হাতিয়ায় ৫ হাজার জিও ব্যাগ লুট
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৫ ১০:৪৮ পিএম
নদীভাঙন রোধের কাজ বিলম্বের শঙ্কা
নাবিদ আকতার শাওন: হাতিয়া থেকে ফিরেমেঘনা নদীর ভাঙন থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ার নলের চর এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ট এলাকার অবকাঠামো রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রম বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট নদীর তীর ভাঙন রোধে প্রকল্প এলাকায় জমায়েত করা ৫ হাজারেরও বেশি জিও ব্যাগ লুট হয়ে যাওয়ায় এই শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নোয়াখালীর মাইজদী এলাকার বাসিন্দা জনৈক প্রকৌশলী খালেদুজ্জামান কর্তৃক জিও ব্যাগ লুট এবং সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বরত জেনারেল ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন ও নানা হুমকি দেওয়ার কারণে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা রয়েছে। তবু জিও ব্যাগ ফেলার দায়িত্বরত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এ ঘটনায় চুক্তি লঙ্ঘনকারী আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং-এর পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী প্রকৌশলী খালেদুজ্জামানের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে সরকারের দায়িত্বশীলদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ভুক্তভোগী এইচ এম আফজাল হোসেন।
জানা গেছে, প্যাকেজ-১১ নামে নোয়াখালীর হাতিয়ার নলের চর এলাকার ৩৭৭ মিটার মেঘনা নদীর তীরে জিও ব্যাগ ফেলার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), নোয়াখালী দরপত্র আহ্বান করে। প্রয়োজনীয় সকল কার্যক্রম সম্পন্নের পর খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড ওই কাজের মূল ঠিকাদার হিসেবে জিও ব্যাগ ফেলার কাজটি পায়। ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজটি শুরু হয়ে চলতি বছরের ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা। পরে খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড প্রায় ৯০ কোটি টাকার এই প্রজেক্টটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয় বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে। পরবর্তীতে বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড কাজটির সাব-কন্ট্রাক্ট দেয় আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। এজন্য বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এবং আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং-এর মধ্যে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের পক্ষে কোম্পানির ম্যানেজার (অপারেশন) বশির আহমেদ এবং আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং-এর পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী প্রকৌশলী খালেদুজ্জামান। এই চুক্তির আওতায় বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ৬২ লাখ ৭৩ হাজার ৫শ টাকা দেয় আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং-কে। সাড়ে চার হাজার জিও ব্যাগ বাবদ ১২ লাখ ৭৩ হাজার ৫শ টাকাসহ সর্বমোট ৬২ লাখ ৭৩ হাজার ৫শ টাকা নেয় আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং। যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই অর্থ দেওয়া হয়। এই চুক্তির আওতায় কাজ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে প্রথম বিল বাবদ ২২ লাখ ৫৬ হাজার একশ টাকার চেক দেয় আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং। কিন্তু এরইমধ্যে বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড জানতে পারে যে, এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করেনি আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং। তাদের যে পরিমাণ কাজ করার কথা ছিল তার চেয়ে অনেক কম কাজ করেছে। কাজ কম হওয়ার বিষয়টি আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং-এর কাছে জানতে চায় বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। এরপর আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং লিখিতভাবে কাজের একটি ফিরিস্তি দেয়। প্রথমদফা চুক্তি লঙ্ঘন হওয়ায় অনেক দেন-দরবারের পর অক্ষরে অক্ষরে কাজ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের সঙ্গে আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং দ্বিতীয় দফা চুক্তি করে। এ পর্যায়ে সাড়ে চার হাজার জিও ব্যাগ ফেলতে গত ৭ জানুয়ারি ১২ লাখ টাকা নেয় আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং। কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করার লক্ষ্যেই বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এই অর্থ দেয় বলে জানা গেছে। কিন্তু এই টাকা নেওয়ার পর আর কোনো কাজ করেনি আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং। এমন অবস্থায় পাউবো এবং খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিডেটের পক্ষ থেকে বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন করার জন্য। এ কারণে বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং-এর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এমন প্রেক্ষাপটে আল-খায়ের ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাক্টিং-এর স্বত্বাধিকারী নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প এলাকায় বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার এইচ এম আফজাল হোসেনের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে এইচ এম আফজাল হোসেন গত ১০ ফেব্রুয়ারি হাতিয়া থানায় একটি অভিযোগ দাখিল করেন। এতে বলা হয়, অবৈধভাবে টাকা হাতানোর অপচেষ্টা করছে প্রকৌশলী খালেদুজ্জামান চক্র। তিনি এবং তার লোকজন সরকারি এই কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন। জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন তারা। এখানকার জিনিসপত্র দিয়ে তারা অন্যত্র কাজ করছেন।
জানা যায়, এত কিছুর পরও যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন করতে বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড বিপুল সংখ্যক জিও ব্যাগ এক দিনে প্রকল্প স্থানে পাঠায়। কিন্তু গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ৫ হাজার একশ ৭৩টি জিও ব্যাগ লুট হয়। অভিযোগ উঠেছে এই লুটের সঙ্গে প্রকৌশলী খালেদুজ্জামান ও তার নিয়োজিত লোকজন জড়িত।
বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড-কে বিপদে ফেলতে জিও ব্যাগ লুট করা হয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারিতে জোরপূর্বক একটি ট্রাক ভর্তি জিও ব্যাগ লুট করে নিয়ে যায় নোয়াখালী জেলার মাইজদীর স্থানীয় বাসিন্দা খালেদুজ্জামান এবং তার লোকজন। এ নিয়ে হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উভয়পক্ষকে ডেকে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে উদ্যোগ নেন। এরপরও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জিও ব্যাগ ফেরত দেননি খালেদুজ্জামান।
জানা যায়, মাইজদী উপজেলার বাসিন্দা প্রকৌশলী খালেদুজ্জামান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেকে বিএনপির বলে প্রচারণা চালান। সর্বশেষ তিনি নিজেকে নোয়াখালী জেলার সমন্বয়ক বলে দাবি করছেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রকৌশলী খালেদুজ্জামান জিও ব্যাগগুলো নিয়ে গেছেন। তিনি পরে ব্যাগগুলো আবার ফিরিয়ে দেবেন বলে জানিয়ে গেছেন।
প্রজেক্ট এ কর্মরত মো. সামচুল আলম জানান, দুই পক্ষের মধ্যে টাকা নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু সেই টাকার পরিমাণ ছিল ২২ লাখ টাকা। কিন্তু খালেদুজ্জামান দাবি করছেন ১ কোটি টাকা। তিনি আরো জানান, প্রায় ১৫ লাখ টাকার জিও ব্যাগ লুট করে নিয়ে গেছেন খালেদুজ্জামান ও তার লোকজন।
বেঙ্গল বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার এইচ এম আফজাল হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, আমাদের কোম্পানির ৫ হাজারের বেশি জিও ব্যাগ লুট হয়েছে। আমার ওপর হামলা হয়েছে। আমাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এসব ঘটনায় হাতিয়া থানায় অভিযোগ দিয়েছি। তিনি বলেন, এতে প্রকল্পের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। তারপরও বলবো, যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন করতে আমাদের প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে আমি প্রত্যাশা করবো, আমার ওপর হামলা ও জিও ব্যাগ লুটের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেবে প্রশাসন।
ভোরের আকাশ/মি