নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক
রাজীব দাস
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫ ১০:১৭ এএম
সংগৃহীত ছবি
গত বৃহস্পতিবার থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্ত এলাকায় দুই দেশের মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষ শুরু হয়, যা শুক্রবার সকালেও অব্যাহত রয়েছে। এই সশস্ত্র সংঘাত দুই দেশের দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিতর্কে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সংঘর্ষে দুইপক্ষই একে অপরকে দায়ী করেছে এবং ভারী অস্ত্র, রকেট এবং বিমান হামলায় জড়িয়ে পড়েছে।
সীমান্তের বিতর্কিত অঞ্চলগুলোতে সংঘর্ষ শুরু হয় হালকা অস্ত্রের গুলিবর্ষণ দিয়ে। কিন্তু খুব দ্রুত পরিস্থিতি কঠিন হয়ে ওঠে এবং উভয়পক্ষ ভারী অস্ত্র যেমন ফিল্ড আর্টিলারি, বিএম-২১ রকেট সিস্টেম ব্যবহার করে গোলাবর্ষণ চালায়। থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী জানায়, কম্বোডিয়ার সেনারা প্রথমে টানা গোলাবর্ষণ করে, যার জবাবে তারা পাল্টা হামলা চালায়। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে অন্তত ছয়টি ভিন্ন স্থানে, যেখানে সীমান্তের মানুষ মারাত্মক সংকট ও ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়েছে।
ছয়টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান নিয়ে থাইল্যান্ড সীমান্ত এলাকায় খুঁটি গেড়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে এই বিমানগুলোর একটি কম্বোডিয়ার সামরিক অবস্থানে বোমা হামলা চালায়। থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষের দাবি, সেটার লক্ষ্য ছিল বিশেষ সংগঠিত সামরিক লক্ষ্যবস্তু। তবে এই যুদ্ধবিমান হামলায় বেসামরিক জনগণও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনাকে কম্বোডিয়া ‘বেপরোয়া ও নৃশংস সামরিক আগ্রাসন’ হিসেবে বর্ননা করেছে।
থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সংঘর্ষে তাদের কমপক্ষে ১২ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ১১ জন বেসামরিক মানুষ এবং ৮ বছরের এক শিশু রয়েছে। আহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অপরদিকে, কম্বোডিয়ার পক্ষ থেকে হতাহতের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ পায়নি। তবে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো থেকে শিশু, প্রবীণ ও নারীসহ হাজার হাজার মানুষ নিরাপদ স্থানে সরে এসেছে বলে তার জানায়। বালির বস্তা ও টায়ার দিয়ে তৈরি কংক্রিট বাংকার বা শরনার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে তারা।
এর আগে, গত বুধবার থাইল্যান্ড সরকার কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে এবং নিজের রাষ্ট্রদূতকে নমপেন শহর থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর আগে, থাইল্যান্ড দাবি করেছিল যে কম্বোডিয়ার সেনারা স্থলমাইন পুঁতে রেখেছিল, যার বিস্ফোরণে এক থাই সেনা সদস্য পা হারিয়েছেন। কম্বোডিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করে ‘মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেছে। তখন থেকেই দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক অবনতি হতে শুরু করে। কূটনৈতিক টানাপোড়েনও বেড়ে যায়।
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি লিখিত চিঠি পাঠিয়ে থাইল্যান্ডকে ‘অভিযোগহীন ও পূর্বপরিকল্পিত সামরিক আগ্রাসনের’ দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি জাতিসংঘকে দ্রুত একটি জরুরি বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মহল উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে থাইল্যান্ডের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ দ্রুত সহিংসতা বন্ধে আহ্বান জানিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপমুখপাত্র টমি পিগট এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, বেসামরিক লোকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর তারা গভীরভাবে শোকাহত ও উদ্বিগ্ন। তিনি বলছেন, দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একত্রিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাই এক বিবৃতিতে বলেন, তারা শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়েছে প্রতিক্রিয়া জানাতে।
তিনি বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তবে এর বাইরে অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান, যেন আলোচনার মাধ্যমে সংহতি বৃদ্ধি এবং সংঘাত সমাধানের পথ খোলা হয়। কম্বোডিয়া সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে কঠোর অবস্থানে রয়েছে এবং জাতিসংঘে এই ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে।
গতকাল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর ছিল যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অতি জরুরি আলোচনার মাধ্যমে এই সংঘর্ষ ও মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ও দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনায় প্রধান আলোচনার বিষয় ছিল।
সীমান্তবর্তী গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ মারাত্মক বিপদে পড়ে গেছে। তারা সরকারি ও আন্তর্জাতিক সাহায্যের অভাবে কংক্রিট বাংকার ও অস্থায়ী আশ্রয়স্থলে আশ্রয় নিয়েছে। শিশুরা ও প্রবীণরা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে। এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে মানবাধিকার ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
সাড়ে এক দশকের মধ্যে এটি সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সীমান্ত সংঘাত, যা থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার পুরনো বিরোধকে আরও জটিল করে তুলেছে। সামরিক সংঘাত, কূটনৈতিক বিরোধ ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বন্ধ করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে তৎপর হওয়া জরুরি। এর জন্য দরকার কূটনৈতিক উদ্যোগ।
ভোরের আকাশ/এসএইচ