নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০২:৫১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
ভূ-রাজনীতির মাঠে সফলতা পাচ্ছেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বরং সংকুচিত হয়ে পড়ছে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্র। কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই সাম্রাজ্যবাদী ‘মন্তব্য ও সিদ্ধান্ত’ গ্রহণ করে চলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত বিশেষ করে শুল্কারোপ ইস্যু বিশ্বের তিন মহারথী চীন, রাশিয়া ও ভারতকে একই ছাতার নিচে নিয়ে যাচ্ছে। চীনের তিয়ানজিনে গতকাল সোমবার সমাপ্ত হয়েছে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলন (এসএসিও)। আর সেই সম্মেলনে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে মার্কিনবিরোধী ভূ-রাজনীতির বার্তা দিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ দীর্ঘদিনের। এবার যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটে পড়েছে ভারত। রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে রয়েছে বহু বছরের বন্ধুত্বের সুসম্পর্ক। এতদিন সীমান্ত সমস্যাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধ থাকলেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণাত্মক আচরণে কাছাকাছি চলে এসেছে চীন ও ভারত। এভাবে বেশি মাত্রায় চাপপ্রয়োগ করতে গিয়ে এশিয়ার তিন মহারথী ‘চীন-রাশিয়া-ভারত’কে ঐকমত্যে আসার পরিবেশ সৃষ্টি করে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বিশ্ববাণিজ্যকে এলোমেলো করে দিয়েছেন, তখন ভারত, চীন ও রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এমন এক লক্ষণ এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। তারই অংশ হিসেবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গত ৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিয়ানজিনে একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা সম্মেলনে বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশের নেতাদের মিলনমেলা হয়ে গেছে। এই সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনকে বলা হচ্ছে ‘গ্লোবাল সাউথ সংহতি’র এক শক্তিশালী প্রদর্শন। একই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞায় বিপর্যস্ত রাশিয়াকে কূটনৈতিক মঞ্চে নতুন করে সুযোগ করে দিয়েছে এই বৈঠক। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ছাড়াও মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতাদের আমন্ত্রিত ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য এটি ছিল সাত বছরের মধ্যে প্রথম চীন সফর।
২০২০ সালের প্রাণঘাতী সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, তা প্রশমনে এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত বছর রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে সর্বশেষ এক মঞ্চে গিয়েছিলেন শি, মোদি ও পুতিন। তখন পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার নেতা পুতিনকে এড়িয়ে চললেও এবার এসসিওতে মস্কো আশা করছে, ভারত ও চীনের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হবে। চায়না-গ্লোবাল সাউথ প্রজেক্টের প্রধান এরিক ওল্যান্ডার বলেন, শি জিনপিং এই সম্মেলনকে ব্যবহার করতে চান নতুন এক ‘পোস্ট-আমেরিকান’ বিশ্বব্যবস্থার চিত্র দেখাতে। জানুয়ারি থেকে হোয়াইট হাউস চীন, ইরান, রাশিয়া- এমনকি ভারতকেও প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তা কাঙিক্ষত ফল দেয়নি।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় এসসিও সম্মেলন। নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম থেকে শুরু করে অর্থনীতি ও সামরিক সহযোগিতায় ব্লকটির কার্যপরিধি বেড়েছে। বর্তমানে ১০ স্থায়ী সদস্য ছাড়াও ১৬টি ডায়ালগ ও পর্যবেক্ষক দেশ রয়েছে।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও তার শুল্কের রোষানল থেকে রেহাই পাননি। ট্রাম্প প্রশাসনের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ, বাণিজ্যিক হুমকি এবং একতরফা নীতি প্রয়োগে চাপে পড়েছে প্রায় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ। তবে এবার এসব চাপ ও হুমকিকে গুরুত্ব না দিয়ে একজোট হতে পারে বিশ্বের অন্যতম তিন মহাশক্তি রাশিয়া-চীন ও ভারত। মার্কিন বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে একসঙ্গে কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছে রাশিয়া-চীন ও ভারত। যা বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুনমাত্রা যোগ করতে পারে।
দীর্ঘ ছয় বছর পর চীন সফরে করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সফরের ঘোষণা এমন এক সময় এলো যখন এক সময়ের কৌশলগত মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এক প্রকার তলানিতে। রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখায় ভারতের ওপর আবারও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প।
এ নিয়ে সম্প্রতি ক্রেমলিনে রুশ প্রশাসনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘আমরা (ট্রাম্পের) অনেক বিবৃতির কথাই শুনছি, যেগুলো আসলে হুমকি। বিভিন্ন দেশকে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমরা এই বিবৃতিগুলোকে বৈধ এবং ন্যায্য বলে মনে করছি না।’
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, পেসকভের বক্তব্যে কোথাও সরাসরি ভারতের নাম উল্লেখ করা না হলেও ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ যে ট্রাম্পের শুল্কবাণের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির পাশে দাঁড়াচ্ছে, তা স্পষ্ট।
এর আগে, ২০২৪ সালে অক্টোবরে রাশিয়ায় ব্রিকসের সম্মেলনে মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে বৈঠক হয়। এ বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমনে নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতার শুরু হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের একতরফা নীতির কারণে বিশ্বের কূটনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট হচ্ছে। এই মুহূর্তে চীন, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে নতুন এক মেরুকরণ গড়ে উঠছে। যা ভবিষ্যতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। ট্রাম্প নতুন করে ভারতের ওপর ঘোষিত অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্কারোপে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে চীনও। নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত জু ফেইহং এক্সে দেওয়া পোস্টে ট্রাম্পকে ‘মাস্তান’ বলে কটাক্ষ করেন।
তিনি লেখেন, ‘মাস্তানকে এক ইঞ্চি জায়গা দিলে মাইলকে মাইল দখল করে নেবে।’ তার মতে, শুল্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অন্য দেশগুলোকে দমন করার চেষ্টা জাতিসংঘের বাণিজ্য নীতির পরিপন্থি এবং এই ধরনের পদক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
এদিকে, শুল্কারোপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, দেশের কৃষকদের স্বার্থে কোনো আপস করবেন না। সে জন্য তাকে অনেক মূল্য দিতে হতে পারে। তিনি প্রস্তুত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদুল আলম বলেন, বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যেখানে কেবল সামরিক শক্তি ব্যবহারই তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে পারে। এখানে সত্যিকার অর্থে শান্তি প্রতিষ্ঠা, পারস্পরিক সহাবস্থান এবং শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি করার মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব চীন ও রাশিয়ার মতো দেশকেও উগ্রপন্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক অস্থিরতার মধ্যেই শি, পুতিন ও মোদির উপস্থিতি নি:সন্দেহে গ্লোবাল সাউথের অর্থনীতি ও নিরাপত্তা নিয়ে শক্তিশালী সংহতির একটি বার্তা। পাশাপাশি, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা বিশ্বে একঘরে হয়ে পড়া রাশিয়ার জন্য এটি একটি কূটনৈতিক সাফল্য।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির এ সফরও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রায় সাত বছর পর তিনি চীন গেছেন। ২০২০ সালে সীমান্ত সংঘাতের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে উত্তেজনা প্রশমনের উদ্যোগ নেওয়ায় শি-মোদি বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এ বৈঠক সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার, বাণিজ্যিক ছাড় এবং ভিসা নীতি সহজীকরণের মতো ঘোষণার পথ খুলে দিতে পারে।
ভারতকে বশ মানাতে গিয়ে উল্টো বিপদে ট্রাম্প
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ভেবে থাকেন যে তিনি ভারতকে বশে আনতে পারবেন, তবে ঘটনাপ্রবাহ মোটেও তার পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদি শুধু অনমনীয় অবস্থানই নেননি, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কার্যত নীরব আচরণও দেখাচ্ছেন।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্টের শুরুর দিকে ট্রাম্প অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতকে কঠোর দ্বৈত শুল্কের আওতায় নেওয়ার পর থেকে তিনি চারবার মোদিকে ফোন করেছেন-এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ফোন ধরতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এই সময়ে মোদি দুবার তার ‘বন্ধু’ ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মস্কোয় পাঠিয়েছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আয়োজিত এক নিরাপত্তা সম্মেলনে মোদি অংশ নিয়েছেন, যা অনুষ্ঠিত হয়েছ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর তিয়ানজিনে। দীর্ঘদিনের দূরত্ব সত্ত্বেও বর্তমান পরিস্থিতি তাদের মধ্যে আলোচনা আয়োজন করেছে।
২০০১ সাল থেকে ওয়াশিংটন চেষ্টা করে আসছে ভারতকে তাদের প্রভাববলয়ে আনতে; উদীয়মান চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে। কিন্তু ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে আগুনে লাগিয়ে দিয়েছেন; প্রথমে ভারতীয় রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, এরপর রাশিয়ান তেল কেনার কারণে দিল্লিকে শাস্তি দিতে দ্বিগুণ চাপ প্রয়োগ করে। এটি ব্রাজিল ছাড়া অন্য কোনো দেশের ওপর ওয়াশিংটনের আরোপিত সবচেয়ে কঠোর ব্যবস্থা।
এর সঙ্গে ট্রাম্প অপমানের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন বন্ধুত্ব গড়ে তুলে, যে দেশ ভারতের চরম শত্রু। তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ও কার্যত দেশটির প্রধান শাসক আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজে পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মোদি রয়েছেন কার্যত বিচ্ছিন্ন অবস্থায়।
বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন, এত সরল ও কঠোরভাবে শক্তি প্রয়োগ করে ট্রাম্প উল্টো ফল ডেকে আনছেন-ভারতকে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলছেন মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ