নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৫ ০৭:৫০ এএম
ফাইল ছবি
রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। বড় স্থাপনা, ল্যাবরেটরি, অনেক টাকায় কেনা সরঞ্জাম, পরীক্ষা করার কর্মকর্তা-কর্মচারী সবই আছে। নেই শুধু পরীক্ষার জন্য রি-এজেন্ট (রাসায়নিক উপাদান), কিট ও ফ্লিম। এ কারণে সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে গত কয়েকমাস ধরে ৩১ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। এতে রোগীর দুর্ভোগ বেড়েছে। এসব পরীক্ষা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করাতে কয়েকগুণ বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে তাদের। সেবাবঞ্চিত নিম্ন আয়ের মানুষ ধুঁকছে রোগ নিয়ে। চরম অব্যবস্থাপনার এমন চিত্র রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) সরেজমিন গিয়ে প্রথমে বিষয়টি নজরে আসে। এরপর খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রাজধানীর প্রায় সব হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার একই চিত্র। নিটোর পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান অসুস্থ হয়ে নিজেও একটি বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়েছেন।
গত বুধবার হাসপাতালটিতে গিয়ে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। পরিচালককে ওইদিন তার অফিসেও পাওয়া যায়নি। বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সত্যতা জানতে আবুল কেনানকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরিচালকের অফিসের কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ‘স্যার, অসুস্থ। হাসপাতালে এসে আবার বাসায় চলে গেছেন।’
ভোগান্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ঘড়ির কাটায় সকাল ৯টা। ২৮ মে, বুধবার। হাসপাতালের দিনের সেবা চালু হয়েছে মাত্র আধাঘণ্টা আগে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) পুরাতন ভবনের রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিভাগের ১০৭ নম্বর কক্ষের সামনে হাতে ফাইল নিয়ে এক্স-রে করাতে দীর্ঘ সারি ধরে অপেক্ষায় শতাধিক মানুষ। সকাল সোয়া ৯টায় ওই কক্ষ থেকে ঘোষণা এলো- ফ্লিম না থাকায় এক্স-রে বন্ধ রাখা হয়েছে। ওই ঘোষণার পর দীর্ঘ সারি ধরে অপেক্ষমাণ রোগীরা একে একে চলে যাচ্ছেন। তাদের একজন রাজধানীর মেরুল বাড্ডা থেকে আসা মো. হাবিব মিয়া। পেশায় কাঠমিস্ত্রি হাবিব দেড় মাস আগে গুরুতর আহত হয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অস্ত্রোপচারের পর প্রায় এক মাস আগে তাকে রিলিজ দেওয়া হয়েছিল।
হাবিব ভোরের আকাশকে বলেন, ফলো-আপ করাতে এসেছিলাম। চিকিৎসক এক্স-রে করিয়ে রিপোর্ট সঙ্গে করে নিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু ফিল্ম না থাকায় এক্স-রে গত কয়েকদিন ধরে বন্ধ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বাইরে থেকে এক্স-রে করানো অনেক ব্যয়বহুল। হাসপাতাল থেকে করানো গেলে টাকা সাশ্রয় হত। ক্ষুব্ধ হাবিব বললেন, তার মতো গরিব রোগীদের পক্ষে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো সম্ভব হবে না।
এক্স-রে রুমের পাশেই টেকনোলজিস্টদের রুম। দরজায় কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলেন একজন টেকনোলজিস্ট। এক্স-রে করানোর বিষয়ে সহযোগিতা চাইতেই উত্তেজিত হয়ে গেলেন তিনি। আপাতত এক্স-রে বন্ধ রয়েছে জানিয়ে কক্ষের দরজা আটকে দিলেন। এ কারণে তার নাম-পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
নতুন ভবনের নিচতলায় বহির্বিভাগের রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিভাগের এক্স-রে রুমের সামনে সাজানো চেয়ারগুলোতে পাঁচজন লোক বসে আছেন। তাদের একজন মো. সামাদ। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, এক্স-রে বন্ধ থাকার বিষয়টি আমরা হাসপাতালের এক্স-রে কক্ষের সামনে যাওয়ার পর জানতে পেরেছি। প্রেসক্রিপশনে এক্স-রে করাতে লিখে দিয়েছেন ডাক্তার।
সামাদের সঙ্গে কথা বলার মুহূর্তে সামনে দিয়ে গলায় আইডি কার্ড ঝুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন নাঈম নামে হাসপাতালের এক কর্মচারী। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘ফিল্ম না থাকায় এক্স-রে আপাতত বন্ধ রয়েছে।
এক্স-রে’র সঙ্গে হাসপাতালের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রায় ৯০ ভাগ রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে বায়োকেমিস্ট্র, হিস্টোপ্যাথলজি ও হেমাটোলজি বিভাগের অতিসাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ টেস্টগুলো হচ্ছে না। কিছু রুটিন টেস্ট যেমন- সিবিসি, আরবিএস, এইচবিএসএজি ও এইচসিভি ছাড়া প্রায় সবই বন্ধ আছে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে না পেরে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন দরিদ্র রোগী।
হাসপাতালটিতে রক্ত পরীক্ষা বন্ধের কারণ জানিয়ে ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের দেওয়ালে (নোটিশ) বিজ্ঞপ্তি সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘রোগীদের রক্ত পরীক্ষার জন্য ‘রেড টিউব’ (ব্লাড কালেকশন টিউব) প্রয়োজন হয়। দীর্ঘদিন ধরে সরবরাহ বন্ধ থাকায় রেড টিউবের মজুত একেবারে শেষ হয়ে গেছে। যার কারণে ১২ মার্চ থেকে আমাদের পরীক্ষা (টেস্ট) বন্ধ।
নোটিশে আরও উল্লেখ করা হয়, রেড টিউবের স্বল্পতার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে (পরিচালক) ইতঃপূর্বে লিখিত ও মৌখিকভাবে একাধিকবার জানানো হয়েছে। আগামী দিনে রেড টিউব সরবরাহ সাপেক্ষে রক্ত পরীক্ষা চালু সম্ভব। সাময়িকভাবে কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
এছাড়া রিপোর্ট ডেলিভারির ডেস্কের সামনের গ্লাসসহ একাধিক স্থানে সাঁটানো পৃথক আরেকটি নোটিশে লিখে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, গতকাল শনিবার থেকে ডোপ টেস্ট বন্ধ থাকবে। পরবর্তী সরবরাহ সাপেক্ষে পুনরায় ডোপ টেস্ট চালু হবে।
হাসপাতালের উপপরিচালক (প্রশাসন) ডা. আতিকুর রহমান বলেন, ‘সরকারি অনুমতি ছাড়া আমরা কিছু কিনতে পারি না। সরকার পতনের পর সবকিছু ঢেলে সাজাতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কার্যাদেশ অনুমোদন হয়ে গেছে। খুব দ্রুতই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গিয়েও একই চিত্র মেলে। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রাজীব রায়হান হাসপাতালের পরীক্ষাগারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে গিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দু’দিন ধরে অসুস্থ, ডাক্তার ডায়াবেটিস ও জন্ডিসের পরীক্ষা দিয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাল, কিট সংকটে দীর্ঘদিন ধরে এসব পরীক্ষা বন্ধ আছে। তাই বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে করাতে হবে। এতে বাড়তি টাকা গুনতে হবে। দুটি পরীক্ষা করতে হাজারের বেশি টাকা লাগবে।
শ্যামলী এলাকার রিকশাচালক মাহমুদুর রহমান বলেন, স্বল্পমূল্যে সেবা নেওয়ার জন্য মানুষ সরকারি হাসপাতালে আসে। এখানে এসে ভোগান্তি আরও বাড়ে। তিন দিন ধরে আমার জ্বর। কোনোভাবেই কমছে না। ডাক্তার দেখে রক্তের তিনটি পরীক্ষা দিয়েছেন। ল্যাব কাউন্টারের লোক জানালেন, এখানে হবে না। তাই পরীক্ষা না করিয়ে বাসায় যাচ্ছি। বেসরকারি ক্লিনিকে পরীক্ষা করার টাকা নেই আমার।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিউর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, রি-এজেন্ট ও ফ্লিম না থাকার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। দ্রুতই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হৃদরোগ ইউস্টিটিউট, কিডনি হাসপাতাল, চক্ষুবিজ্ঞান, ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শ্যামলী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতাল, নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি মেডিসিন ইনস্টিটিউট, বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউব অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, মুগদা, মিটফোর্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের একই চিত্র।
যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে না
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, রি-এজেন্ট সংকটে বন্ধ রয়েছে ৩১ ধরনের রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা। কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট বা কমপ্লিট ব্লাড পিকচার টেস্ট, হিমোগ্লোবিন ও প্লাটিলেট পরীক্ষা, ডায়াবেটিসের গড় নির্ণয়ের এইচবিএওয়ানসি ও জন্ডিসের বিলিরুবিন পরীক্ষা, কিডনির কার্যকারিতা মূল্যায়নের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা, ডিএনএ টেস্ট, লিভারের রোগ বা আঘাত শনাক্তে এসজিপিটি, সিরাম ইলেকট্রালাইট, অগ্ন্যাশয় ক্যান্সারের রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা সিরাম লাইপেজ এবং হৃদরোগ শনাক্তে ট্রাইপোনিক আই পরীক্ষা, ড্রাগ পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।
কিট সংকটের কারণে মাইক্রোলজি বিভাগের ১৮ ধরনের পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। এই বিভাগে মূলত মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স আছে কিনা, সেটা জানতে কালচার পরীক্ষা করা হয়। সাধারণত জটিল ও আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীর ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা প্রয়োজন হয়। যত্নপাতি স্বাভাবিক থাকলেও শুধু কিট সংকটের কারণে এ পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।
আর ফ্লিম সংকটের কারণে এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম, সিটিস্ক্যান ও এমআরআই পরীক্ষা বন্ধ হয়ে পড়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউব অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে সারাদেশের সরকারি হাসপাতাল থেকে ড্রাগ টেস্টের নমুনা পাঠানো হয়। এক মাস ধরে কিট ও রি-এজেন্ট না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে এ টেস্ট বন্ধ আছে।
যে কারণে সংকট
সরকারি হাসপাতালে স্বাভাবিক কার্যক্রম ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সচল রাখতে প্রতিবছর দরপত্রের মাধ্যমে গজ, ব্যান্ডেজ, ওষুধ, রাসায়নিক উপাদান (বিকারক), এক্স-রে ফিল্ম, ডায়ালাইসিস সামগ্রী, কিটসহ বিভিন্ন পণ্য কেনা হয়। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে এসব চিকিৎসা সামগ্রী কেনা হচ্ছে না। কেন কেনা হচ্ছে না এসব সামগ্রী- এমন প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন কয়েকটি হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক কর্মকর্তারা।
তবে দুই জন পরিচালক বলেছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাইলেই কোনো কিছুৃ ক্রয় করতে পারে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে চাহিদা পাঠানো হয়। সেখান থেকে বরাদ্দ ও অনুমোদন পাওয়ার পরই কর্তৃপক্ষ টেন্ডারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয় করতে পারেন।
নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন চিকিৎসক-কর্মকর্তা জানান, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হাসপাতালে বিভিন্ন রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যবহৃত রি-এজেন্ট ও এক্স-রে ফ্লিমসহ নানা ধরনের চিকিৎসা সামগ্রী কেনাকাটায় এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। হাসপাতালগুলোতে নতুন প্রশাসন, চিকিৎসক ও কর্মচারীরাও বেশিরভাগ নতুন। আবার অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরাও নতুন। আর্থিক বরাদ্দ সংকট, সরবরাহকারী ঠিকাদার পরিবর্তন-সব মিলিয়ে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। আর এতে করে ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আবু জাফর ভোরের আকাশকে বলেন, রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রি-এজেন্ট, কিট ও এক্স-রে ফ্লিম ক্রয়ের বিষয়টি দ্রুতই সমাধান হবে। অতীতেও মাঝে মাঝে এ ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে অর্থবছরের শেষ দিকে সংকট বৃদ্ধি পায়। বর্তমানেও সেটি হয়েছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। দ্রুতই সংকটের সমাধান হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ