শান্তর জোড়া সেঞ্চুরিতে রেকর্ড
রাজীব দাস
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৫ ০৯:১৩ পিএম
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জোড়া সেঞ্চুরি করে শান্তর উল্লাস। ছবি : সংগৃহীত
গল টেস্টের পঞ্চম দিনে বাংলাদেশের জয় অর্জনের স্বপ্ন ছিল জীবন্ত, মাঠে ছিল দমবন্ধ করা উত্তেজনার পারদ; কিন্তু প্রকৃতির অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত ও সময়ের ঘনিষ্ঠ সঙ্কটে সব হিসেব বিফল করে দেয়। শেষ ৫ ওভার বাকি থাকতে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত ও শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা সম্মিলিতভাবে ম্যাচ ড্র ঘোষণা করে শান্তির করমর্দন বিনিময় করেন। যদিও ফলাফল ড্র হলেও ম্যাচে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল চোখ ধাঁধানো, যেখানে অধিনায়ক শান্তের দুই ইনিংসে জোড়া সেঞ্চুরি, মুশফিকুর রহিমের দীর্ঘদিন পর রানে ফিরতি এবং নাঈম হাসানের অসাধারণ স্পিন বোলিং ও ফাইফার অর্জন বাংলাদেশের শক্তি ও সক্ষমতার এক প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই ম্যাচ ছিল শুধুমাত্র একটি টেস্ট ম্যাচের লড়াই নয়, বরং বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামনের দিনে নতুন দিগন্তের সূচনা, যা জাতীয় দলের সম্ভাবনা ও আত্মবিশ্বাসের বহুমাত্রিক প্রমাণ বহন করে। বাংলাদেশের জন্য এটি ছিল সফলতার গল্প, যেখানে কঠোর পরিশ্রম, মানসিক দৃঢ়তা এবং ক্রিকেটীয় শ্রেষ্ঠত্ব মিলে তাদের প্রতিপক্ষের বিপরীতে প্রমাণ করল গেল টেস্ট দল হিসেবে তাদের অবস্থান এখন আর কোন সাধারণ দল নয়, তারা শক্তিশালী এক প্রতিদ্বন্দ্বী, যাদের সঙ্গে খেলতে সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
শেষ বিকেলের রোমাঞ্চ: পাঁচ ওভারে ছয় উইকেটের স্বপ্নে থেমে যাওয়া- গল টেস্টের পঞ্চম দিনের শেষ সেশনে তখনও বাকি ছিল ৫ ওভার। বাংলাদেশের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল মাত্র ৬ উইকেট। তবে ফলাফল অনিশ্চিত জেনেই নাজমুল হোসেন শান্ত ও লঙ্কান অধিনায়ক ধনঞ্জয়া ডি সিলভা হাত মিলিয়ে ম্যাচ ড্র মেনে নেন। দুই দলের ক্রিকেটাররা করমর্দন করে ফিরে যান ড্রেসিংরুমে। শ্রীলঙ্কার ইনিংসের শুরুটা ছিল আগ্রাসী। উদ্বোধনী জুটিতে ৩২ রান যোগ করেন পাথুম নিশাঙ্কা ও লাহিরু উদারা। তবে ১৩ বলে ৯ রান করা উদারাকে ফেরান তাইজুল ইসলাম। এরপর নাইম হাসান ফিরিয়ে দেন ২৫ বলে ২৪ রান করা নিশাঙ্কাকে। দ্রুত আরও দুটি উইকেট তুলে নেন তাইজুল অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস (৮) ও দীনেশ চান্দিমাল (৮) ফিরে যান সাজঘরে। শেষ পর্যন্ত কামিন্দু মেন্ডিস ও ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা মিলে প্রতিরোধ গড়েন। ৩২ ওভারে ৪ উইকেটে ৭২ রানে ইনিংস শেষ করে শ্রীলঙ্কা, আর ম্যাচটি ড্র হয়। কামিন্দু ও ধনাঞ্জয়া দুজনেই ১২ রানে অপরাজিত ছিলেন।
বৃষ্টির হস্তক্ষেপ ও দেরিতে ইনিংস ঘোষণার আক্ষেপ: গল টেস্টের দ্বিতীয় দিন ও শেষ দিনে বৃষ্টির কারণে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়। দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেটে ২৮৫ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে বাংলাদেশ। ১০ রানের প্রথম ইনিংস লিড যোগ করে লঙ্কানদের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৯৬ রান।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ যদি আরও আগেই ইনিংস ঘোষণা করত কিংবা ২৫০ রানের মতো লিডেই শ্রীলঙ্কাকে ব্যাটিংয়ে ডাকত, তাহলে ফলাফল ভিন্ন হতে পারত। তবে সাহসী ক্রিকেটের জন্য প্রশংসা প্রাপ্য বাংলাদেশ দলের।
শান্তর ব্যাটে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: গল টেস্টে অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। নিজের দায়িত্ব তিনি ব্যাট হাতে অনবদ্যভাবে পালন করেছেন। প্রথম ইনিংসে ২৭৯ বলে ১৪৮ রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ১৯৯ বলে অপরাজিত ১২৫ রান করে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো এক টেস্টে জোড়া সেঞ্চুরি করলেন। এই কীর্তি গড়লেন তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার অধিনায়ক হিসেবে। টেস্ট ক্যারিয়ারে এটি শান্তর সপ্তম সেঞ্চুরি। গল টেস্টের ব্যাটিংয়ের এই মহাকাব্য নিঃসন্দেহে তার ক্যারিয়ারের অন্যতম গর্বময় অধ্যায়।
মুশফিকের চমৎকার প্রত্যাবর্তন: টেস্টে সময়টা ভালো যাচ্ছিল না মুশফিকুর রহিমের। ১৩ ইনিংসে ছিল না কোনো ফিফটি। সেই হতাশা কাটিয়ে গল টেস্টে প্রথম ইনিংসে ১৬৩ রানের চমৎকার ইনিংস খেলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে আরও একবার দায়িত্বশীল ব্যাটিং করে ৪৯ রান যোগ করেন। অভিজ্ঞতার জোরে চাপ সামলানো ও দলের ভিত গড়ে তোলার কাজটা করেছেন পুরোদমে।
নাঈম হাসানের স্পিন জাদু: প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের বড় সংগ্রহের (৪৯৫ রান) জবাবে শ্রীলঙ্কা প্রায় ম্যাচে ফিরেই যাচ্ছিল। পাথুম নিশাঙ্কার ১৮৭ ও কামিন্দু মেন্ডিসের ৮৭ রানে এগিয়ে যাচ্ছিল তারা। তখনই আবির্ভাব ঘটে ডানহাতি স্পিনার নাঈম হাসানের। ৪৩.২ ওভারে ১২১ রান দিয়ে ৫ উইকেট শিকার করেন তিনি। শেষ ২০ রানে ৪ উইকেট তুলে নিয়ে লঙ্কানদের অলআউট করে দেন এবং বাংলাদেশকে ১০ রানের লিড এনে দেন।
ম্যাচ শেষে কণ্ঠে প্রশংসা ও আক্ষেপ: ম্যাচ শেষে শান্ত জানান, আমরা জেতার মতো অবস্থানে ছিলাম। বৃষ্টির কারণে কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। তবে মুশফিক দারুণ ব্যাট করেছে, নাঈম অসাধারণ বল করেছে ওকে আরও সুযোগ দেওয়া উচিত।
লঙ্কান অধিনায়ক ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা বলেন, প্রথম ইনিংসে আমরা ভালো বোলিং করতে পারিনি। শান্ত আর মুশফিক আমাদের ম্যাচে ফিরতে দেয়নি। সেইসঙ্গে ম্যাথুসের টেস্ট বিদায়কে ‘লঙ্কান ক্রিকেটের আবেগময় মুহূর্ত’ হিসেবেও আখ্যা দেন তিনি। গল টেস্টটি ড্র হলেও বাংলাদেশের কাছে এটি এক অর্থে জয়ের মতোই। ব্যাটে শান্ত-মুশফিক, বল হাতে নাঈম তাদের পারফরম্যান্সে ভর করেই বাংলাদেশ পুরো ম্যাচেই আধিপত্য দেখিয়েছে। সামান্য সময় ও আবহাওয়ার সহায়তা পেলে ফলাফল হয়তো ভিন্ন হতো। তবে এই ড্র বাংলাদেশ টেস্ট দলের আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি আরও মজবুত করল। আর সেই ভিত্তির কেন্দ্রবিন্দু নাজমুল হোসেন শান্ত।
ভোররে আকাশ/এসএইচ