২৭ বছর পর আইসিসি ট্রফি জয়
রাজীব দাস
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৫ ০৯:২১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বক্রিকেটে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে রইল ক্রিকেট বিশ্ব। টেম্বা বাভুমার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা শুধু একটি ম্যাচ জেতেনি, তারা জিতেছে এক শতাব্দীর শেকল ছেঁড়া আত্মবিশ্বাসের লড়াই। যে দেশ ২১ বছর ধরে বর্ণবাদের দায়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত ছিল, যে দলের নামের সঙ্গে ‘চোকার্স’ শব্দটি অবিচ্ছেদ্য হয়ে গিয়েছিল, সেই দক্ষিণ আফ্রিকা আজ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লর্ডসে এই জয় শুধুই একটা ট্রফি নয়, এটি একটি প্রজন্মের অজস্র হতাশা, অবজ্ঞা আর অবিচারের জবাব। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৩৮ রানে অলআউট হওয়া দল দ্বিতীয় ইনিংসে ২৮২ রান তাড়া করে জয় তুলে নেয় এবং এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন এক কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক ও তার সঙ্গীরা।
বর্ণবাদের অতীত থেকে শিখরে ওঠার লড়াই : ১৯৭০ সালে আইসিসি দক্ষিণ আফ্রিকাকে নির্বাসনে পাঠায় অ্যাপার্থেইড নীতির কারণে। কৃষ্ণাঙ্গদের ক্রিকেট থেকে বঞ্চিত করায় দীর্ঘ ২১ বছর তাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত থাকতে হয়। ১৯৯১ সালে পুনরায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার অনুমতি পেলেও তাদের পথ সহজ ছিল না। এরপর ১৯৯৮ সালে প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতলেও বিশ্বকাপে বারবার ব্যর্থতা তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। ৯৯-এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের সেই স্মরণীয় রানআউট, ২০০৭, ২০১৫ বা ২০১৯ বারবার দক্ষিণ আফ্রিকা হোঁচট খেয়েছে বড় মঞ্চে। তাতে তকমা জোটে ‘চোকার্স’ মানসিকভাবে ভেঙে পড়া দল, যাদের সাহস নেই চাপ নেওয়ার।
সেই চোকার্সরা এবার সত্যিই চ্যাম্পিয়ন : কিন্তু এইবারের দল ছিল আলাদা। মাঠে এক অনমনীয় সংকল্পের নাম ছিল টেম্বা বাভুমা। তার উচ্চতা মাত্র ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি, কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে তিনি আজ একজন দৈত্য। ২০১৪ সালে অভিষেক হওয়া এই ক্রিকেটার ২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান হন। ২০২১ সালে হন দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক। টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে তার রেকর্ড ঈর্ষণীয় ১০ ম্যাচে ৯ জয়। এই ম্যাচে চোট পেয়েও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খেলেছেন, কামিন্স-স্টার্কদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। পাশে ছিলেন এডেন মার্করাম, যিনি টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে শতরান করে জয় এনে দিয়েছেন। মার্করাম প্রথম ইনিংসে শূন্য রানে আউট হলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ঠিকই ফিরলেন বীরত্বে মোড়া ১৩৬ রানের ইনিংস নিয়ে। বাভুমা ও মার্করামের জুটির উপর ভর করে দক্ষিণ আফ্রিকা এক ঐতিহাসিক রান তাড়ায় সফল হয়।
আবেগে ভাসলেন কিংবদন্তিরা : প্রাক্তন তারকা এবি ডিভিলিয়ার্স বলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা জিতলে কেঁদে ফেলবেন। সেই কথাই সত্যি হলো। গ্যালারিতে চোখে জল, মুখে হাসি স্মিথ, ডিভিলিয়ার্সদের মুখে ধরা পড়ল সেই স্বপ্নপূরণের মুহূর্ত। একটি ট্রফির জন্য এতটা দীর্ঘ অপেক্ষা, এতটা সংগ্রাম এই জয় শুধু ক্রিকেট নয়, এটা একটি জাতির শেকলভাঙার কাহিনী।
ইতিহাসের পুনর্লিখন : দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট শুরু হয়েছিল ১৮৮০ সালে। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার পর তারাই তৃতীয় দেশ হিসেবে টেস্ট খেলেছিল। ১৯৯২ সালে ইডেন গার্ডেন্সে ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট খেলে তারা প্রত্যাবর্তন করেছিল। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা। অবশেষে, ২০২৫ সালে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রমাণ করল তারা আর চোকার্স নয়, তারা চ্যাম্পিয়ন। আর সেই শিরোপার মুকুট পরিয়ে দিলেন এক কৃষ্ণাঙ্গ নেতা টেম্বা বাভুমা। যে লর্ডসে একসময় খেলতে সুযোগ পেতেন না, সেই লর্ডসে গতকাল তার নেতৃত্বেই ইতিহাস লিখল দক্ষিণ আফ্রিকা।
ভোরের আকাশ/এসএইচ