ক্রীড়া প্রতিবেদন
প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৫ ১১:১৮ এএম
সংগৃহীত ছবি
গত সোমবার, লন্ডনের ঐতিহাসিক ওভাল স্টেডিয়ামে ক্রিকেট বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল এক অসাধারণ টেস্ট ম্যাচের জন্ম। ভারতের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের এই টেস্ট ম্যাচ জিততে হলে শেষ দিনে দরকার ছিল মাত্র ৩৫ রান, আর ভারতের দরকার ৪ উইকেট। চারপাশে যে উত্তেজনার আবহ, তা যেন বিদ্যুৎ শীতল ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল মাঠের প্রতিটি কর্নারে, দর্শকের প্রতিটি হৃদয়ে। সদ্য সূর্য উঠেছে, গ্যালারিতে কানায় কানায় ভরা, সকলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ক্রিকেট কি আবারও চিরায়ত রূপে ঘুরে দাঁড়াবে?
সকালটা শুরুই হয় নাটকীয়তায়। প্রথম দুই বলে ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডার জেমি ওভারটন দুইটি চার নম্বরের গন্ডি পেরিয়ে দর্শকদের উত্তেজনা বাড়িয়ে দেন, মনে হচ্ছিল হয়তো পাঁচ দিনের লড়াইয়ের ক্লান্ত অবসান ঘটতে চলেছে খুব সহজেই। কিন্তু পরের ওভারে সিরাজের নিখুঁত লাইন-লেংথ ও সুইং ভারতকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনে। দিনের প্রথম সাফল্য এনে দেন সিরাজ ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যান জেমি স্মিথকে তিনি আউট করেন কিপারের গ্লাভসে চুমু খেয়ে যাওয়া দুর্দান্ত এক আউটসুইং বলে। কয়েক বল পরেই সিরাজ আবারও বাজিমাত করেন এবার ওভারটনকে এলবিডব্লিউ করেন তিনি। তখন সবাই বুঝে যায়, লড়াই জমেছে নতুন মাত্রায়।
প্রসিধ কৃষ্ণার সাপোর্টে পরবর্তী ওভারে জাস্টিন টংকেও বিদায় নেওয়ার আহবান জানানো হয়। ম্যাচ তখন আরও জটিল হয়ে যায় ইংল্যান্ডের হাতে কেবল এক উইকেট, ভারতের পাঁচদিনের অপেক্ষার ফল হাতে পাওয়া অধরা জয়, আর মাত্র ৭ রান দূরে দাঁড়িয়ে স্বাগতিক শিবির।
শেষ উইকেটে ক্রিস ওকস নামে ব্যাটিংয়ে, বাঁ কাঁধ পুরো ব্যান্ডেজে মোড়া, ম্যাচের উত্তেজনা দৃশ্যত তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে না বরং তার লড়াই যেন বাইরের যে কোনো চ্যালেঞ্জকে ছাপিয়ে গেছে। অ্যাটকিনসনের সঙ্গে জুটি গড়লেন দৃঢ়তায়। ওভার থেকে ওভারে তারা বেঁচে গেলেন, রান তুললেন একটু একটু করে, আবারও ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন ফিরল ইংলিশ গ্যালারিতে।
তখন ভারতের সবার চোখ মোহাম্মদ সিরাজের দিকে, যাকে বিশ্বাস করেছিলেন অধিনায়ক শুভমান গিল ও দল। ঠিক এই মুহূর্তেই, ভারতের আশা যখন দুলছে, তখন সিরাজের পরিচিত বিধ্বংসী ইয়র্কার! বল সোজা গিয়ে গাস অ্যাটকিনসনের অফস্টাম্প উড়িয়ে দিল ফাঁকা স্ট্যাম্পের দিকে তাকিয়ে সিরাজ আকাশে দুই হাত তুলে প্রার্থনা করলেন, আবার ভারতীয় দলে উল্লাসে মেতে উঠল সবাই। ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্ত দর্শকদের শ্বাসরুদ্ধ করে তোলে।
ব্রুকের সেঞ্চুরি, সিরাজের প্রথম ইনিংসের ভিলেন হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট, পরবর্তী ইনিংসে যোগ্য নায়ক হয়ে ওঠা, প্রত্যকটি বল মাঝে মাঝে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়। সিরাজ দ্বিতীয় ইনিংসে নেন ৫ উইকেট; পুরো সিরিজে সর্বাধিক ২৩টি উইকেট। তিনি একমাত্র পেসার, যিনি সিরিজের প্রতিটি (৫টি) টেস্ট খেলেছেন এবং সর্বাধিক ১,১১৩ বল করেছেন।
ক্রিস ওকসের দুর্দান্ত সাহসিকতা, চোটের ব্যথা নিয়েও প্রতিটি বল প্রতি সতর্কতা তার ‘ফাইটার’ মানসিকতাকে প্রকাশ করে। নাটকীয় মুহূর্তে কেউ কেউ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, ব্যথায় আক্রান্ত ওকস ব্যাট চালাতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন কি না। সমস্ত দর্শক একনজর তাকিয়ে ম্যাচের ভাগ্য দেখতে থাকেন।
সিরাজের শেষ বল অ্যাটকিনসন বোল্ড এরপর গোটা ভারতীয় দল জনসমুদ্রে ভেসে যায়, উল্লাস আর হাততালি; ইংল্যান্ড শিবিরের হতাশা অসহায়তায় রূপ নিলেও তাদের ভুলে যাওয়া যায় না ক্রিস ওকসের চেতনার দৃঢ়তা। নেতৃত্ব দিয়েছেন শুভমান গিল, উদ্যোম, স্পিরিট এবং অদম্য বিশ্বাসে।
ভারতীয়দের জয় মানে কেবল একটি ম্যাচ জেতা নয়, বরং পাঁচ ম্যাচের যুগন্ধর নাটকীয় সিরিজ ২-২ সমতায় শেষ করা যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত ক্রিকেটের আসল সৌন্দর্য মেলে ধরে: এ তো খেলা নয়, যেন অমৃত সুধা। এমন নাটকীয় টেস্ট ম্যাচ দেখা যায়না খুব ঘন ঘন এই ম্যাচ, এই জয়, সিরাজ-ওকসের রূপকথা বহু বছর ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
ভোরের আকাশ/তাকা