বহাল থাকছে
আকতার হোসেন
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৫ ০৯:৫১ এএম
মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভা সদস্যদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি
মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বদলাতে গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সংশোধিত জামুকা অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, যুদ্ধকালীন যাঁরা বিদেশে থেকে জনমত গঠন করেছেন, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী-দূত; মুজিবনগর সরকারে সম্পৃক্ত এমএনএ এবং যাঁরা পরবর্তীকালে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সব খেলোয়াড়কে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে রাখার প্রস্তাব করা হয়।
এর ফলে বঙ্গবন্ধুসহ মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় না থেকে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের তালিকায় চলে যেত। জামুকা অধ্যাদেশের এই খসড়া প্রকাশ করার পর এ নিয়ে বেশ সমালোচনা শুরু হয়। অধ্যাদেশের খসড়াটি অনুমোদনের জন্য ৬ মে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উত্থাপন করা হয়। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ তা পর্যালোচনা করে পুনরায় উপদেষ্টা পরিষদে উত্থাপন করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়।
অবশেষে সমালোচনার মুখে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে সরকার। সরাসরি যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বহাল রাখছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জামুকা অধ্যাদেশের খসড়া পর্যালোচনা করে সেখানে মুজিবনগর সরকারে সম্পৃক্ত এমএনএ এবং যাঁরা পরবর্তীকালে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন তাঁদের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় রেখে নতুন খসড়া করেছে। এই খসড়া অনুমোদনের জন্য আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপন করা হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। অপরদিকে জামুকা আইন সংশোধন হওয়ার পরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগীদের নাম আলাদা করা হবে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এই কাজ করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দেওয়ার প্রস্তাবে আপত্তি করেনি উপদেষ্টা পরিষদ। তবে বঙ্গবন্ধু এবং মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকা উচিত বলে মত দেয় উপদেষ্টা পরিষদ।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী বলেন, অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে সহযোগীদের নাম আলাদা করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর তালিকায় যাঁরা থাকবেন, তাঁরা আগের মতোই সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন।
জামুকার সুপারিশ অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করে ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি সংশোধিত পরিপত্র জারি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেই হিসেবে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব মুক্তিযোদ্ধার বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বনিম্ন বয়স নিয়ে আদালতে মামলা থাকায় সংশোধিত খসড়ায় এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। মামলা নিষ্পত্তির পর বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধার সর্বনিম্ন বয়স নতুন করে নির্ধারণ করবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বনিম্ন বয়স সাড়ে ১২ বছরের পরিবর্তে ১৪ বছর করার বিষয়ে আলোচনা রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বনিম্ন বয়স সাড়ে ১২ বছর করা হয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বনিম্ন বয়স ১৪ বছর করা হলে প্রভাবশালী কয়েক শ’ মানুষের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল হয়ে যাবে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনীতিবিদ : ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২’ জারি করেন। ওই বছরের ২৩ মার্চ গণপরিষদ আদেশ জারি করা হয়। এই আদেশবলে ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৬৯-এর (জাতীয় পরিষদে ১৬৯, আর প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০) মধ্যে ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় গণপরিষদ। ৪০৩ জনের মধ্যে ৪০০ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের, একজন ছিলেন ন্যাপের আর দু’জন নির্দলীয়। স্বাধীনতার পর প্রণীত বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাদের মধ্যে ১ হাজার ৩৬১ জনকে ‘লাল মুক্তিবার্তা স্মরণীয় যারা বরণীয় যারা’ শ্রেণিতে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাসহ গণপরিষদের সদস্যও আছেন।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় বর্তমানে ৩৬টি শ্রেণি রয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া কার্যকর হলে গণপরিষদ সদস্যদের নিয়ে প্রণীত লাল মুক্তিবার্তা স্মরণীয় যারা বরণীয় যারা, বিসিএস ধারণাগত খেতাবপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিশ্বজনমত গঠনকারী প্রবাসী সংগঠক, মুজিবনগর, স্বাধীন বাংলা বেতার শিল্পী, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় বদলে যাবে। এর বাইরে বেসামরিক গেজেটে থাকা প্রায় দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধার মধ্য থেকেও কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় নিয়ে সংকট দেখা দেবে। খসড়াটি অধ্যাদেশ হিসেবে প্রকাশের পর বেসামরিক গেজেটের তালিকা থেকে রণাঙ্গনে অংশ না নেওয়া অন্য শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই শুরু করবে মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কমিটির তালিকার ভিত্তিতে এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম পাঁচটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। তবে এটির গেজেট হয়নি। ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৮৯২। পরে ১৯৯৪ সালে বিএনপির আমলে করা তৃতীয় তালিকায় ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হন। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে প্রকাশিত চতুর্থ তালিকায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জনের নাম মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে গেজেটে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯-এ। ২০২৩ সালে বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ষষ্ঠ দফার চূড়ান্ত (সমন্বিত) তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৮ হাজার ৮৫১-তে। এর মধ্যে খেতাবপ্রাপ্ত, শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ১০ হাজার ৯৯৬ জন।
ভোরের আকাশ/এসএইচ