রেজাউল করিম
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫ ০২:১৩ পিএম
মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধুই আমাদের
জাতি হিসেবে আমরা দুর্ভাগা বটে। এ কারণে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে চলছে নানা ষড়যন্ত্র। মূলত স্বাধীনতা বিরোধীরাই এ ষড়যন্ত্রের খলনায়ক। তারা মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখের বদলে ৩ লাখ বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে। অথচ মুক্তিযুুদ্ধের সময়েই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে নিহতের সংখ্যা লাখ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়।
২০০৫ সালের ২৩ জুন প্রকাশিত এশিয়া টাইমস’র নিবন্ধে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়ার কথা প্রথম বলেছেন তখনকার পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ইয়াহিয়া খান। তাহলে এখন কারা নতুন তথ্য হাজির করছে? তাদের উদ্দেশ্য কী? এর পেছনে কারা আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা জরুরি। মোটাদাগে বলা যায়, এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীরা। এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কেবল মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখা, দেখানো। তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে চাচ্ছে ১৯৭১ সালে তেমন কিছু ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। হয়েছে ভাইয়ে ভাইয়ে গন্ডগোল! এর মধ্যদিয়ে তারা মূলত পাকবাহিনীর অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এটা যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের একটা অংশ, তা হয়তো আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না। কারণ পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালের পরাজয়ের গ্লানি এখনো ভোলেনি।
পাকহানাদার বাহিনীর গণহত্যা, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, আমাদের মা-বোনকে ধর্ষণ-হত্যার খবর যখন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছিল, তখন তাদের দোসররা উল্লাস করছিল। লুটপাটে ব্যস্ত সময় পার করছিল তারা। এদেশের অনেক সংবাদ মাধ্যমকে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে সংবাদ পরিবেশন করতে বাধ্য করছিল। এমনভাবে সংবাদ প্রকাশ করা হতো যে পাকিস্তানি বাহিনী বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। আর কয়দিন পরই তারা বিজয়ের ঘোষণা দেবেন। সর্বহারা মানুষের গগণবিদারী আহাজারি তারা উপভোগ করছিল। তারা এদেশের মানুষ নয়, মাটি চেয়েছিল। সেই শকুনের দল ফের মানচিত্রে থাবা বসাতে উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের মানুষ সেটা হতে দেব না। স্বাধীনতা রক্ষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রয়োজনে আমরা আবারও যুদ্ধে যাব।
৩০ লাখ শহীদের প্রাণ, এক সাগর রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এটা কারো দয়া নয়, আমাদের অর্জন। এ দেশের দামাল ছেলেরা বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল দেশ-মাতৃকাকে স্বাধীন করতে। জীবনটা তাদের কাছে তুচ্ছ ছিল মাতৃভূমি রক্ষার জন্য। সহযোদ্ধাকে হারিয়েও দমে যাননি আরেক যোদ্ধা। তিনি পূর্ণ উদ্যমে এগিয়ে গেছেন। শত্রুর বুকে গুলি চালিয়েছেন, ছুঁড়েছেন গ্রেনেড। কিন্তু এ দেশীয় পাকবাহিনীর দোসরদের মতো ভারতও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে! মুক্তিযুুদ্ধে তাদের অবদান অনস্বীকার্য বটে। তারা আমাদের এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল। এই যুুদ্ধে তাদের ১ হাজার ৬০০ সেনা শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। তারা কূটনীতিকভাবেও আমাদের সহায়তা করেছিলেন- এ কথা সত্য। ভারতকে আমরা বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবেই জানি। কিন্তু ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এ কী বললেন?
‘অপারেশন সিঁদুরে’ নৌবাহিনী সক্রিয় হলেই পাকিস্তানকে চার টুকরো করে দেওয়া যেত বলে তিনি হুংকার দিয়েছেন। ভারতের প্রথম দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্ত পরিদর্শনে গিয়ে নৌবাহিনীর শক্তি নিয়ে এমনই হুঙ্কার দেন তিনি। সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে তিনি যা বললেন, তা আমাদের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। তার ভাষ্য, ১৯৭১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর পরাক্রমে দুই টুকরো হয়েছিল পাকিস্তান। এবারও ভারতের নৌবাহিনী সরাসরি সংঘাতে নামলে পাকিস্তান আরও টুকরো টুকরো হত। শুক্রবার আরব সাগরে মোতায়েন আইএনএস বিক্রান্তে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও সেনাদের সঙ্গে দেখা করেছেন রাজনাথ।
যুদ্ধজাহাজে দাঁড়িয়েই রাজনাথ বলেন, ‘১৯৭১ সাল সাক্ষী, ভারতীয় নৌবাহিনী যখন অভিযানে নামল, তখন পাকিস্তান দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। অপারেশন সিঁদুরেও যদি ভারতের নৌবাহিনী সংঘাতে নামত, তাহলে এবার পাকিস্তান আর দু’টুকরো নয়, চার টুকরো হয়ে যেত।’ মি. সিং আপনার এই বক্তব্য আষাঢ়ে গর্জন ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনার এই বক্তব্যে আপনার নৌবাহিনীর সদস্যরা তাৎক্ষণিক মনোবল পেয়েছে বটে; কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে মুচকি হাসে, তা কি আপনি বোঝেন? বুঝলে অবশ্য এমন বক্তব্য দিতেন না। কেন কথাগুলো বলছি, তা স্পষ্ট করছি। পাকিস্তানে আপনারা আক্রমণ করলেন। পাকিস্তানও পাল্টা আক্রমণ করলো। আপনাদের অত্যাধুনিক রাফাল যুদ্ধ বিমান ভূপাতিত করলো চীন-পাকিস্তানের তৈরি যুদ্ধ বিমান। এটা নিয়ে আপনারা চুপ হয়ে গেলেন।
বারবার সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলেন। কেন? তার মানে সামথিং রং। এই যুদ্ধ আপনারা বিজয়ী দাবি করছেন। পাকিস্তানও বিজয়ী দাবি করছে। তাহলে হারলো কে? নৈতিকভাবে আপনারাই হেরেছেন। কেননা, আপনাদের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এতো শক্তিশালী বলে দাবি করেন; অথচ কাশ্মিরের মতো একটা জায়গায় জঙ্গি হামলা হলো; ২৬ পর্যটকের প্রাণ গেল আর আপনারা জানতে পারলেন না? বিষয়টি হাস্যকর বটে। নাকি পাকিস্তানের মিডিয়ার দাবিই সত্য। এটা ছিল নাটক। সেখানে কোনও হামলা-ই হয়নি। মোদী সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য যুদ্ধ যুদ্ধ লেখা করলেন? সেটা যা-ই হোক, আপনাদের ব্যাপার।
আবার আসি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। আপনি বলেছেন, ভারতের নৌবাহিনীর হামলায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দুই টুকরো হয়েছিল। এটা সম্পূর্ণ ভুল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলে পড়েছিল পাকবাহিনী। তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই খবর ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা সময় লেগেছিল। এরপরই থেকেই এদেশের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে; তাদের সঙ্গে লড়াই করে। বাঙালিরা যুদ্ধ করতে করতে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল। বিজয়ের ঠিক কিছুদিন আগে আপনাদের সামরিক বাহিনী সরাসরি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
এতে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়। কারণ পিঁপড়ার বলও বল। বিপদের সময় পিঁপড়ার বলও কাজে আসে। আপনারা না এলে আমাদের বিজয়ী হতে হয়তো আরও কিছুদিন সময় লাগতো। সেটা হতে পারতো এক মাস, দুমাস কিংবা আরও কিছুটা বেশি সময়। বিজয়ী আমরা হতাম-ই। এদেশের ৩০ লাখ মানুষ যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। আপনাদের শহীদ হয়েছে মাত্র ১৬০০ জন। এটা কিন্তু কোনও পার্সেন্টেজে পড়ে না। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধে আপনাদের অবদান অস্বীকার করছি না। সেটা করারও সুযোগ নেই। কারণ সত্যকে তো আর লুকানো যায় না। তবে একটা কথা বলতে চাই, মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের, কেবলই আমাদের। লেখক: সাংবাদিক।
ভোরের আকাশ/এসএইচ