জুলাই সনদ
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৫ ০৮:৫৫ এএম
ছবি: সংগৃহীত
সংস্কার ইস্যুতে কয়েকমাস ধরে দফায় দফায় আলোচনার পরও মৌলিক অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ২০টি বিষয়ের মধ্যে ৫টিতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। এ মাসের মধ্যেই জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার আশা করছেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। ঘোষিত সময়ের মধ্যে জুলাই সনদ না হলে ৩ আগস্ট জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের ঘোষণা দিয়েছে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া দল এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি)। তবে জুলাই সনদ আসলে কী, কেন এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ, জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রের মধ্যে পার্থক্য কী- এসব প্রশ্ন এখন আলোচনায় আসছে।
কমিশন দাবি করছে, কয়েক দফার আলোচনায় এরই মধ্যে বেশকিছু সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এখনো আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনসহ বেশকিছু সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাবে দলগুলোর মধ্যে নানা মতবিরোধও দেখা দিচ্ছে।
ঐকমত্য কমিশন বলছে, জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ দুটি একেবারেই আলাদা বিষয়। কেননা সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সনদ বা সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি হবে, সেটি জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ। জুলাইয়ের ঘোঘণাপত্র তৈরির কাজ ঐকমত্য কমিশনের নয়, সেটি সরকার ও রাজনৈতিক দল মিলে করবে। শুধু জুলাই সনদ প্রস্তুত করবে ঐকমত্য কমিশন।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৩১ ডিসেম্বর জুলাই প্রোক্লেমেশন বা গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। পরে অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের আশ্বাসে সেই অবস্থান থেকে সরে আসে শিক্ষার্থীরা। পরে সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল।
জুলাই সনদ কী : গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কটিতে একমত হয়েছে, তার তালিকা থাকবে এই সনদে।’
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারে যে ১১টি কমিশন গঠন করে, সে সব কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক সংলাপ করছে ঐকমত্য কমিশন। এতে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার সংক্রান্ত ১৬৬টি সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সাথে ধারাবাহিক এই আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়।
ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, এসব প্রস্তাবনার মধ্যে ৮০টিরও বেশি প্রস্তাবনায় সামগ্রিকভাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে রাজনৈতিক দলগুলো। পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ আরো ২০টির মত প্রস্তাবনা চিহ্নিত করে সেগুলো নিয়ে আলোচনা এখনো চলছে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘ওই ২০টির মধ্যে এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বিষয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বাকি প্রায় ছয় থেকে সাতটি বিষয় আমরা আলোচনা করেছি যেগুলো এখন পর্যন্ত আমরা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি’।
কমিশন বলছে, গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রস্তাবে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজী করানোর পর এগুলো নিয়েই তৈরি হবে জুলাই সনদ।
ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের এখন কতগুলো মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য দরকার। তা না হলে আবারো স্বৈরাচারের পুনরুত্থান আমরা ঠেকাতে পারবো না’।
অবশ্য ঐকমত্য কমিশন চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাবকে আপাতত জুলাই সনদ বললেও শেষ পর্যন্ত এটির নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছে।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, ‘এটা আসলে জাতীয় সনদ। আবার জুলাই সনদ এই অর্থে, যাতে জুলাই সনদ বললে আগামীতে বোঝা যাবে ২০২৪ জুলাইয়ে কি ঘটেছিল, যার প্রেক্ষিতে এই সনদ করতে হয়েছে। জাতীয় কিংবা জুলাই সনদ যে নামই থাকুক না কেন এই সনদ আগামী দিনে দেশের রাজনীতিতে মাইলফলক হিসেবেই থাকবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য এই সনদকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের দালিলিক ভিত্তি হিসেবেই দেখছেন। বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জুলাই আমাদের যে বার্তা দিল, সেটার একটা দলিল থাকা দরকার। সে জন্য জুলাই সনদ থাকা জরুরি।’
রাজনৈতিক ঐকমত্য নিয়ে প্রশ্ন: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় যে পাঁচটি প্রস্তাবে সব দল একমত হয়েছে, সেগুলো হলো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান সংশোধন করা এবং হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, এই আলোচনায় এখন গুরুত্বপূর্ণ ছয় থেকে সাতটি বিষয় রয়েছে, যেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনায় এখন পর্যন্ত আমরা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। তবুও সেগুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় দফার ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদে ভিন্ন ব্যক্তির নিয়োগ নিয়ে প্রস্তাবনা ছিল ঐকমত্য কমিশনের।
এছাড়াও জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ বা এনসিসি গঠন করে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োগের বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে। কিন্তু এসব বিষয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি বলে জানিয়েছেন বদিউল আলম মজুমদার।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার দ্বিতীয় দিনের আলোচনা শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘সব বিষয়েই যদি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে শতভাগ একমত হতে হয়, তবে আলোচনার কী প্রয়োজন ছিল?’ এই প্রশ্নে অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, তার মানে এই নয় যে এ নিয়ে আমরা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি বা এগুলো বাতিল হয়ে গেছে। এগুলো নিয়ে পরে আরো আলোচনা হবে। আমরা যথেষ্ট রকম আশাবাদী।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করছেন, সব ইস্যুতে সবাই একমত হবে বিষয়টি এমন নয়। আমরা দেখেছি সংস্কার কমিশনের কিছু প্রস্তাবনা নিয়ে ঐকমত্য হচ্ছে না। কারণ সবাই নিজেদের ‘বুলি’ এই সনদে দেখতে চায়। এটা করতে গেলে ঐকমত্য হবে না।
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন কীভাবে: রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হবে, সেটি কিভাবে বাস্তবায়ন হবে- এই প্রশ্নও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে সামনে আসছে। কেননা এ নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর।
সংস্কার প্রস্তাবগুলো যখন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করা হয়, তখন সেটি বাস্তবায়নের জন্য ছয়টি আলাদা বিকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। এক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে, নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে, নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে, গণপরিষদের মাধ্যমে, নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে এবং ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে।
ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের একমাত্র পথ হিসেবে জাতীয় সংসদের কথা বলেছে বিএনপি, সিপিবি-বাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব বা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে রয়েছে এনসিপির অবস্থান।
তবে, জামায়াত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল রাজনৈতিক ঐকমত্য পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। তাদের অবস্থান হলো, যদি শেষ পর্যন্ত সবার মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হয়, সব দলগুলো যদি তাতে স্বাক্ষর করে তাহলে আগামী নির্বাচিত সংসদে তা বাস্তবায়ন সম্ভব।
রাজনৈতিক দলগুলোর এই দ্বিধা-বিভক্ত অবস্থান জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথে বাধা হবে কী-না, সেই প্রশ্নও সামনে আসছে। তবে এই প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন খুব বেশি চিন্তিত নয় বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, ‘বিষয়ের দিক থেকে কি পরিবর্তন করা দরকার, সেটা আমরা চূড়ান্ত করে দিতে পারি। কিন্তু কিভাবে বাস্তবায়ন হবে সেই বিষয়টি আমরা নির্ধারণ করে দিতে পারি না। সেটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দল মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে’। ‘হোয়াট’ অ্যান্ড ‘হাউ’ এর মধ্যে আমরা হোয়াট’কে লক্ষ্য করে কাজ করছি। যদি ঐকমত্যে এনে একটা সনদ আমরা করতে পারি, তখন রাজনৈতিক দলগুলো পারষ্পারিক আলোচনার ভিত্তিতে তা বাস্তবায়নের একটা পথ নিশ্চয়ই তৈরি করতে পারবে।’
ভোরের আকাশ/এসএইচ