জাতীয় সংসদ নির্বাচন
এম. সাইফুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫ ০৯:২৯ এএম
ছবি-ভোরের আকাশ
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে ঐক্য গড়ার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ইসলামী দলগুলো। এক ছাতায় এসে ‘এক বাক্সে’ ভোট পাঠানোর উদ্যোগে ছোট বড় ইসলামী দলগুলোতে আলোচনাও অব্যাহত রয়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইসলামী দলগুলোর নেতাদের মধ্যে বোঝাপড়া বেড়েছে। জাতীয় সব ইস্যুতে দলগুলোর নেতারা ভেদাভেদ ভুলে এখন একমঞ্চে বসছেন প্রায়ই। ইতিমধ্যে ৫ ইসলামী দল মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে, আকিদাগত সমস্যা ও বড় দলগুলোর তৎপরতায় বেশ কিছু কারণে শেষ পর্যন্ত এককাতারে দলগুলো পৌঁছাতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন এখন অনেকের মাঝে।
তবে, এ বিষয়ে জামায়াত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের শীর্ষ নেতারা দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, তাদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। একটু সময় লাগলেও মৌলিক জায়গায় তারা এককাতারে পৌঁছাতে পারবেন। তবে, যেহেতু নির্বাচনের এখনো কোন দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি তাই তারা ধীরে এগোচ্ছেন। নানা আশঙ্কায় কোন প্রক্রিয়ায় ঐক্য হবে সেটিও প্রকাশ করতে চান না তারা। এছাড়া জামায়াত ইসলামীকে নিয়ে অন্য দলগুলো যেমন কৌশলী ঠিক দলটিও ঐক্যের ব্যাপারে কৌশলী ভূমিকায় রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির ও হেফাজতের ইসলামের শীর্ষ নেতা মাওলানা মামুনুল হকের সঙ্গে। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ইসলামী দলগুলোর বৃহৎ ঐক্যের ব্যাপারে আমরা কাজ করছি। আমাদের মধ্যে আলোচনা ও বোঝাপড়া দিনদিন ঘনিষ্ট হচ্ছে। দেশের মানুষের ইসলামী দলগুলোর বিভিন্ন মত ও পথের নেতৃবৃন্দকে এককাতারে দেখতে চাওয়ার যে আকাঙ্খা রয়েছে সেটি পূরণ হবে বলে আমি মনে করি। ইতিমধ্যেই আমরা কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে একসঙ্গে বসেছি।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকেই ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের কথা বলে আসছি। এটা আমরা আওয়ামী লীগ পতনের পর বলছি সেইরকম নয়। আর বিষয়টিতে ইসলামি দলগুলোর আগ্রহও বেড়েছে। জোট করতে গেলে কিছু মতপার্থক্য থাকে। কে কতটুকু ছাড় দেবেন সেটা একটা বিষয়। সবমিলিয়ে তো একটা ঐক্য। ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের প্রক্রিয়া ইতিবাচক ভাবে এগোচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, ঐক্য নিয়ে আলোচনা চলমান। এর লক্ষ্য হলো ইসলামি শক্তিগুলোকে এক জায়গায় আনা। এ নিয়ে সাধারণ মানুষেরও একটা আগ্রহ আছে। কারণ তারা তো বিভিন্ন দলের ভূমিকায় হতাশ হয়েছেন। সাধারণ মানুষের চাওয়া আছে, ইসলামি শক্তি এক কাতারে আসলে তারা ভালো থাকবেন।
জামায়াত ইসলামীর আকিদাগত সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, কোন কোন কওমি উলামা দলটির বিষয়ে আপত্তি থাকলেও আসলে একেবারে বিচ্ছিন্ন থাকা ভাল কথা নয়। আমরা একের অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছি।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, আমরা মাসখানেক আগেও সভা করেছি। নীতিগতভাবে আমরা আগে থেকেই ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছি। আমরা মনে করি, জামায়াতের সঙ্গেও এই ঐক্য হতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আশা করছি, তখন আমরা এই নির্বাচনী ঐক্যকে একটি চূড়ান্ত রূপ দিতে পারব।
জানা গেছে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত ইসলামি দল সব মিলিয়ে ৬০ টিরও বেশি। এসব দলের মধ্যে হাতে গোনা ৭-৮টি দলের মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম থাকলেও অনেক দল অস্তিত্ব বিলীনের পথে। নিবন্ধিত ইসলামী দল রয়েছে মাত্র ১১টি।নিবন্ধিত ইসলামি দলগুলো হলো- খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামিক ফ্রন্ট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাকের পার্টি, ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি।
এর বাইরে বড় ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামী বারবার সংসদ নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে ভোট করে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিতও¡ করেছে দলটি। একটি রিটের পর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। ওই বছরের ২ নভেম্বর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর জামায়াত ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। সম্প্রতি আপিল বিভাগের জামায়াতের নিবন্ধন ও রাজনীতি নিষিদ্ধে হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করেছে। এছাড়া দলটির প্রতীকের বিষয়েও ইসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়। ভোটের ক্ষেত্রে জামায়াতের পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এখন মাঠ পর্যায়ে গুরুত্ব রয়েছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফের ইসলামী দলগুলো নিজেদের মধ্যে ফের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। সেই জায়গা থেকে দলগুলোর নেতারা একে অপরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। বিশেষ করে দুটি দলকে এ ব্যাপারে বেশ তৎপর দেখা গেছে। যার একটি হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী আর অন্যটি চরমোনই পীরের নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইসলামী আন্দোলন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়েও সভা সেমিনার করেছে।
তবে, আওয়ামী লীগের পতনের পর ইসলামী দলগুলোকে এক ছাতায় আনার জোর চেষ্টা শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। যার অংশ হিসেবে ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মত বিনিময় শুরু করে জামায়াত ইসলামী। এর মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, জাকের পার্টি, খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজী আন্দোলনও ছিল।
এছাড়া খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমীর মত আলেমদের সঙ্গেও জামায়াত নেতারা নানাভাবে বৈঠক করেন। মূলত ওই বৈঠকের মূল বিষয় ছিল ইসলামী দলগুলো যেন একে অপরের প্রতি বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলা থেকে রিবত রাখা এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক ঐক্য গড়ে তোলা। যার প্রভাব মাঠ পর্যায়েও পড়ে। দলগুলোর বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে আশার সৃষ্টি হয়।
ইসলামী দলগুলোর সেই ঐক্য প্রক্রিয়া এখন কোন পর্যায়ে সেটি জানতে ইসলামী ঘরানার রাজনৈতিক দলগুওেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর সাথে দৈনিক ভোরের আকাশের পক্ষ থেকে কথা যোগাযোগ করা হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে কথা বলে জানা গেছে, সরকার পতনের পর যে ঐক্য প্রক্রিয়া চলছিল সেটি এখনো চলমান। দলগুলোর নেতাদের পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তাও অব্যাহত রয়েছে। তবে, কিছুটা ধীর গতির কারণ হিসেবে বেশিরভাগ মাঠ পর্যায়ের কর্মী বলেছেন, দলগুলোর একে অপরের সঙ্গে বেশ ‘আকিদাগত’ অমিলই গতি মন্থর হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
এছাড়া জামায়াত ইসলামীকে অনেকে ‘মওদূদীবাদ’ মনে করাও নিজেদের মধ্যে ঐক্যে বাধার সৃষ্টি হয়। তবে, সব দলের প্রার্থী না হয়ে যেন একক প্রার্থী দেয়া সম্ভব হয় সে ব্যাপারে সব দলের নেতাকর্মীর ইতিবাচক আগ্রহ অটুট রয়েছে। নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বাড়াতে ইসলামী দলের নেতারা পরস্পরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধও বাড়িয়েছে।
গত ২১ জানুয়ারি হঠাৎ জামায়াত ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বরিশালে নিজ দলের কর্মিসভায় যোগ দেওয়ার আগে চরমোনাই সফর করেন। এসময় চরমোনাই পীর ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে বৈঠকও করেন জামায়াত আমির।
বৈঠক শেষে দুই ইসলামী দলের প্রধান বলেন, তারা ভোট কেন্দ্রে ইসলামী দলের পক্ষে একটি বাক্স পাঠাতে চান। সে লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন।
এছাড়াও ইসলামী দলগুলোর নেতারা জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে প্রায়ই একই মঞ্চে বসছেন। আলাপ আলোচনা করছেন তারা। গত ৩০ এপ্রিল জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের উদ্যোগে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের ইসলামফোবিয়া: করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে বেশিরভাগ দলের নেতারা অংশ নেন। সেমিনারে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজসিল, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোটসহ সমমনা ইসলামী দলগুলোর শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা এবং বিতর্কিত কমিশন কমিশন বাতিলে একাট্ট হন তারা।
এর কয়েকদিন আগেও গত ২৩ এপ্রিল সমমনা ৫ টি দলের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ রাজনৈতিক সংলাপ করে। বৈঠক শেষে চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছিলেন, আমরা সমমনা পাঁচটি ইসলামী রাজনৈতিক দল একত্র হয়ে কতগুলো মৌলিক বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পেরেছি। সামনে জাতীয় নির্বাচন, আমরা যেন ইসলামি দলগুলো একটি বাক্সে ভোট পাঠাতে পারি, বিষয়টি নিয়ে কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। অনেকের আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে। আলোচনায় আমরা সন্তুষ্ট।
এছাড়া সংস্কার, নির্বাচন ও চলমান পরিস্থিতি সবাই একমত হয়েছেন বলে জানান তিনি। এই ৫টি দল সম্প্রতি আরো একটি বৈঠক করেছে। ইসলামী দল হলেও ভিন্ন মতাদর্শের নেতাদের বৈঠকের পর একই সুরে বক্তব্য দেওয়ার পর ফের ঐক্যের বিষয়টি সামনে এসেছে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যেহেতু রাজনীতির মাঠ সরগরম হচ্ছে তাই অনেকে এখন মনে করছেন যে, দ্রুত ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের গতি ত্বরান্বিত হবে।
তবে, আকিদাগত বিষয়ে ইসলামী দল। গুলো বেশ মতবিরোধ রয়েচে। বিশেষ করে জামায়াতের আকিদার বিষয়ে জোরালো আপত্তি অনেক কওমী আলেমের মধ্যে। এছাড়া বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলও ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে ঐক্য গড়তে চাইছে। তাই শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে বাদ দিয়ে ছোট ছোট ইসলামী দলগুলো নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়তে পারবে কিনা তা প্রশ্ন উঠেছে। তবে, দলগুলোর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তফশিল ঘোষণার আগে বা নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর নেতারা স্পষ্ট করবেন। তারা এখন নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছন।
একদিকে, বড় দলগুলোর মনোভাব বা পরিস্থিতি বুঝে তারা সামনের এগোনোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করবেন। অন্যদিকে, আগেভাগে ঘোষণা দিলে সেটি কারো কারো মাথাব্যথার কারণ হতে পারে এমন বিষয়ও মাথায় রয়েছে দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের। এছাড়া ঐক্যের ব্যাপারে জামায়াত ইসলামী যেমন কৌশলী আবার ঠিক বিপরীতে অন্যান্য দলগুলোও জামায়াত নিয়ে কৌশলী ভূমিকায় রয়েছে, যা নিয়ে সম্প্রতি রাজনীতির মাঠে আলোচনাও চলছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ