অর্থনীতি ডেস্ক
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৫ ০৬:২৩ এএম
মূলধন সংকটে ২৩ ব্যাংক, ঘাটতি ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা
দেশের ব্যাংক খাত ক্রমেই গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। একের পর এক ব্যাংক মূলধন ঘাটতির ফাঁদে পড়ছে এবং সেই ঘাটতির অঙ্কও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত ও বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে ২৩টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। এদের সম্মিলিত ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ২৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং অব্যবস্থাপনায় ঋণ বিতরণের ফলেই এই সংকট তৈরি হয়েছে। বিপুল পরিমাণ ঋণ ফেরত না পাওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন চরম মূলধন ঘাটতির মধ্যে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন করে একাধিক ব্যাংক মূলধন ঘাটতির তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এবং আইএফআইসি ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক—১৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক (১৭ হাজার ৪৯২ কোটি), জনতা ব্যাংক (১২ হাজার ৭৬৮ কোটি), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (৭ হাজার ৭৯০ কোটি), ন্যাশনাল ব্যাংক (৬ হাজার ৯৩৮ কোটি ৭০ লাখ) এবং ইসলামী ব্যাংক (৬ হাজার ৪৫৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা)।
এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি ৫ হাজার ৮২২ কোটি, পদ্মা ব্যাংকের ৫ হাজার ১৭০ কোটি ৭০ লাখ, রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ৪৭০ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ৯৮০ কোটি ৬১ লাখ, এবি ব্যাংকের ৩ হাজার ৬৯৩ কোটি এবং বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।
তালিকায় আরও রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক (২ হাজার ৬৯৮ কোটি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (২ হাজার ৫১০ কোটি ৬৯ লাখ), সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (১ হাজার ৯৭৯ কোটি ৮১ লাখ), বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক (১ হাজার ৭৮২ কোটি), আইসিবি ইসলামী ব্যাংক (১ হাজার ৪৯৮ কোটি), প্রিমিয়ার ব্যাংক (১ হাজার ১৭১ কোটি), ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (৯৫৪ কোটি), এক্সিম ব্যাংক (৫২১ কোটি), সিটিজেনস ব্যাংক (৮৬ কোটি), সীমান্ত ব্যাংক (২৬ কোটি) এবং বিদেশি হাবিব ব্যাংক (৩৬ লাখ টাকা)।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিই মূলধন ঘাটতির প্রধান কারণ। আগে অনেক খেলাপি ঋণ গোপন রাখা হলেও এখন প্রকৃত তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে, যা ব্যাংকের মূলধনে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সংকট মোকাবিলায় উদ্যোগ নিয়েছে। জানা গেছে, শিগগিরই পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পাশাপাশি আরও ১১টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা মূল্যায়ন চলছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে বাস্তবসম্মত পুনর্গঠন পরিকল্পনা চাইবে তারা। পরিকল্পনা কার্যকর না হলে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ না নিলে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। খেলাপি ঋণ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবের দুষ্টচক্র ভাঙতে না পারলে সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪.১৩ শতাংশ। মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
ভোরের আকাশ//হ.র