বিশ্ব পরিবার দিবস আজ
শিপংকর শীল
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৫ ১০:০৭ এএম
বেড়েছে সংসার ভাঙন, ঘটছে বীভৎস হত্যাকাণ্ড
কুষ্টিয়ায় স্ত্রী ও দুই শিশুকন্যাকে হত্যাচেষ্টা চালিয়ে নিজেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেন মামুন আলী নামে এক যুবক। সাভারে বাবাকে ছুরি মেরে হত্যা করে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন মেয়ে। চট্টগ্রাম মহানগরের হালিশহরে পঞ্চম বিয়ে করায় চতুর্থ স্ত্রীর হাতে খুন হয়েছেন মো. আলাউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। এভাবে পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ, পারিবারিক বন্ধন ও পরিবারের গুরুত্ব হ্রাস পেয়ে আজ বেড়েছে পারিবারিক কলহ, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড। যৌথ পরিবার অনেক আগেই ভেঙে গেছে। এবার একক পরিবারের সদস্যরাও হয়ে যাচ্ছেন ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক মানসিকতার। আর সংসার ভাঙনের হার বেড়েছে কয়েকগুণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ সামাজিক জীব, সামাজিক উপাদানগুলোর মধ্যে প্রথম ও প্রধান উপাদান হলো পরিবার। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা ও ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধনের মাধ্যমে পরিবারে একজন মানুষ সমাজের সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও সংস্কৃতিতে পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবারকে বলা হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। একটি আদর্শ পরিবারে অন্যতম কার্যাবলি হলো পরিবারের সকলে মিলেমিশে একত্রে বাস করা। এ কাজটাই একটি আদর্শ পরিবারে থাকে।
বর্তমানে পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে বলেই আমাদের সামাজিক নানা সমস্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে অস্থিরতা। ধর্মীয় বিধানেও রক্তের সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার ওপর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পরিবারকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু বিবেচনা করে পরিবারের সব সদস্যের সুখ ও সমৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা অপরিহার্য। তাই পরিবারের সবার সুস্বাস্থ্য, শান্তি ও সৌহার্দ্য পূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতিও সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে এবং বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরতে সর্বস্তরের জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে।
বাড়ছে তালাক, ভাঙছে সংসার : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-চাচি মিলে এক মধুর সংসার গড়ে উঠেছিল প্রাচীন বাংলাদেশে। আবহমানকাল ধরে এ পরিবার প্রথা বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের সামাজিক বন্ধন শুধু সুদৃঢ় ভিত্তিই দেয়নি, গড়েছে অনাবিল পরিবেশ। আর্থিক সংকট, সামাজিক প্রতিযোগিতাসহ পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থার নানা সংস্কৃতির প্রবেশের কারণে বাংলাদেশের সেই যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে যাচ্ছে। ফলে ভাঙছে সংসার, বাড়ছে তালাক। বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কসহ নানা কারণে ভাঙছে সংসার, বাড়ছে বিচ্ছেদের হার। এককভাবে পুরুষ কিংবা নারী নন, উভয়পক্ষ থেকেই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যাচ্ছে। দেশে দিন দিন এমন বিচ্ছেদের ঘটনার মিছিল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বিচ্ছেদ নিয়ে নানা ধারণা প্রচলিত আছে।
আইনি প্রক্রিয়া মেনে যেকোনো দম্পতি যেকোনো বয়সেই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে বিচ্ছেদ বৈধ প্রক্রিয়া হলেও উৎসাহিত করার মতো কোনো বিষয় নয়। কারণ এর ফলে সন্তানের ভবিষ্যৎ পড়ে অনিশ্চয়তার মুখে, ভেঙে পড়ে সমাজের কাঠামো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রথমবার এবং সর্বশেষ বিয়ে ও তালাক সংক্রান্ত ২০২২ সালের একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, দেশে বিয়েবিচ্ছেদের হার তুলনামূলক বেড়েছে।
‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’ শীর্ষক ওই পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে বিচ্ছেদের হার শূন্য দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ১-এর মধ্যে ওঠানামা করে। আর ২০২২ সালে তা বেড়ে ১ দশমিক ৪ এ দাঁড়ায়।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালে নারীদের পক্ষ থেকে সাধারণ বিয়েবিচ্ছেদের হার ছিল ২ এর সামান্য কম। তা পরের বছর বেড়ে ৩ দশমিক ৬-এ দাঁড়ায়। একইভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের হার ২০২১ সালে ছিল ২ এর সামান্য বেশি। পরের বছর তা বেড়ে ৩ দশমিক ৮ এ দাঁড়ায়। আর শহরের তুলনায় গ্রামে বিয়েবিচ্ছেদ বেশি। কেন বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছে, এমন প্রশ্নে বিবিএসের ওই পরিসংখ্যান বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ককে তালিকার প্রথমে রেখেছে। এতে দেখা যায়, ২৩ শতাংশ ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের কারণ বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক। আর ২২ শতাংশ ক্ষেত্রে দাম্পত্য জীবনের দায়িত্বহীন আচরণকে দোষারোপ করা হয়েছে।
কেন তাসের ঘর হচ্ছে সংসার : কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে, যারা একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে উঠেছেন এবং তাদের অধিকাংশই গ্রামীণ জীবনযাপন করেছেন। এসব পরিবারের নারী এবং পুরুষ উভয়ের মতে, বিয়ে হলো সামজিক বন্ধন। দাম্পত্য জীবনে যতই চড়াই-উতরাই থাকুক না কেন শেষ পর্যন্ত জীবনের রাস্তায় দুজনকে এক থাকতে হয়। আর এক্ষেত্রে একান্নবর্তী পরিবারের গুরুত্ব তুলে ধরে তারা বলছেন, দাম্পত্য জীবনে যে কোনো কলহ দুজনকেই মিটাতে হয়, তবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তা সহজ করতে ভূমিকা পালন করে থাকে।
এদিকে শহরের নিউক্লিয়ার পরিবারগুলো বলছে, ছোট পরিবারে ঝামেলা কম, চাকরি শেষে সবাইকে নিয়ে এত ভেবে পেরে ওঠা যায় না বলেই স্বামী-স্ত্রী সন্তানসহ থাকছেন তারা। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগই সন্তান পালনে সাহায্যকারীর ওপর নির্ভরশীল। এমনই একটি পরিবার শামীম-জোহরার।
এই দম্পতি বলেন, জীবনে এগিয়ে যেতে হলে প্রযুক্তির বিকল্প নেই। তবে যতই ব্যস্ততা থাকুক পরিবারের জন্য সময় বের করেন তারা। কিন্তু নিজেদের শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারাও একান্নবর্তী পরিবারের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
গ্রামে বিচ্ছেদ বাড়াচ্ছে বাল্যবিয়ে : বিবিএসের ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক ২০২৩-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজারে গ্রামে ১১টি এবং শহরে ৯টি তালাকের ঘটনা ঘটছে। দেশে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার অনেকটাই বেড়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা গ্রামে বিয়েবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার পেছনের অন্যতম বড় কারণ হিসেবে বাল্যবিয়ে ও কৌশলে যৌতুক আদায়ের বিষয়টিকে দেখছেন।
প্রযুক্তি কমাচ্ছে সম্পর্কের গুরুত্ব : প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে গতিশীল করছে। তবে এর নেতিবাচক ব্যবহার এড়াতে পারছে না মানুষ। প্রযুক্তি পারস্পরিক দূরত্ব বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাছির বলেন, ‘প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবারের বাইরে সবারই ভিন্ন ভিন্ন জগৎ তৈরি হচ্ছে। একটা সময় ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য অনেকটা বেড়ে যাচ্ছে। এতে পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করতেও মানুষ দ্বিধা করছে না। আর এর বলি হচ্ছে শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ।
তিনি আরও বলেন, মেয়েরা এখন শিক্ষার দিক দিয়ে অনেক এগিয়েছে, যেটি তাকে স্বনির্ভর করছে। এখন আর নারীরা নীরবে সংসারে নির্যাতন সহ্য করে না। তাই নারীদের পক্ষ থেকে তালাকের সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছে।
বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে বিচ্ছেদ ঘটে- উল্লেখ করে সমাজবিজ্ঞানী খায়রুল চৌধুরী বলেন, আমাদের ভাবতে হবে কেন এটি ব্যাধির মতো ছড়াচ্ছে। এর মূল কারণ হিসেবে আমি বলব, নিজ পরিবারকে সময় না দিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়া, বিভিন্ন অ্যাপে বন্ধু তৈরি করা আর সেখানে ডুবে যাওয়া। এমনকি পেটের দায়ে যারা পরিবার রেখে শহরমুখী হচ্ছে, শহরে এসে তারাও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। এতে করে গ্রামে রেখে আসা পরিবারে সঙ্গে বিচ্ছেদ দীর্ঘ হচ্ছে। এই ব্যাধি কমাতে হলে পরিবারকে নিয়ে ভাবতে হবে, সময় দিতে হবে।
তিনি বলেন, সামাজিক শৃঙ্খলাবোধ নিজের মধ্যে তৈরি করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, প্রযুক্তিতে গতিশীল হতে গিয়ে আমরা যেন সমাজকে ভেঙে না ফেলি।
বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে তাড়াহুড়ো নয় : বিয়েবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাড়াহুড়ো না করার পরামর্শ মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের। মনোশিক্ষাবিদ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম এ মোহিত কামাল বলেন, দাম্পত্য কলহ দিনকে দিন বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে দম্পতিদের উচিত কাপল কাউন্সিলিং নেওয়া, নিজেদের সমস্যাগুলো মানসিক বিষেশজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ঠিক করে নেওয়া। তবে এই প্র্যাকটিসটা (চর্চা) বাংলাদেশে একদমই নেই। কলহ থেকে দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কারণেই বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি হচ্ছে।
বিচ্ছেদ পরবর্তী চিত্র নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বিচ্ছেদের পর যে মানসিক ট্রমা তৈরি হয়, সেটা থেকে বের হতে অনেকের দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এটি অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করে ওই ব্যক্তি (নারী বা পুরুষ) মানসিকভাবে কতটা দৃঢ় তার ওপর। যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে- ভেবে জীবনের নতুন অধ্যায় সাহস নিয়ে শুরু করতে হবে।
বেড়েছে পারিবাকি সহিংসতা : জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রোগ্রাম অফিসার ও হেল্পলাইন ইনচার্জ রাইসুল ইসলাম বলেন, ‘সহযোগিতা চেয়ে পরিবারের সদস্যরা বেশি কল দেন। বেশির ভাগ কল আসে পারিবারিক সহিংসতাকে কেন্দ্র করে। প্রতিদিন চাঞ্চল্যকর কেসগুলো, অর্থাৎ বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের ঘটনা হেল্পলাইন সেন্টার থেকেই তদারকি করা হয়। দৈনিক গড়ে ছয় থেকে সাত হাজার কল আসে।’ জনবলের সংকট রয়েছে। বর্তমানে তিন শিফটে ৪০ জন ২৪ ঘণ্টা কাজ করলে প্রয়োজন ৮০ জনের।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, নারীর প্রতি অর্থনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে। গত চার বছরের মধ্যে এ সহিংসতা সম্পর্কিত কল বেশি এসেছে ২০২৪ সালে। বছরটিতে ৪ লাখ ৬০ হাজারের বেশি কল আসে। এর আগে ২০২১ সালে ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৯১টি, ২০২২ সালে ৩ লাখ ৬ হাজার ৬৬০টি এবং ২০২৩ সালে ৪ লাখ ৫২ হাজার ৬৭৭টি কল আসে।
উই ক্যান অ্যালায়েন্সের জাতীয় সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বলেন, পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে, যে ভাবনা নিয়ে পারিবারিক কাঠামোগুলো তৈরি হয়, সেগুলোর পরিবর্তন হচ্ছে না। ছেলেরা বাইরে খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কিংবা ক্লান্ত থাকলে ঘরে এসে বউকে নির্যাতন করে। আবার কোনো কোনো ছেলের বউকে ভালো লাগলেও তার পরিবারের মানুষকে পছন্দ করে না। এসব কারণে সহিংসতা বাড়ছে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক মনে করেন, পারিবারিক সহিংসতাসহ নারীর প্রতি সব বৈষম্য প্রতিরোধে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, অনেকেই দাম্পত্যজীবনে সুখী হন না। কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিক কারণে সেটা মেনে নিয়ে সংসার করে যান। অবশ্য অনেকেই দাম্পত্যজীবনে সুখী হওয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
ভোরের আকাশ/এসএইচ