নিমিউ অ্যান্ড টিসি
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫ ১২:৫৭ এএম
ছবি: সংগৃহীত
মেডিকেল যন্ত্রপাতি মেরামত ও স্থাপনসহ কয়েক দফা দাবির আন্দোলনে উত্তপ্ত বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সময়ক্ষেপণ না করে ওই হাসপাতালে ছুটে গেলেন ন্যাশনাল ইলেকট্রো ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) কারিগরি টিমের সাত সদস্য। চারদিন অক্লান্ত পরিশ্রম ও দক্ষতা দেখিয়ে তারা সচল করে তুললেন হাসপাতালের ৯৫টি মেশিন। দুশ্চিন্তা দূর হলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। সেবা পেয়ে স্বস্তি ফিরে পেলেন রোগীরা। এভাবে শুধু একটি হাসপাতাল ও ৯৫টি মেশিন নয়, সারাদেশের ৪০ হাজারের বেশি উচ্চ প্রযুক্তির মেশিন দক্ষতার সঙ্গে মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও চালু রেখেছেন নিমিউ অ্যান্ড টিসির মাত্র ৪৪ কর্মী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিমিউ অ্যান্ড টিসিতে সারাদেশের সরকারি হাসপাতালসমূহের মেডিকেল যন্ত্রপাতি মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও চালু করা হয়। চাহিদা অনুযায়ী মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয়। মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয় সংক্রান্ত দরপ্রস্তাবের কারিগরি মূল্যায়ন এবং অনুরূপ কাজে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করা হয়। ক্রয় ও আমদানি করা মেডিকেল যন্ত্রপাতির সার্ভে করা ও গুণগতমান নিশ্চিত করা হয়।
মেডিকেল যন্ত্রপাতি সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে নিমিউ, ডিমিউ ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কারিগরি জনবলকে প্রশিক্ষণ প্রদান হয়। দেশের বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইলেকট্রো-মেডিক্যাল টেকনোলজিতে অধ্যয়ন ও পাস করা শিক্ষার্থীদের মেডিকেল যন্ত্রপাতি মেরামত সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ অধ্যয়ন ও পাস করা শিক্ষার্থীদের মেডিকেল যন্ত্রপাতি মেরামত সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। আর মেরামতযোগ্য মেডিকেল যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
১৯৮৩-৮৪ সালে প্রকল্পের মাধ্যমে ৮৩টি পদ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নিমিউ অ্যান্ড টিসি। ১৯৮৭ সালের পহেলা জুলাইয়ে তা রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে এডিবি সাহায্যপুষ্ট দ্বিতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রকল্পে প্রতিষ্ঠানটির জন্য ১২টি পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৯৯ সালের পহেলা জুলাইয়ে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হয় অর্থাৎ মোট পদ হয় ৯৫টি। আর ওই সময় মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ছিল প্রায় ৬০০০ যা ছিল সরল ও স্বল্প প্রযুক্তির। বর্তমান জনবলের সংখ্যা ৪৪।
কিন্তু মেডিকেল যন্ত্রপাতির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪০ হাজারের বেশি। আর এসব যন্ত্রপাতির অধিকাংশই উচ্চ প্রযুক্তির। এমন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিমিউ এর সীমিত জনবল দিন রাত নিরলস পরিশ্রম করে সারাদেশের মেডিকেল যন্ত্রপাতির প্রায় ৯০ শতাংশ সচল রেখেছে। বাকি ১০ শতাংশের কিছু মেরামতের প্রক্রিয়াধীন (ফল্ট ডায়গনসিস, খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি প্রক্রিয়া ইত্যাদি) রয়েছে এবং কিছু মেশিনের প্রত্যাশিত কার্যসক্ষমতা না থাকায় ডিসপোজালের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
নিমিউ অ্যান্ড টিসির গুরুত্ব দেশের ক্রান্তিলগ্নে উপলব্ধি করা যায়। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুর্যোগ যেমন- কোভিড-১৯ কালীন দেশের সর্বাগ্রে ৩১টি ঠওঊ প্ল্যান্ট স্থাপন করে হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে কোভিড নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। দুই শতাধিক ডায়ালাইসিস মেশিন, তিন শতাধিক আইসিইউ ভেন্টিলেটর মেরামতপূর্বক সচল করে লাইফ সেভিং কার্যক্রম জোরদার করেছে।
২০২৪ গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের হাসপাতালগুলোতে সিটি স্ক্যান, এক্সরে মেশিনসহ প্রয়োজনীয় মেশিনসমূহ সচল রেখে সর্বোত্তম রোগীসেবা নিশ্চিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে নিমিউ। এরই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ উদাহরণ শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বরিশালে এক সপ্তাহে ৯৫-এর অধিক মেশিন মেরামতপূর্বক সচল করে নিমিউ অ্যান্ড টিসির স্বক্ষমতার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে।
নিমিউ অ্যান্ড টিসির ক্রয় প্রক্রিয়াও প্রায় শতভাগ ই-জিপিতে হয় এবং এখানে প্রায় অর্ধ শতাধিক কোম্পানি কাজ করে বিধায় এখানে কাজে শুুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্বচ্ছ ও সর্বোত্তম ক্রয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। সরকারও বসে নেই, ২০২১ সালে নিমিউ অ্যান্ড টিসির জন্য রাজস্ব খাতে ২৫১টি নতুন পদ সৃজিত হয়। বর্তমানে নিমিউ অ্যান্ড টিসির সর্বোমোট পদসংখ্যা-৩৪৬টি। শূন্য পদে নিয়োগও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
নিয়োগসম্পন্ন হলে এবং ১৮টি জেলা (পুরাতন) সদরে স্থাপিত ইলেকট্রো-মেডিকেল ওয়ার্কশপের ১৬২টি পদের (যা ইতোমধ্যেই নিমিউর অর্গানোগ্রাম ভুক্ত করা আছে) প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ঘঊগঊগড এর অধীনে ন্যস্ত করা হলে-
১. ডিমিউ এর বর্তমান জনবলের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হবে,
২. ডিমিউ এর বর্তমান জনবলের পদোন্নতির সুযোগ হলে কাজে গতিশীলতা আসবে,
৩. ফাঁকা পদগুলোতে জনবল নিয়োগ দিল নিমিউর বিভাগীয় অফিসগুলো পূর্ণরূপে চালু করা সম্ভব হবে,
৪. ১৬২টি পদের মধ্যে ৭২টি উপ-সহকারী প্রকৌশলীর (১০ম গ্রেড) পদ। উক্ত পদসমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে নিমিউর নবসৃষ্ট ২৫১টি পদে কোনো উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদ সৃজন করা হয়নি। এখানে ডিপ্লোমা-ইন ইলেকট্রো মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে।
৫. মেডিকেল যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে মেরামত হবে এবং কোয়ালিটেটিভ ও কোয়ান্টিটেটিভ রোগীরসেবা নিশ্চিত হবে।
৬. চিকিৎসার জন্য দেশের জনগণের বিদেশ নির্ভরতা কতে আসবে। মানুষের সময় সেভ হবে, পেরেশানি কমে যাবে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মশিউল মুনীর’র বিশেষ অনুরোধে গত সপ্তাহে নিমিউ অ্যান্ড টিসি থেকে ৫ সদস্যের কারিগরি টিম হাসপাতালে যান। তারা সকল মেশিন সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। পরবর্তীতে হাসপাতালের নিজস্ব টেকনিশিয়ানের সঙ্গে নিমিউ অ্যান্ড টিসি থেকে আরো ২ জন টেকনিশিয়ানকে এনে এই কারিগরি টিমে সংযুক্ত করেন পরিচালক।
কারিগরি টিমের সদস্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী (অপটিক্যাল) হাফিজুর রহমান বলেন, গত চার দিন ধরে নিমিউ অ্যান্ড টিসি থেকে আসা টিম ৬টি অ্যানেস্থেসিয়া মেশিন, ২৫টি সাকশন মেশিন, ১০টি আইসিইউ ভেন্টিলেটর, ৫টি অটোক্লেভ, ১টি সি-আর্ম মেশিন, ২টি মনিটার, ৮টি ওটি টেবিল, ৫টি ব্লাড ব্যাংক রেফ্রিজারেটর, ১০টি হাই ফ্লো নাসাল ক্যানুলা, ৫টি আইসিইউ বেড, ৬টি ওটি লাইট, ৫টি ডেন্টাল ইউনিট, ২টি ডায়াথার্মি মেশিন, ৪ ইসিজি মেশিন ও ১টি এক্সরে মেশিনসহ ৯৫টি মেশিন মেরামত শেষে সচল করতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের ১টি করে ইকো, কার্ডিয়াক ডিফাইব্রিলেটর, কার্ডিয়াক মনিটার, ইসিজি ক্যাথল্যাব (এনজিওগ্রাম), সিটি স্ক্যান, চোখের লেসিক, চোখের ফ্যাকো, অপটিক্যাল কোহেরেন্স টমোগ্রাফি (ওসিটি), ইউরোলজি লিথোরিপটর, আরো ১টি সি-আরম, ২টি করে এক্সরে, এন্ডোসকপি মেশিন মেরামত শেষে চালু করা হবে। এই মেশিনগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমাদের দেশে না থাকায় বিদেশ থেকে সরবরাহ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সে জন্য সময় দিতে হবে। দক্ষ টেকনোলজিস্ট কিংবা জনবলের অভাবে দীর্ঘ দিন মেশিনগুলো বন্ধ থাকায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেশিন মেরামতের কাজে অংশ নেওয়া ন্যাশনাল ইলেকট্রো ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি বাকি ৬ সদস্য হলেন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) শুভদেব সরকার, উপ-সহকারী প্রকৌশলী (ইলেকট্রনিক্স) অপু সরকার, উপ-সহকারী প্রকৌশলী (আরএসি) মো. মাহাবুব হোসেন, টেকনিশিয়ান (ইলেকট্রনিক্স) মো. তৌহিদুর জামান, টেকনিশিয়ান আওলাদ হাসান ও টেকনিশিয়ান কাউছার হোসেন।
হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট মিথুন রায় বলেন, হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রসহ রেডিওলজি এবং ইমেজিং, প্যাথলজি, সিসিইউ, আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটার, চক্ষু বিভাগ, সাজারি ও নাক-কান-গলা বিভাগের প্রায় শতাধিক মেশিন সচল করা হয়েছে। মেশিনগুলো রোগীরা যেমনি সেবা পাচ্ছেন, তেমনি আমরাও সেবা দিতে পারছি।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মশিউল মুনীর বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের অনেক মেশিন অকেজো অবস্থায় ছিল। সেগুলো মেরামত করে সচল করা হয়েছে।
গত শনিবার দুপুরে নিমিউ অ্যান্ড টিসি থেকে আসা ৭ সদস্যের কারিগরি টিম টিম জরুরিভিত্তিতে ৯৫টি অকেজো মেশিন সচল করে আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। আমরা মেশিনগুলো রোগীর সেবায় কাজে লাগাচ্ছি। বাকি মেশিনগুলো সচল করতে যন্ত্রাংশ আমদানি করার ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়েছে। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন।
এছাড়া রোগী সেবার মান বৃদ্ধির জন্য আমরা আগামী সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের মধ্যে ১টি এমআরআই মেশিন, ক্যাথ ল্যাব ও সি-আম মেশিন পেতে যাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সফলতার কথা কেউই বলে না। আর সেবা জোর করে হয় না, ভালোবাসা দিয়ে নিতে হয়। সমস্যা হলে ধৈর্য ধরতে হয়। মানুষকে বুঝতে হবে হাসপাতালে রোগী সেবার জন্য যে পরিমাণে জনবল প্রয়োজন তা আমাদের নেই। তাই সবাইকে এ ব্যাপারে যেমনি সবাইকে সচেতন হতে হবে, তেমনি আমাদের সহযোগিতা করতে হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ