ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৫ ১০:৪৪ এএম
ছবি: সংগৃহীত
মানব ইতিহাসে এমন একজন রাজা ছিলেন, যিনি মানুষ ছাড়াও জ্বিন, পশু-পাখি এবং বাতাসের ওপরও নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার চেয়েও বেশি বিস্ময়কর ছিল তাঁর বিনয়। তিনি হলেন আল্লাহর নবী হজরত সুলাইমান (আ.)। তাঁর সেই বিনয়ের এক অলৌকিক প্রকাশ পাওয়া যায় পবিত্র কোরআনের সুরা নামলে, যেখানে তাঁর একটি দোয়া উঠে এসেছে, যা একদিকে তাঁকে দিয়েছে অদৃশ্য শক্তি, অন্যদিকে তাঁকে রেখেছে আল্লাহর প্রতি বিনয়ী ও কৃতজ্ঞ।
পিপীলিকার উপত্যকায় অলৌকিক এক ঘটনা
ঘটনার সূত্রপাত হয় এক বিশাল সামরিক অভিযানে। হজরত সুলাইমান (আ.) তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে চলেছেন। তাঁরা যখন একটি উপত্যকায় পৌঁছালেন, তখন এক পিপীলিকা তার সাথীদের সতর্ক করে বলল- ‘হে পিপীলিকার দল! তোমরা তোমাদের গৃহে প্রবেশ করো, যাতে সুলাইমান ও তাঁর সৈন্যরা অজান্তে তোমাদের পদদলিত না করে।’ (সুরা নামল: ১৮)
আল্লাহর বিশেষ নেয়ামতে সুলাইমান (আ.) পিঁপড়ার কথা শুনতে ও বুঝতে পারলেন। এই ক্ষুদ্র প্রাণীর কথা শুনে তিনি অহংকার না করে মৃদু হাসলেন। বরং তিনি বুঝতে পারলেন, এই ক্ষমতা আল্লাহরই দান। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বিনম্র চিত্তে আল্লাহর কাছে মাথা নত করে এই মহান দোয়া করলেন। একজন মহারাজার মন যখন এক ক্ষুদ্র পিপীলিকার শব্দে কেঁপে ওঠে, তখন বোঝা যায় — সত্যিকারের শক্তি বিনয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
হজরত সুলাইমান (আ.)-এর সেই মহিমান্বিত দোয়া
আরবি: رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَىٰ وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَدْخِلْنِي بِرَحْمَتِكَ فِي عِبَادِكَ الصَّالِحِينَ
উচ্চারণ: রাব্বি আওযিনি আন আশকুরা নিমাতাকাল্লাতি আনআমতা আলাইয়্যা ওয়া আলা ওয়ালিদাইয়্যা ওয়া আন আমালা সালিহান তারদাহু ওয়া আদখিলনি বিরাহমাতিকা ফি ইবাদিকাস সালিহিন।
অর্থ: হে আমার রব! আমাকে এই তাওফিক দিন যে, আমি আপনার সেই নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারি যা আপনি আমাকে ও আমার পিতামাতাকে দান করেছেন, এবং আমি যেন এমন নেক আমল করতে পারি যা আপনি পছন্দ করেন। আর আমাকে দয়ার মাধ্যমে আপনার নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।’ (সুরা নামল: ১৯)
এই দোয়ার গভীরে লুকিয়ে থাকা ৫টি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
সুলায়মান (আ.)-এর এই ছোট্ট দোয়াটি আমাদের জন্য এক বিশাল শিক্ষণীয় বার্তা বহন করে। সেগুলো হলো-
শুকরিয়ার তাওফিক চাওয়া: নেয়ামত পেলে গর্ব নয়, বরং কৃতজ্ঞতার মনোভাব জরুরি।
পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা: একজন সৎ সন্তান আল্লাহর পাশাপাশি মা-বাবার অনুগ্রহও স্বীকার করে।
নেক আমলের আকাঙ্ক্ষা: শুধু ইবাদত নয়, এমন আমলের দোয়া যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক হয়।
নেককারদের দলে অন্তর্ভুক্তির আকুতি: সৎ মানুষের সঙ্গ ও তাদের দলে স্থান পাওয়ার জন্য বিনয়ের সাথে আকুতি।
আল্লাহর রহমতের ওপর নির্ভরতা: সবকিছুর ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর মেহেরবানি। দোয়ার পরিণামও তার ওপর নির্ভরশীল।
আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া: এমনকি ক্ষুদ্র প্রাণীর প্রতিও দয়া ও সহানুভূতির মনোভাব রাখা মানুষের কর্তব্য।
আল্লাহর পক্ষ থেকে অলৌকিক পুরস্কার
এই দোয়ার পর আল্লাহ তাআলা হজরত সুলাইমান (আ.)-কে অতুলনীয় কিছু ক্ষমতা দান করেন। সেগুলো হলো-
জ্বিন ও পশু-পাখির ওপর কর্তৃত্ব: তিনি তাদের ব্যবহার করে বড় বড় কাজ সমাধা করতেন। (সুরা নামল: ১৭)
বায়ুর অধীনতা: বাতাস তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কোনোকিছু বহন করে নিয়ে যেত। (সুরা সাদ: ৩৬)
তামার ঝর্ণা: তাঁর জন্য ভূগর্ভ থেকে তামার ঝর্ণা প্রবাহিত করা হয়েছিল। (সুরা সাবা: ১২)
অভূতপূর্ব রাজত্ব: যা অন্যকোনো মানব বা জ্বিনকে দেওয়া হয়নি।
এত ক্ষমতা ও প্রাচুর্য সত্ত্বেও তিনি বলেছিলেন- ‘এ তো আমার প্রভুর পক্ষ থেকে পরীক্ষা, আমি শুকরিয়া আদায় করি, না অকৃতজ্ঞ হই?’ (সুরা নামল: ৪০)
ক্ষমতা পেলেই অহংকার নয়—সুলায়মান (আ.) আমাদের শিখিয়েছেন, বিনয়ই সত্যিকারের রাজসিকতা।
আসুন এই দোয়াটি আমরা প্রতিদিনের আমলের অংশ করে নিই। কৃতজ্ঞতা, বিনয় ও সৎকাজের মাধ্যমে আমরাও যেন আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারি। আমাদের জীবনেও হয়ত খুলে যাবে রহমতের এক নতুন দরজা। ইনশাআল্লাহ।
ভোরের আকাশ/তা.কা