বিশ্ব রাজনীতিতে নয়া বাঁকবদল
ভূ-রাজনীতিতে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। দৃশ্যমান হয়ে উঠছে নতুন মেরুকরণ। একটি কৌশলগত ও প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠছে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)। তিন মহারথী চীন, রাশিয়া ও ভারত-এই প্ল্যাটফর্মের প্রাণ। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (ন্যাটো) বিকল্প হিসেবে উঠে আসার সম্ভাবনা জাগাচ্ছে এসসিও। গত সোমবার শেষ হওয়া ‘এসসিও’ সম্মেলনে চীন ও রাশিয়া নানাভাবে এটাকে ‘ন্যাটো’ এর বিকল্প হিসেবে তুলে ধরেছে।বিশ্লেষকরা বলছেন, এসসিও সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র প্রধানরা পশ্চিমা প্রভাবিত নিরাপত্তা কাঠামো থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়ে একটি নতুন বহুপাক্ষিক ইউরেশিয় জোট গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। এটি হবে চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ বৃহৎ ইউরেশিয় শক্তিগুলোর সমন্বয়ে একটি কৌশলগত ও প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা প্ল্যাটফর্ম।রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও রাশিয়া এসসিও-কে প্রায়ই ন্যাটোর বিকল্প হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বেইজিং ও মস্কো এই প্ল্যাটফর্মকে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে।কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভূ-রাজনীতির মাঠে সফলতা পাচ্ছেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বরং সংকুচিত হয়ে পড়ছে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্র। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই সাম্রাজ্যবাদী ‘মন্তব্য ও সিদ্ধান্ত’ গ্রহণ করে চলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত বিশেষ করে শুল্কারোপ ইস্যু বিশ্বের তিন মহারথী চীন, রাশিয়া ও ভারতকে একই ছাতার নিচে নিয়ে যাচ্ছে।চীনের তিয়ানজিনে গত সোমবার সমাপ্ত হয়েছে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলন (এসএসিও)। আর সেই সম্মেলনে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে মার্কিনবিরোধী ভূ-রাজনীতির বার্তা দিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চলতি বছরের সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে এক অস্থির বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে। যার মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে, গাজায় ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তাজনিত উত্তেজনা এবং ট্রাম্পের বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ রয়েছে।বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব যখন স্পষ্টতই গভীর অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে, তখন বিশেষ করে চীন বা রাশিয়া এ যুক্তি তুলতে পারে যে বিশ্ব এখন একাধিক সংকটের যুগে প্রবেশ করছে এবং সামনে এগোনোর পথ হিসেবে জোট নিরাপত্তা ধারণাটিই তারা তুলে ধরবে।রয়টার্স জানায়, চীনে গত সোমবার অনুষ্ঠিত হওয়া যাওয়া এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ ২০ জনেরও বেশি বিশ্ব নেতা যোগ দিয়েছেন।এসসিও’র সদস্য দেশগুলো হলো- চীন, ভারত, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও বেলারুশ। এছাড়াও, আরও ১৬টি দেশ পর্যবেক্ষক বা ‘সংলাপ সহযোগী’ হিসেবে এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। উদ্বোধনের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আঞ্চলিক নেতাদের ঠাণ্ডা যুদ্ধের মানসিকতার বিরোধিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে বেইজিং যে নিরাপত্তা ব্লক গঠনের চেষ্টা করছে, তাতে সবাইকে এক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।শি বলেন, ‘বিশ্ব ক্রমবর্ধমান জটিল এবং জটিল হয়ে উঠছে। তাই সদস্য রাষ্ট্রগুলো কঠিন নিরাপত্তা ও উন্নয়ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।’গত শনিবার এক সাক্ষাৎকারে পুতিন বলেন, ‘এসসিও আজকের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর প্ল্যাটফর্ম। এটি ইউরেশিয়ায় সংহতি ও বহুমুখী শক্তি নির্ভর নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। এই সম্মেলন ‘সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ ও হুমকি মোকাবিলায় এসসিও-এর সক্ষমতা বাড়াতে এবং সমগ্র ইউরেশীয় অঞ্চলে সংহতি জোরদার করতে’ সহায়ক হবে। এসব উদ্যোগ বিশ্বকে আরো ন্যায়পরায়ণ ও বহুমুখী শক্তির বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগিয়ে নেবে।’চীনের তিয়ানজিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন। যেখানে দুই নেতাই চীন-ভারতের মধ্যে আস্থা ও সম্পর্ক গভীর করার কথা বলেছেন।সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ডিলান লো বলেন, ‘চীন দীর্ঘদিন ধরে এসসিও-কে একটি পশ্চিমাবিরোধী ক্ষমতাধর জোট হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তারা দাবি করে এই জোট এক নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে যা আরো গণতান্ত্রিক।’২০০১ সালে এসসিও প্রতিষ্ঠার পর এবারই জোটটির সবচেয়ে বড় আসর বসেছে। এতে যোগ দিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানসহ ২০জনের বেশি শীর্ষ নেতা।লো আরও বলেন, ‘এত বিশাল সংখ্যক দেশের অংশগ্রহণ প্রমাণ করছে যে চীনের প্রভাব বাড়ছে এবং পশ্চিমা-বহির্ভূত দেশগুলোর জন্য এসসিও একটি আকর্ষণীয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।’এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের লিজি লি বলেন, বেইজিং এসসিও’র মাধ্যমে ‘প্রভাব বিস্তার করার এবং এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করবে যে ইউরেশিয়ার নিজের প্রতিষ্ঠান আছে এবং নিজের নিয়মে খেলা চলে।’তিনি বলেন, ‘চীন এটিকে সার্বভৌমত্ব, একে অন্যের ওপর হস্তক্ষেপ না করা এবং বহুমুখী শক্তির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ভিন্ন ধরনের এক ব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করছে। দেশটি এটিকে একটি আদর্শ মডেল হিসেবে প্রচার করছে।’জাপানের সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পূর্ব এশিয়া বিশেষজ্ঞ লিম তাই ওয়েই বলেন, ‘বিশ্ব মঞ্চের একজন খেলোয়াড় হিসেবে এসসিও থেকে পাওয়া সব ধরনের সুবিধা রাশিয়ার প্রয়োজন। পাশাপাশি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির সমর্থনও তার দরকার।’তিনি বলেন, ‘রাশিয়া ভারতকেও নিজেদের পক্ষে টানতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বিরোধ এই সুযোগ তৈরি করেছে।’যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কী বার্তা আছে?ট্রাম্প গ্লোবাল সাউথ থেকে আসা সংগঠনগুলোর ব্যাপক সমালোচক ছিলেন। অতীতে তিনি ব্রিকসকে দুর্বল করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে লক্ষ্যভিত্তিক শুল্ক আরোপ এবং এই জোটকে ‘অ্যান্টি-আমেরিকান’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।এসসিও সম্মেলনের একদিন আগে হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও জনপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলেজান্দ্রো রেয়েস বলেন, এসসিও সম্মেলনকে যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং এটি এ বছর পরে ভারতের আয়োজনে অনুষ্ঠিতব্য কোয়াড সম্মেলনের বিষয়টিও ঠিক করে দিতে পারে।ন্যাটো কী, সদস্য কারা?দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং আরও ৮টি ইউরোপীয় দেশসহ ১২ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য একে অপরকে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে উত্তর আটলান্টিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন(ন্যাটো) মূলত সামরিক সহযোগিতার জোট। পরে কয়েক দশক ধরে জোটটি বড় হতে থাকে। বর্তমানে ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ৩০। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৭ মার্চ ন্যাটোতে যোগ দেয় উত্তর মেসিডোনিয়া। আর ২০০৯ সালের ০১ এপ্রিল আলবেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া যোগ দেয়। ন্যাটো হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক সংগঠন। ন্যাটোর সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর খরচ পৃথিবীর সব দেশের সামরিক খরচের প্রায় ৭০ ভাগ। ন্যাটো-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের হাত থেকে পশ্চিম বার্লিন এবং ইউরোপের নিরাপত্তা বাস্তবায়ন করা। ন্যাটো একটি যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি, যে চুক্তির আওতায় জোটভুক্ত দেশগুলো পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার পর ন্যাটো তাদের রক্ষায় মাঠে নামে। এর প্রত্যেকটি সদস্য রাষ্ট্র তাদের সামরিক বাহিনীকে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখতে বদ্ধপরিকর। ন্যাটোর ৩০ সদস্য দেশ হলো-আলবেনিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, কানাডা, ক্রোয়েশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, ইতালি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মন্টিনেগ্রো, নেদারল্যান্ডস, উত্তর মেসিডোনিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, স্পেন, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।ভোরের আকাশ/এসএইচ