাবে আমরা মানুষ হওয়ার শিক্ষা অর্জন করতে পারি? আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে এবং প্রতিটি আচরণে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। আমরা যদি শুধুমাত্র উপার্জনের জন্য দৌঁড়াতে থাকি এবং মানবিকতা ভুলে যাই, তাহলে সেই উপার্জন কখনোই আমাদের মানসিক সুখ ও আত্মতৃপ্তি এনে দিতে পারবে না। তাই, প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য প্রথমে নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করা সবার আগে জরুরি যেটা পরিবার থেকে নিশ্চিত করতে হবে। কেননা প্রতিটি ধর্মেই এমন কিছু নৈতিক শিক্ষা থাকে যা আমাদের ইতিবাচক আত্মগঠন ও মূল্যবোধ তৈরির মূল সহায়ক। তারপর ইচ্ছানুসারে পেশাগত দক্ষতা অর্জন, তাহলে এটি আমাদের পরিবার, সমাজ, ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পরিপূর্ণতা আনতে সহায়তা করবে বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি আমাদের মানবিক গুণাবলীসমূহ সম্পর্কে জানতে হবে এবং সেগুলো বাস্তবজীবনে বেশি বেশি প্রয়োগ করতে হবে।যেহেতু নশ্বর পৃথিবীতে স্বল্প সময়ের জন্য সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আগমন করে আবার অচিরেই বিদায় নিতে হবে সুতরাং শুধুমাত্র উপার্জনের বিদ্যা নয়, মানুষ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মনুষ্যত্ব অর্জন করে মানবিক কাজের মাধ্যমে স্থায়ী ছাপ রেখে যাওয়াটাই শ্রেয়! অন্যথায় ষোলো আনাই বৃথা।লেখক-এস এম নুর ইসলামসম্পাদক, রূপান্তর সাহিত্য সাময়িকীভোরের আকাশ/ হ.র
বাংলাদেশের আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামোকে “পর্ব ১ - বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিকাশ এবং এর প্রভাব: একটি উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পথে অগ্রযাত্রা, এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে সকল প্রতিবন্ধকতাসমূহ অতিক্রম করা প্রয়োজনীয়” শীর্ষক প্রবন্ধে বর্ণিত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে, একটি সমন্বিত সাংবিধানিক সংশোধন এবং আইনগত সংস্কার প্রয়োজন। এই পরিবর্তনগুলোর লক্ষ্য হলো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা।নিচে সংস্কারগুলির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তাবনাসমূহ বিস্তারিত এবং কালক্রমিক আকারে প্রদান করা হল:১. গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শক্তিশালীকরণ এবং নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারঅনুচ্ছেদ ৫৬ [মন্ত্রীগন]: কার্যকাল সীমিতকরণ এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের উন্নয়ন অনুচ্ছেদ ৫৬ সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রীর এবং রাষ্ট্রপতির মেয়াদকাল সীমিত করা। নির্বাহী, আইন প্রণয়নকারী এবং বিচার বিভাগীয় শাখার মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য শক্তিশালী ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, যাতে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ রোধ করা যায় এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।অনুচ্ছেদ ৫৭ [প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ]: নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা বৃদ্ধি অনুচ্ছেদ ৫৭-এ নির্বাচন কমিশনকে অধিক ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রদান করে আরও শক্তিশালী করা। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী অর্থায়ন ও রাজনৈতিক দলগুলির অর্থায়নের জন্য স্পষ্ট নির্দেশিকা, যাতে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়।অনুচ্ছেদ ৫৯ [স্থানীয় শাসন] এবং ৬০ [স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা]: স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণ অনুচ্ছেদ ৫৯ এবং ৬০ সংশোধন করে স্থানীয় সরকারকে আরও কর্তৃত্ব ও সম্পদ প্রদানের ব্যবস্থা করা। এই বিকেন্দ্রীকরণ সরকারি কার্যক্রমে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বাড়াবে এবং জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ কমাবে। ধারা ৬৫ [সংসদ-প্রতিষ্ঠা]: আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় রূপান্তর ধারা ৬৫ সংশোধন করে বর্তমানে প্রচলিত First-Past-The-Post (FPTP) বা বিজয়ীর সমস্ত পাওয়া (বিসপা, যা ইংরেজিতে Winner Takes All) পদ্ধতির পরিবর্তে সংসদের সদস্যদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা Proportional Representation (PR) ব্যবস্থার ভিত্তিতে নির্বাচন করা। এই সংশোধনীতে প্রতিটি দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী আসন বরাদ্দের পদ্ধতিটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।ধারা ৬৬ [সংসদে নির্বাচিত হইবার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা]: আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার প্রতিফলন ধারাটিতে উল্লেখিত যোগ্যতার অন্যান্য মানদণ্ড অপরিবর্তিত রেখে, ধারা ৬৬ সংশোধন করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার ভিত্তিতে নির্বাচন পরিচালনার উল্লেখ করা, যাতে যোগ্যতার মানদণ্ড একটি আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রযোজ্য হয়।ধারা ১১৯ [নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব]: আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বাস্তবায়ন ধারা ১১৯ সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার ভিত্তিতে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা। এই সংশোধনীতে কিভাবে ভোট গণনা করা হবে, কিভাবে আসন বরাদ্দ করা হবে এবং আনুপাতিক বরাদ্দ সংক্রান্ত বিরোধগুলো কিভাবে সমাধান করা হবে তার নির্দেশাবলী অন্তর্ভুক্ত করা।ধারা ১২২ [ভোটার তালিকায় নামভুক্তির যোগ্যতা]: আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব সহায়ক ধারা ধারা ১২২-এ সংশোধনী যুক্ত করে নিশ্চিত করা যেতে পারে যে ভোটার নিবন্ধন প্রক্রিয়া ও ভোটদান পদ্ধতিগুলি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বাস্তবায়নকে সহায়তা করে।ধারা ১২৩ [নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়]: নির্বাচন সময়সূচী অভিযোজন ধারা ১২৩ সংশোধন করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সময়সূচী ও প্রক্রিয়াগুলি প্রতিফলিত করা, যার মধ্যে দীর্ঘতর বা আরও জটিল গণনা প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হতে পারে।ধারা ১২৫ [নির্বাচনী আইন ও নির্বাচনের বৈধতা]: আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন ধারা ১২৫ সংশোধন করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন অন্তর্ভুক্ত করা, যার মধ্যে দলীয় তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া, ভোট গণনা পদ্ধতি এবং আসন বরাদ্দের সূত্র অন্তর্ভুক্ত রাখা।আইনগত পরিবর্তনসমূহ নির্বাচনী আইন সংস্কার নির্বাচনী আইনে ব্যাপক সংশোধন প্রবর্তন করে মুক্ত, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করা। এর মধ্যে একটি স্বাধীন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা গঠন অন্তর্ভুক্ত, যার শক্তিশালী ক্ষমতা থাকবে নির্বাচনী স্বচ্ছতা রক্ষা এবং নির্বাচন সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তিতে কার্যকর ভূমিকা রাখার।রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক দলগুলিকে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হতে বাধ্য করার জন্য আইন প্রয়োগ করা। এর মধ্যে দলীয় অভ্যন্তরীণ নির্বাচন স্বচ্ছভাবে পরিচালনা, আর্থিক জবাবদিহিতা এবং দলের মধ্যে স্বৈরাচারী প্রবণতা প্রতিরোধের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত রাখা।বিশেষ পরিবর্তনসমূহ অনুচ্ছেদ ১১৯ [নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব] এবং ১২০ [নির্বাচন কমিশনের কর্মচারীগণ]: স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করার জন্য সংবিধান সংশোধন করা, যাতে স্থানীয় পর্যায়ে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় এবং জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হ্রাস করা যায়।অনুচ্ছেদ ৭০ [পদত্যাগ ইত্যাদি কারণে আসন শূন্য হওয়া]: এমপিদের দলীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে নিজের বিবেক অনুযায়ী ভোট প্রদান করার সুযোগ রেখে সংবিধান সংশোধন করা, যাতে দলীয় আধিপত্য কমে।২. মিথ্যা তথ্যের মোকাবিলা এবং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাঅনুচ্ছেদ ৩৯ [চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা]: গণমাধ্যমের স্বাধীনতার স্পষ্ট সুরক্ষা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে অনুচ্ছেদ ৩৯ সংশোধন করা। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং তাদের হয়রানি ও সহিংসতা থেকে রক্ষা করার জন্য আইন প্রয়োগ করা।তথ্যের স্বচ্ছতা এবং নিয়ন্ত্রণ সরকারি কার্যক্রমগুলিতে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তথ্যের সত্যতা এবং স্বচ্ছতা বাধ্যতামূলক করতে অনুচ্ছেদ ৩৯-এ বিধান সংযোজন করা। একটি স্বাধীন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা যা গণমাধ্যমের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করবে, যাতে সঠিক ও নিরপেক্ষ তথ্য প্রচার নিশ্চিত হয়।আইনগত পরিবর্তনসমূহ তথ্য অধিকার আইন শক্তিশালীকরণ তথ্য অধিকার আইন (২০০৯) শক্তিশালী করা যাতে সরকারি তথ্য আরও সহজলভ্য হয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকারি কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা এবং তথ্যের অসঙ্গতি রোধে কঠোর শাস্তির বিধান প্রবর্তন করা।ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে ভারসাম্যপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা, যাতে বাকস্বাধীনতা লঙ্ঘিত না হয়। প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে তথ্য প্রচারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং ভুয়া খবরের বিরুদ্ধে আইনি কাঠামো তৈরি করা।গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন মিথ্যা তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করা, কিন্তু একইসাথে বাকস্বাধীনতার সুরক্ষা নিশ্চিত করা। যাতে করে এই আইনগুলি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতাকে সমর্থন করে, সঠিক তথ্য প্রদান এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।৩. সাক্ষরতা হার বৃদ্ধি এবং শিক্ষা সংস্কারঅনুচ্ছেদ ১৭ [অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা]: শিক্ষার অধিকার জোরদারকরণ অনুচ্ছেদ ১৭ সংশোধন করে সর্বজনীন মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে সজাগ অংশগ্রহণে সহায়তা করার জন্য সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা অর্জন, গণমাধ্যম জ্ঞানসম্পন্ন সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নাগরিক শিক্ষা জোরদার করা। অনুচ্ছেদ ১৫ [মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা]: শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার অনুচ্ছেদ ১৫ সংশোধন করে শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক অধিকার সুনিশ্চিত করা। অর্থনৈতিক নীতিগুলি শিক্ষার ক্ষেত্রে সকলের প্রবেশাধিকার ও শিক্ষার উন্নত মান নিশ্চিতে সহযোগিতা করবে, যাতে বিভিন্ন অঞ্চল ও সামাজিক-অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষাগত বৈষম্য দূরীভূত হয়।আইনগত পরিবর্তনসমূহ শিক্ষা আইন মানসম্মত শিক্ষায় প্রবেশাধিকার, পাঠ্যক্রম সংস্কার এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে একটি সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রণয়ন করা। শহর ও গ্রামীণ এলাকায় এবং বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষাগত ব্যবধান দূর করার ওপর জোর দেওয়া।পাঠ্যক্রম সংস্কার আইন বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার এবং গণমাধ্যম জ্ঞান সচেতনতা বিষয়ক কোর্স অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আইন প্রণয়ন করা। এই সংস্কারগুলি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তা এবং নাগরিক অংশগ্রহণ বিকাশের লক্ষ্যে গৃহীত হবে।নীতিগত উদ্যোগ পাঠ্যক্রম পরিবর্তন শিক্ষা পাঠ্যক্রম সংশোধন করে সমালোচনামূলক চিন্তা, নাগরিক শিক্ষা এবং গণমাধ্যম জ্ঞানসম্পন্ন হওয়ার উপর জোর দেওয়া। শিক্ষার জন্য ব্যবহৃত সরঞ্জামাদির সরবরাহ ও সম্পদের উপর সকল অঞ্চলের সকল শিক্ষার্থীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করা। শিক্ষাঙগণে আকর্ষণীয় শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে তার নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে শিক্ষা পাঠ্যক্রমে ‘বাংলাদেশের সংবিধান’কে বাধ্যতামূলকভাবে সংযোজিত করা।শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তা এবং নাগরিক অংশগ্রহণকে উন্নত ও উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষকদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া।৪. অর্থনৈতিক সংস্কার এবং সামাজিক ন্যায্যতাঅনুচ্ছেদ ১৫ [মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা]: অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের অন্তর্ভুক্তি অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার এবং সাম্যতার নীতিগুলি অন্তর্ভুক্ত করতে অনুচ্ছেদ ১৫ সংশোধন করা। অর্থনৈতিক নীতিমালাগুলি আয়ের বৈষম্য মোকাবিলা করবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে, যাতে সামাজিক কল্যাণকে একটি সাংবিধানিক অধিকার হিসাবে নিশ্চিত করা যায়।আইনগত পরিবর্তনসমূহ প্রগতিশীল কর আইন অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যে প্রগতিশীল কর আইন প্রণয়ন করা। এই আইনের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তি এবং কর্পোরেশন থেকে কর রাজস্ব বৃদ্ধি করে জনসেবা এবং সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচিতে ব্যয় করা।সামাজিক কল্যাণ আইন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচি সম্প্রসারণে আইন প্রণয়ন করা। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য লক্ষ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহন করা।নীতিগত উদ্যোগসমূহ সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচির সম্প্রসারণ প্রান্তিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষার মতো সামগ্রিক সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করার মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচির সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ নিশ্চিত করা। এতে প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা এবং লক্ষ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক সহায়তা উদ্যোগের বাস্তবায়ন অন্তর্ভুক্ত রাখা।৫. দুর্নীতি দমন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণদুর্নীতি দমন সংস্থার ক্ষমতাবৃদ্ধি দুর্নীতি দমন সংস্থার ক্ষমতা ও স্বাধীনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এসব সংস্থাকে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকরী তদন্ত ও বিচার কার্য সম্পাদনের জন্য আরও অধিক ক্ষমতা, সম্পদ, এবং সুরক্ষা প্রদান করা।স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা। সরকারী ব্যয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়মিতভাবে জনগণের কাছে প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক করা।আইনগত পরিবর্তনসমূহ দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ক্ষমতা বৃদ্ধি দুর্নীতি দমন কমিশন আইনকে আরও শক্তিশালী করা, কমিশনকে আরও স্বায়ত্তশাসন ও সম্পদ প্রদান করা। দুর্নীতি প্রতিরোধে তদন্ত ও বিচার কার্যক্রমের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। দুর্নীতি ও অনিয়ম উন্মোচনকারী ব্যক্তিদের সুরক্ষা আইন সরকারি ও বেসরকারি খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম উন্মোচনকারী ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করা। দুর্নীতির প্রতিবেদনকারীদের জন্য আইনগত সুরক্ষা ও সহায়তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।স্বচ্ছতা আইন সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইনগুলোর সংশোধন করতে হবে। এতে তথ্য উম্মুক্তকরন উদ্যোগ এবং সরকারী নথিতে উল্লেখিত তথ্য জনগণের জানার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা, যা সরকারি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। ৬. ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক সংহতি বৃদ্ধিধারা ২ক [রাষ্ট্রধর্ম] এবং ধারা ১২ [ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা]: ধর্মনিরপেক্ষতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ধারা ২ক সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর আরও জোর দিতে হবে, যাতে যে কোনো ধরনের ধর্মীয় বৈষম্য নিষিদ্ধ হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতার অঙ্গীকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে সমান অধিকার নিশ্চিত করা।আইনগত পরিবর্তনসমূহ বিদ্বেষী ভাষণ আইন ধর্ম, জাতিসত্তা বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বী-বিদ্বেষী ভাষণ এবং সহিংসতা উস্কানির বিরুদ্ধে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা। এ আইনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের জন্য আইনগত প্রতিকার এবং সামাজিক সংহতি উন্নত করা।বৈষম্য বিরোধী আইন ধর্ম, জাতিসত্তা, লিঙ্গ এবং অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে বৈষম্য রোধে আইন প্রণয়ন করা। সকল নাগরিককে বৈষম্যমূলক কার্যকলাপ থেকে সুরক্ষা দেয়ার মাধ্যমে সমতা ও সামাজিক সংহতি নিশ্চিত করা।নীতিগত উদ্যোগসমূহ জনসচেতনতামূলক প্রচারণা সরকার এবং এনজিও দ্বারা পরিচালিত প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরে সহনশীলতা, দেশের বৈচিত্রময় সমাজ সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ নিশ্চিত করা। এই প্রচারণার লক্ষ্য হবে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি গড়ে তোলা।৭. গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণে প্রযুক্তির ব্যবহার প্রযুক্তিগত অংশগ্রহণের অন্তর্ভুক্তি জনসাধারণের প্রযুক্তিগতভাবে পরামর্শ প্রদান এবং প্রযুক্তি-সক্ষম অংশগ্রহণের লক্ষ্যে আইনি ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা। সরকারি সেবাসমূহ প্রদান ও গ্রহনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধিতে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা।আইনগত পরিবর্তনসমূহ প্রযুক্তিগত শাসন আইন ভোটিং, জনমত গ্রহণ এবং জনসম্পৃক্ততার জন্য প্রযুক্তিগত বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মসমূহের বাস্তবায়ন এবং ব্যবহারের জন্য আইনি নির্দেশিকা প্রণয়ন করা। সরকারি সেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করা যাতে শাসনব্যবস্থা আরও স্বচ্ছ এবং সকলের জন্য সহজলভ্য হয়।তথ্য সুরক্ষা আইন গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণে প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করার সময় নাগরিকদের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ব্যাপক তথ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা। নিশ্চিত করতে হবে যে, শাসন ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত উদ্যোগসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা ও সম্মান বজায় থাকে।নীতিগত উদ্যোগসমূহ ই-শাসন নীতিসমূহ শাসনব্যবস্থায় প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার পৃষ্ঠপোষণের জন্য নীতি প্রণয়ন করা, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে অনলাইন পরামর্শমূলক প্ল্যাটফর্মসমূহ, ডিজিটাল ভোটিং ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিগত সম্পৃক্ততায় ব্যবহৃত অন্যান্য সরঞ্জামসমূহের সমন্বিত ব্যবহার। এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য প্রযুক্তিগত ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারী কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং সরকারী সেবাসমূহের সহজলভ্যতা বৃদ্ধি করা।সরকারি শাসনকার্যে প্রযুক্তিগত বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মসমূহের ব্যবহার সরকারি শাসনকার্যে নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা এবং বাস্তবায়ন করা। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে অনলাইন ভোটিং সিস্টেম, ডিজিটাল টাউন হল এবং জনপরামর্শমূলক প্ল্যাটফর্মসমূহ যা নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।নাগরিক পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া সরকারি কর্মকাণ্ডের উপর নাগরিআদের পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা, যেমন জনসাধারণের অডিট কমিটি এবং স্বচ্ছতার প্ল্যাটফর্ম। সরকারী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়নে জনগণের সম্পৃক্ততা উৎসাহিত করা।৮. মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতাধারা ৩২ [জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার]: ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সুরক্ষা বৃদ্ধি ধারা ৩২ সংশোধন করে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সুরক্ষা বাড়ানো। সমস্ত আইনকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার মাধ্যমে নাগরিকদের স্বাধীনতা এবং স্বাধিকার রক্ষা নিশ্চিত করা।ধারা ২৩ক [আদিবাসী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতি ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি]/ধারা ১৯ [সুযোগের সমতা]: সংখ্যালঘু অধিকার সুরক্ষা ধারা ২৩ক/১৯ -এ সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করে জাতিগত, ধর্মীয় এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করা। সরকারে এবং সকল ধরনের সরকারি কার্যক্রমে সকলের সমান সুযোগ ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, যাতে সকলের অন্তর্ভুক্তি এবং বৈচিত্র্য প্রাধান্য পায়।আইনগত পরিবর্তনসমূহ সংখ্যালঘু অধিকার সুরক্ষা আইন জাতিগত, ধর্মীয় এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষায় নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা। এসব আইন বৈষম্য রোধে সকলের সমান সুযোগ ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করা।মানবাধিকার আইন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিস্তৃত মানবাধিকার আইন প্রণয়ন করা। এই আইনগুলো বিস্তৃত পরিসরে অন্তর্ভুক্ত করা যাতে সকলের নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারের সুরক্ষা এবং প্রয়োগ নিশ্চিত হয়।পরিশেষেপরিশেষে বলা যায়, উপরে উল্লিখিত সংবিধানিক এবং আইনগত সংস্কারগুলি বাংলাদেশের আইন কাঠামোকে একটি উদার গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে গঠিত সমাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য অপরিহার্য। এই সংস্কারগুলির লক্ষ্য একটি শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক এবং সামাজিক সমতার উপর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই পরিবর্তনগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এমন একটি ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারে, যেখানে সরকার সত্যিকার অর্থে জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে এবং সকল নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার, সমতা এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এই সংস্কারগুলি বাস্তবায়নের জন্য সমাজের সকল ক্ষেত্র থেকে সমর্থনপ্রাপ্ত এবং সকলের দ্বারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি স্থায়ী এবং বিস্তৃত পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই সকল সংবিধান সংশোধন, আইন প্রণয়ন এবং নীতিগত উদ্যোগসমূহ।প্রতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শিক্ষাগত সংস্কার, অর্থনৈতিক সমতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রযুক্তিগত অংশগ্রহণ এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রগুলি পদ্ধতিগতভাবে মোকাবিলা করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য বিদ্যমান বাধাগুলি অতিক্রম করতে পারে। উল্লিখিত এই সামগ্রিক পদ্ধতি নিশ্চিত করে যে শাসন ব্যবস্থা কেবল জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে না, বরং গণতন্ত্র, সমতা এবং ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতিগুলোকেও রক্ষা করে। Writer (লেখক):রাশেদুল হক রঞ্জনPhone: +88-01918180309 (WhatsApp) LinkedIn: https://www.linkedin.com/in/rashedul-haque-ronjonEmail: rashedul.haque.ronjon@outlook.com
বাংলাদেশ, সাংস্কৃতিকভাবে ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ এবং ঐতিহাসিকভাবে জটিল রাজনৈতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসা একটি দেশ। যা এখন একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের সন্ধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে রয়েছে। গত তিন দশকে কিছু অগ্রগতি হলেও, দেশটি এখনও একটি উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, এবং ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। অশিক্ষা, মিথ্যাচারিতা, অপপ্রচারমূলক কার্যকলাপ, ফ্যাসিবাদ, একনায়কতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বড় বাধা সৃষ্টি করছে। একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এখন অতীব জরুরি যা জনগণের মতামত, স্বাধীনতা, এবং প্রযুক্তিগত অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দেয়—যেখানে সরকার সত্যিকার অর্থে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত এবং পরিচালিত হয়। এই প্রবন্ধটি সেই বাধাগুলি পর্যালোচনা করে এবং সেগুলি অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা, বিভিন্ন মিডিয়া বা প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা, জনগনের সাক্ষরতাহার বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, এবং প্রযুক্তির মতো কার্যকর কৌশলগুলির প্রস্তাবনা করে, যা একটি প্রকৃতরূপে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের পথ দেখায়, যেখানে জনগণের ইচ্ছা ও স্বাধীনতার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে। সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য এবং এর বিকাশবাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর প্রাথমিক বছরগুলি সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিল, যা ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিফলিত হয়েছিল। তবে, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং সামরিক শাসনের উত্থানের পর এই সমাজতান্ত্রিক মূলনীতিগুলি থেকে ধীরে ধীরে দেশটির বিচ্যুতি ঘটে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে Neoliberal নীতির প্রবর্তন দেশের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বাজার ভিত্তিক পুঁজিবাদের দিকে পরিবর্তিত করেছিল। এই পরিবর্তনগুলি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিলেও, সামাজিক বৈষম্য এতে বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং জনকল্যাণমুলক রাষ্ট্র হিসেবে এর ভিত্তি দুর্বল হয়েছিল। ধনী এবং গরীবের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়েছিল, এবং বহু মানুষের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সেবাসমূহের প্রাপ্তি সীমিত হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য - যদিও দুর্বল হয়েছিল, তা এখনও জনসমাজকে কল্যাণমুলক করার আলোচনাকে প্রভাবিত করে এবং তা বিকাশের বিকল্প পদ্ধতির জন্য একটি কাঠামো প্রদান করে।প্রতিবন্ধকতাসমূহরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং স্বৈরাচারী প্রবণতাবাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে প্রায়শই অস্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়, যা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে তীব্র ক্ষমতার লড়াই দ্বারা চালিত হয়। এই পরিবেশ স্বৈরাচারী প্রবণতাগুলিকে উৎসাহিত করে, যেখানে নেতারা জাতীয় কল্যাণের চেয়ে ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলিকে দুর্বল করে, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে প্রান্তিকীকরণ করে, এবং কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় চেক এবং ব্যালেন্সকে দুর্বল করে। গণতান্ত্রিক নীতি এবং সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থা ঘটায়, যা প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ কঠিন করে তোলে।অপপ্রচার এবং মিথ্যাচারমিথ্যাচারিতা এবং অপপ্রচারের ব্যাপক বিস্তার গণতান্ত্রিক উন্নয়নের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা। রাজনৈতিক দলগুলি এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলি তাদের এজেন্ডা পূরণের জন্য তথ্যের অপব্যবহার করে, মিথ্যাচারিতা করে যার ফলশ্রুতিতে জনগনের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিভক্তি। এই তথ্যের অপব্যবহার নেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষমতা সীমিত করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে। সোশ্যাল মিডিয়া এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়, যার মাধ্যমে ভুল বিবরণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রকৃত জনমত গঠনের উপর প্রভাব ফেলে। মিথ্যাচার কেবল জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে না, বরং বিভাজনকে উসকে দেয়, যা সমাজকে অস্থিতিশীল করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলস্বরূপ, একটি বিভক্ত সমাজ তৈরি হয় যেখানে তথ্য উৎসগুলির প্রতি মানুষ তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, যা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়গুলিকে সঙ্গতিপূর্ণ করা কঠিন করে তোলে।শিক্ষাগত বৈষম্য এবং অশিক্ষা শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার সত্ত্বেও, বাংলাদেশ এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে শিক্ষাগত বৈষম্যের মুখোমুখি, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি হল অশিক্ষা। ২০২১ সালের UNESCO প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৭৬.৩৬%। এর মানে হলো, জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পড়তে বা লিখতে অক্ষম। অশিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা, যা নাগরিকদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়গুলিতে অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ এবং সঠিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমালোচনা করার ক্ষমতা সীমিত করে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায়ই প্রকৃত সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ক্ষমতার চেয়ে রট লার্নিংকে (মুখস্থবিদ্যা) গুরুত্ব দেয়, যা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক সমাজে অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। এই ধরনের শিক্ষাগত ব্যবস্থা অপপ্রচারমূলক মিথ্যাচারকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা এবং জাতির গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে, একটি সজাগ এবং সক্রিয় নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার প্রয়াসকে কঠিন করে তোলে।অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্যঅর্থনৈতিক বৈষম্য বাংলাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তোলে। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের ফলে দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশের বঞ্চনা ও প্রান্তিকীকরণ ঘটে। এই অর্থনৈতিক বিভাজন প্রায়ই রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো সম্পদের বিষয়গুলিতে অসম অংশগ্রহন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, যা সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল করে এবং ক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বৈষম্যগুলি একটি ঐক্যবদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা কঠিন করে তোলে, কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রায়শই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যায়। প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলির জন্য অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব তাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তি আরও কঠিন করে তোলে।দুর্নীতি এবং জবাবদিহির অভাবদুর্নীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থায় গভীরভাবে প্রোথিত, যা প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তোলে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত কার্যক্রম ফুলেফেঁপে উঠে, যা প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলি থেকে সম্পদ সরিয়ে নেয় এবং আইনের শাসনকে দুর্বল করে। দুর্নীতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনসাধারণের বিশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এবং গণতন্ত্র ও সুশাসনকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার মত সংস্কার বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে। দুর্নীতির ব্যাপক প্রকৃতি কেবলমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতাকে ক্ষুন্ন করে না বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকেও বাধাগ্রস্ত করে।ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বিভাজনবাংলাদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, যা সম্ভাব্যভাবে একটি শক্তির উৎস, প্রায়শই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। ধর্মীয় বিভাজন, বৈষম্য এবং সহিংসতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়, যা জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশে ফ্যাসিবাদ ও অত্যাচারের উত্থানে অবদান রাখে। এই বিভাজন একটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে, যেখানে সমস্ত নাগরিক, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই বিভাজনগুলির ব্যবহার সামাজিক বিভাজনকে চিরস্থায়ী করে এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করে।এই প্রতিবন্ধকতাগুলি অতিক্রম করার উপায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ভূমিকাগণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এই চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করার জন্য এমন একটি কাঠামো প্রদান করে যা সামাজিক মালিকানা, জনকল্যাণ, এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের উপর জোর দেয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা সমাজতন্ত্রের উপাদানগুলিকে গণতান্ত্রিক শাসনের সাথে একত্রিত করে। এটি একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যেখানে উৎপাদন, বিতরণ এবং বিনিময়ের উপায়গুলি সমগ্র সম্প্রদায় (প্রায়শই রাষ্ট্রের মাধ্যমে) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, একই সাথে নিশ্চিত করে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা জনগণের দ্বারা গণতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। এই ধরনের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান-স্টাইলের কল্যাণ রাষ্ট্র এবং আরও অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের অর্থনীতির মডেলগুলিই তার উদাহরণ যার মাধ্যমে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায্যতা অর্জন করার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক শাসন বজায় রাখা যায়।সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ:• সরকারি মালিকানা: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে, মূল শিল্প ও সম্পদ সাধারণত রাষ্ট্র বা সমবায় দ্বারা মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রিত হয়, যার লক্ষ্য হল দেশের ধনসম্পদ সমগ্র জনসংখ্যার মধ্যে সামগ্রিকভাবে এবং আরও সমভাবে বিতরণ করা।• গণতান্ত্রিক শাসন: সমাজতন্ত্রের স্বৈরাচারী রূপগুলির বিপরীতে, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র মুক্ত নির্বাচন, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ এবং নাগরিক স্বাধীনতার সুরক্ষার মতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলির উপর গুরুতারোপ করে। নাগরিকদের নীতি প্রণয়নে অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করে এবং সরকারী নীতি প্রনয়নকে প্রভাবিত করে।• সামাজিক কল্যাণ: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হল সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলির প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা। সমস্ত নাগরিকের জন্য একটি উচ্চ জীবনমান নিশ্চিত করতে সরকার প্রায়শই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আবাসন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা প্রদান করে।• অর্থনৈতিক পরিকল্পনা: দেশের বাজারগুলি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রায়শই অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি হস্তক্ষেপের সাথে জড়িত, যা বৈষম্য প্রতিরোধ করে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমসমূহ সমাজের সার্বিক মঙ্গল অনুযায়ী নিশ্চিত করে।• শ্রমিকদের অংশগ্রহণ: বিভিন্ন ধরনের সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে, শ্রমিকরা তাদের কর্মক্ষেত্র পরিচালনায় কাউন্সিল বা সমবায়ের মাধ্যমে সরাসরি ভূমিকা রাখে। এটি কর্মীদের ক্ষমতায়িত করার এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাধারণ অনুক্রমিক (hierarchical) কাঠামো কমানোর উদ্দেশ্যে করা হয়।বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, একটি সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক মডেল যা সামাজিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠা, প্রধান শিল্পগুলির জনস্বত্বের সঠিক বণ্টন, এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে অগ্রাধিকার দেয়ার মাধ্যমে দেশটির জরুরি চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গুণগত স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, দুর্বলদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, শ্রমিকদের অধিকার ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে।গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও শাসন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং স্বৈরাচারী প্রবণতাগুলি মোকাবেলায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালীকরণ এবং আইনের শাসনকে প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় এমন অবাধ, সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে ব্যাপক নির্বাচন সংস্কার প্রয়োজন। স্থানীয় সরকারগুলিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সরকারি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করা, সকলের জন্য ন্যায্য এবং একটি সমতল মঞ্চ তৈরি করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সকলের কণ্ঠস্বর শোনা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং গণমাধ্যম জ্ঞানের প্রচার মিথ্যাচার, বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের বিস্তার রোধ করার জন্য জনগনকে গণমাধ্যম জ্ঞানসম্পন্ন করা অপরিহার্য। নাগরিকদের ভুয়া খবর চিহ্নিত করার ও প্রাপ্ত তথ্যের উৎসগুলি সমালোচনামূলকভাবে মূল্যায়ন করার এবং এর অপব্যবহার প্রতিরোধ করার জন্য প্রকৃত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান, সচেতনতাবোধ তৈরি, তথ্যের বিশ্লেষণ ও গণমাধ্যম জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করা প্রয়োজন। ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের এবং প্রশাসনকে জবাবদিহিতার আওতায় রাখা এবং জনগণের কাছে সঠিক তথ্যের উপলব্ধতা নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীন গণমাধ্যম এবং অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা সমর্থন করাও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এবং সুশীল সমাজকে মিথ্যাচারের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে একসাথে কাজ করা প্রয়োজন।শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষা সংস্কার অপরিহার্য। সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধান এবং সুনাগরিক হওয়ার শিক্ষার উপর জোর দিতে পাঠ্যক্রমসমূহের সংশোধন করা উচিত। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, গুণগত শিক্ষা পৌঁছানোর সুযোগ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ যাতে সকল নাগরিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে। এবং এজন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করা, দেশের সামগ্রিক শিক্ষার গুণমান উন্নত করা এবং নাগরিকদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করা যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আরও তথ্যসমৃদ্ধ এবং সক্রিয় নাগরিক গোষ্ঠী তৈরি করতে পারে যা জাতির অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক বিকাশে অবদান রাখতে সক্ষম।অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করাঅর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবেলা করতে এমন লক্ষ্য ও নীতির বাস্তবায়ন প্রয়োজন যা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে প্রসার করে এবং সকল সম্পদের উপর সকলের সমঅধিকার নিশ্চিত করে। প্রগতিশীল করের বাস্তবায়ন, সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচিসমূহের বৃদ্ধি, নতুন নতুন চাকরি সৃষ্টি এবং দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সকল নাগরিকের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক পরিষেবাগুলিতে সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, আন্ত বৈষম্য হ্রাস করা এবং সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। অর্থনৈতিক নীতিগুলি প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলিকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা এবং সকল নাগরিককে অর্থনীতিতে সম্পূর্ণরূপে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করার উপর ফোকাস করা উচিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলা করে, বাংলাদেশ একটি আরও ঐক্যবদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে পারে।দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা জোরদার করা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরি, উভয়েরই প্রয়োজন। দুর্নীতি-প্রতিরোধী সংস্থাগুলিকে শক্তিশালী করা, দুর্নীতি রোধে কঠোর শাস্তির বিধান ও প্রয়োগ করা, এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে সততার সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার করা দুর্নীতি হ্রাসের জন্য অপরিহার্য। প্রসাশনিক শাসনে জনসাধারণের অংশগ্রহণ, কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা এবং সরকারি সম্পদ কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নাগরিক তদারকি কমিটি এবং তথ্য উন্মুক্তকরণ উদ্যোগের মতো প্রক্রিয়াগুলির বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে উল্লেখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহনের মাধমেই জনসাধারণের প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি তাদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ তৈরি করতে সাহায্য করবে।ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ঐক্য প্রচারধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজন কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক বন্ধনকে উৎসাহিত করতে হবে। সকল নাগরিক, তাদের ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পটভূমি নির্বিশেষে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেন সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য বৈষম্য বিরোধী আইন এবং নীতির বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তঃসম্প্রদায় সংলাপ, শান্তি শিক্ষার কর্মসূচি এবং একে অপরের প্রতি সহনশীলতার সংস্কৃতি তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় কিন্তু ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে পারে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধর্মের ব্যবহার এবং সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয় এমন বক্তব্য সমালোচনামূলকভাবে পরীক্ষা করা উচিত এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিকে আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা করা উচিত। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে, বাংলাদেশ একটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহারডিজিটাল যুগে, প্রযুক্তি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে। সরকারকে এমন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করা উচিত যা নাগরিকদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে, মতামত প্রদান করতে, এবং নেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। অনলাইন ভোটিং সিস্টেম, ডিজিটাল টাউন হল, এবং নীতিগত বিষয়ে পাবলিক পরামর্শের প্ল্যাটফর্মগুলি ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ যা একটি আরও সংযুক্ত এবং সক্রিয় নাগরিক সমাজ তৈরি করতে পারে। প্রশাসনে এধরনের ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদের এবং তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে যা নিশ্চিত করবে একটি সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।পরিশেষে বাংলাদেশের জন্য এই ধরনের একটি উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রাটি জটিল কিন্তু একটি অপরিহার্য লক্ষ্য। জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় এমন একটি শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক সংস্কার, গণমাধ্যম জ্ঞানের প্রচার, শিক্ষাসংস্কার, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস, দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচারের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই বাধাগুলির সমাধান করার মাধ্যমে, বাংলাদেশ একটি আরও ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করতে পারে, একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তার নাগরিকদের ক্ষমতায়িত করতে পারে, যেখানে প্রত্যেকের মতামত জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্যতা পাবে এবং গণতান্ত্রিক আদর্শসমৃদ্ধ হবে। প্রযুক্তি, শিক্ষা, এবং সকল সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের জন্য উল্লেখিত প্রক্রিয়াসমূহের বাস্তবায়ন এবং যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে দেশীয় সম্পদসমূহের সুষম বণ্টন ও সদ্ব্যবহার করে, বাংলাদেশ এমন একটি জাতি হিসাবে পরিণত হতে পারে যা শুধুমাত্র তার নাগরিকদের আকাঙ্খাকেই প্রতিফলিত করবে না, বরং সকলের অন্তর্ভুক্তি এবং বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে।Writer (লেখক):রাশেদুল হক রঞ্জনPhone: +88-01918180309 (WhatsApp) LinkedIn: https://www.linkedin.com/in/rashedul-haque-ronjon Email: rashedul.haque.ronjon@outlook.com