মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫ ০১:১৪ এএম
প্রতীকী ছবি
পলাতক ও বৃহৎ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে ‘উৎপাদন ও রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে’, ‘এজন্য কর্মরত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না’, ‘উৎপাদন ঠিক রাখতে আর্থিক সহায়তা জরুরি’- এসব অজুহাত দেখিয়ে দেশের বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান সরকারি তহবিল থেকে বড় ধরনের ঋণ নিয়েছিল। দীর্ঘ সময় পার হলেও বিভিন্ন অজুহাতে সেই ঋণ পরিশোধ করতে নানা গড়িমসি করছে তারা।
এ অবস্থায় সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে প্রয়োজনে এসব শিল্প মালিকদের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া ইতোমধ্যে কয়েকজন পলাতক মালিকের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেডনোটিশ জারির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আর ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা এবং পালিয়ে থাকা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের পাসপোর্ট স্থগিত রাখার জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের বেশ কয়েকটি বড় আকারের শিল্প প্রতিষ্ঠান গত কয়েক বছরের মন্দাবস্থা ও কারণ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাতে, উৎপাদন ও রপ্তানি স্বাভাবিক রাখতে এবং কর্মচারিদের বেতন-ভাতা যথাসময়ে দেওয়ার কথা বলে অর্থ বিভাগ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে সুদমুক্ত ঋণ গ্রহন করে। প্রতিষ্ঠানগুলো বড় আকারের ঋণ গ্রহণ করলেও যথাসময়ে এসব ঋণের অর্থ সরকারকে পরিশোধ করছে না। এ অবস্থায় বেক্সিমকো গ্রুপসহ ১০টি শিল্প কারখানার মালিকেদের ঋণ সহায়তার বিষয়টি নিয়ে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
জানা গেছে, বেক্সিমকো ছাড়াও বার্ডস গ্রুপ, টিএনজেড গ্রুপ, ডার্ড গ্রুপ, নায়াগ্রা টেক্সটাইলস লি, রোয়ার ফ্যাশন লি, মাহমুদ জিন্স লি, স্টাইল ক্রাফট লি. এবং গোল্ডস্টার গার্মেন্টস লি.-কে অর্থ বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় তহবিল, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করে। এ ঋণের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকার ওপরে। শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য এসব শিল্প মালিকরা ঋণ নিলেও অনেক মালিককে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও ঋণের টাকা পরিশোধ করছে না তারা।
এ ব্যাপারে শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ভোরের আকাশ’কে জানান, সরকারি তহবিলের এ ঋণ ফেরত না দিলে সংশ্লিষ্ট শিল্প কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের জমি, কারখানা, যন্ত্রপাতি বিক্রি করে হলেও আগামি ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ঋণের সকল টাকা পরিশোধ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ৫ আগস্টে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর বিভিন্ন শিল্প কারখানায় বেতন বকেয়া পড়ায় আন্দোলন শুরু করেন শ্রমিকরা। এ অবস্থায় শ্রম অসন্তোষ নিরসনের লক্ষ্যে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঋণ চুক্তির আওতায় অর্থ বিভাগ এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারের কেন্দ্রীয় তহবিল হতে পরবর্তীতে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ৭০১ কোটি ৬০ লাখ ৫৫ হাজার ১১৫ টাকা সুদমুক্ত ঋণ দিয়েছে সরকার।
এর মধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়েছে ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ১১৫ টাকা। এ ছাড়া অর্থ বিভাগ থেকে দেওয়া হয়েছে ৬২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের সময় অতিক্রান্ত হলেও এসব প্রতিষ্ঠান এখনও ঋণ পরিশোধ করেনি। আর এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও অতিক্রম করেছে।শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের এ সময়সীমা রয়েছে আগামী ২৯ নভেম্বও মাস পর্যন্ত। এ অবস্থায় সম্প্রতি ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য শিল্প কারখানার মালিক ও বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ’র নেতৃবৃন্দের নিয়ে বৈঠক করেন শ্রম উপদেষ্টা। বৈঠকে সরকার প্রদত্ত সুদমুক্ত ঋণ যথাসময়ে ফেরত না দিলে সংশ্লিষ্ট শিল্প কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন তিনি।
এ সভায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি, বিজিএমইএ-এর সভাপতি, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও মালিকরা উপস্থিতি ছিলেন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ভোরের আকাশ’কে জানান, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় শ্রম অসন্তোষ নিরসনের লক্ষ্যে বেং উৎপাদন ও রপ্তানি স্বাভাবিক রাখার কথা বলে ঋণ নিলেও এখন তা পরিশোধেও গড়িমসি করছে।
তিনি বলেন, যথাসময়ে এ ঋণ আদায়ে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া শিল্প মালিকদের ব্রিুদ্ধে প্রয়োজনে রেড নোটিশ জারি এবং সংশ্লিষ্টদের পাসপোর্ট স্থগিত রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেন, এই ঋণের টাকা শ্রমিকের টাকা এবং জনগণের মালিকানার টাকা। এ টাকা আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এই ক্ষেত্রে কোনোরকম ছাড় দেওয়া হবে না।
এ সময় তিনি সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক ও প্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্ট লিয়েন ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিষ্ঠানের জমি, কারখানা, যন্ত্রপাতি বিক্রি করে হলেও ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ঋণের সকল টাকা পরিশোধ করতে বলেন। আর বিষয়টিতে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’কে সহায়তাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধও জানান তিনি।
১০ প্রতিষ্ঠানের ঋণ ৭০০ কোটি টাকা
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শ্রম অসন্তোষ নিরসনের লক্ষ্যে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঋণ চুক্তির আওতায় অর্থ বিভাগ এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কেন্দ্রীয় তহবিল হতে ১০ প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে ৭০১ কোটি ৬০ লাখ ৫৫ হাজার ১১৫ টাকা সুদমুক্ত ঋণ দিয়েছে সরকার।
এর মধ্যে বার্ডস গ্রুপ কোম্পানিকে গত বছর ১১ নভেম্বর সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয় ১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয় ৫ কোটি টাকা ও অর্থ বিভাগ থেকে দেওয়া হয় ১৪ কোটি টাকা। শ্রম মন্ত্রণালয়ের টাকা পরিশোধের সময় ছিল ২০২৫ সালের ১১ মে। কিন্তু এখনো টাকা পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি। একই অবস্থা টিএনজেড গ্রুপের। শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য এই কোম্পানিকে দুই দফায় ২৮ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার।
এর মধ্যে গত বছর ২৮ নভেম্বর ১৬ কোটি টাকা এবং চলতি বছর ২৮ মে আরও ১২ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয় ১৮ কোটি টাকা এবং অর্থ বিভাগ থেকে দেওয়া হয় ১০ কোটি টাকা। প্রথম ঋণের টাকা পরিশোধের সময় ছিল গত ২৭ মে। দ্বিতীয় ঋণের টাকা পরিশোধের সময় ছিল গত ২৮ আগস্ট। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি। আর এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বেক্সিমকো গ্রুপের। এই কোম্পানির শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য দুই দফায় প্রায় ৫৮৫ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার। এর মধ্যে গত বছর ২১ নভেম্বর শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয় ৯ কোটি ৫৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮১ টাকা এবং অর্থ বিভাগ থেকে হয় ৫০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া গত ৬ মার্চ অর্থ বিভাগ থেকে আরেক দফায় ৫২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা দেওয়া হয় বেক্সিমকো গ্রুপকে। প্রথম দফা ঋণ পরিশোধের সময় ছিল গত ২১ মে। দ্বিতীয় দফা ঋণ পরিশোধের সময় গত ৬ সেপ্টেম্বর। কিন্তু এখনো ঋণ পরিশোধ করেটি বেক্সিমকো গ্রুপ।
আরেক প্রতিষ্ঠান- ইয়োলো এ্যাপারেলস লিমিটেড কোম্পানি গত বছর ২০ নভেম্বরে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য এই কোম্পানিকে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ৩৭ কোটি ৩২ হাজার ২০০ টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার। এই টাকা পরিশোধের সময় ছিল গত ২০ মে। কিন্তু এখনো এই ঋণ পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি।
একইভাবে গত বছর ১০ ডিসেম্বর ডার্ড গ্রুপকে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য অর্থ বিভাগ থেকে ১৩ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার। এই ঋণ পরিশোধের সময় ছিল গত ২৭ মে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ঋণ পরিশোধ করেনি তারা। এছাড়া নায়াগ্রা টেক্সটাইলস লিমিটেড নামের অপর এক কোম্পানিকে গত বছর ৪ জুন শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য ১৮ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার। এই টাকা পরিশোধের সময় ছিল গত ২৭ আগস্ট। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ঋণ পরিশোধ করেনি। রোয়ার ফ্যাশন লিমিটেড নামের আরেকটি গার্মেন্টস কোম্পানিকে গত ২৭ মার্চ শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ১ কোটি ২৩ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩৪ টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার।
গত ২৭ জুনের মধ্যে এই ঋণ পরিশোধের সময় দেওয়া হয়। কিন্তু তারাও ঋণ পরিশোধ করেনি। মাহমুদ জিন্স লিমিটেড নামের এক গার্মেন্টস কোম্পানিকে গত ২৮ মে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ২১ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ পরিশোধের জন্য তিন মাস সময় দেওয়া হয়। সে হিসেবে গত ২৮ আগস্ট এই সময় অতিক্রম হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ঋণের টাকা পরিশোধ করেনি। গোল্ডস্টার গার্মেন্টস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিকে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য গত বছর ৪ এপ্রিল শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ১ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণ পরিশোধের সময় ছিল গত বছর ৯ জুলাই পর্যন্ত। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ করেনি তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অর্থনীতি গতিশীলতা ঠিক রাখতে এবং উৎপাদন ও শ্রম অসন্তোষ নিরসনে নেওয়া এসব ঋণ পরিশোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তরিকতা জরুরি। আর ঋণ পরিশোধ না করলে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বাজেয়াপ্ত, ব্যংক একাউন্ট জব্দ, পাসপোর্ট বাতিলসহ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত সরকারের।
ভোরের আকাশ/এসএইচ