শহীদুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৫ ০৭:৪৭ এএম
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন ও আগামীর রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা ‘জুলাই সনদে’র দিকেই চোখ এখন জনগণের। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে জুলাইয়ের অংশীজনরা যেন প্রতিক্ষার প্রহর গুনছেন এ সনদ নিয়ে। অংশীজনদের মতে, সরকারকে জুলাই ঘোষণা পত্রে কিছুটা ছাড় দিলেও জুলাই সনদের ক্ষেত্রে আর কোন ছাড় দিবে না তারা। সনদ হতে হবে পরিপূর্ণ নির্বাচন উপযোগী ও জনকল্যানমুখী।
ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই দফা সংলাপে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ৮২ দফার সমন্বিত জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া সরকারের তরফ থেকে গতকাল বুধবার কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে সনদ বাস্তবায়নে ৯ দফার অঙ্গীকারজুড়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে জুলাই সনদের বৈধতা নিয়ে পরবর্তীতে যে কেউ আদালতেও প্রশ্ন তুলতে না পারে।
অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তা এবং সনদের কোনো বিষয় সংবিধান বা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে সনদকে প্রাধান্য দেওয়ার অঙ্গীকার করাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জুলাই সনদের আইনি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারো আলোচনায় বসবে ঐকমত্য কমিশন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের জন্য প্রথম ধাপে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের কার্যক্রম শুরু করে। কমিশনটি নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমনবিষয়ক সংস্কার কমিশন নিয়ে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। পরে সেই ৬ কমিশনের সমন্বয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। সেই কমিশনের প্রধান হিসেবে আছেন ড. ইউনূস।
যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করবে। পরে তার ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ পরিচালিত হবে। সেই লক্ষ্যে গত মার্চ মাসে ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে প্রথম ধাপে ১৬৬টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। সেখানে ৬২টি প্রস্তাবে দলগুলো ঐকমত্য হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাপের দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে ২০টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। যার মধ্যে ৯টিতে বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপির নোট অব ডিসেন্ট আছে অর্থাৎ তারা এতে পুরোপুরি একমত না, বাস্তবায়ন না করার পক্ষে।
এর আগে, দলগুলোর ঐকমত্য হওয়া ৮২টি প্রস্তাব নিয়ে গত ২৮ জুলাই দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের প্রাথমিক খসড়া দেওয়া হয়। খসড়ার ৩ নম্বর দফায় ছিল পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সনদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে দলগুলো। এই প্রস্তাবে বিএনপিসহ তাদের সমমনা কয়েকটি দল সমর্থন করে। কিন্তু এতে আপত্তি জানায় জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলনসহ অধিকাংশ দল। তারা জুলাই সনদ বর্তমান সরকারের সময়ে বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবি তোলেন, না হলে জুলাই সনদের স্বাক্ষর না করার হুমকি দেয়া হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের পক্ষ থেকে জুলাই সনদ দ্রুত বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরিতে পুনরায় গত ১০ এবং ১২ আগস্ট সংবিধান ও আইনজ্ঞদের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আলোচনা করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ৯ দফা অঙ্গীকারনামা প্রস্তুত করে। ১২ আগস্ট সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কমিশনের কার্যক্রমের মেয়াদ ১৫ আগস্ট থেকে এক মাস বাড়িয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়। এছাড়া মঙ্গলবার রাষ্ট্র সংস্কার, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, ঐকমত্য কমিশনের জাতীয় সনদসহ রাজনৈতিক দলের সংলাপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে ঐকমত্য কমিশনের।
ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন এবং আইনি ভিত্তি কীভাবে দেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব এসেছে। তবে, এখন পর্যন্ত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি দেওয়ার অঙ্গীকারগুলো চূড়ান্ত হয়নি। কমিশনের পক্ষ থেকে জাতীয় (জুলাই) সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া কপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সমন্বিত খসড়ায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দীর্ঘ আন্দোলন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবনদান, অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে জনআকাক্সক্ষার জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সমন্বিত খসড়ায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি উল্লেখ করার পাশাপাশি সংস্কার কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াসহ দুই ধাপের সংলাপে সিদ্ধান্ত আসা ৮২টি বিষয় থাকবে। যেখানে কোনো-কোনো রাজনৈতিক দল কোনো প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে তা উল্লেখ থাকবে। একইসঙ্গে সনদ বাস্তবায়নের ৯ দফার অঙ্গীকারনামা থাকবে। যার ভিত্তিতে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো।
অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদের ব্যাখ্যা, প্রয়োগ ও বৈধতা সংক্রান্ত বিষয়গুলোর এখতিয়ার আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকা এবং সনদকে সম্পূর্ণ আইনগতভাবে কার্যকর হিসেবে গণ্য করা, তার বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে আদালতেও প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে উল্লেখ রাখা হয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তার পাশাপাশি সনদের কোনো শব্দ, বাক্য ও নীতিমালা সংবিধান বা অন্যকোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সনদকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা থাকছে অঙ্গীকারনামায়।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সমন্বিত খসড়ায় অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে বিবেচিত সুপারিশগুলো কালক্ষেপণ না করে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ করা আছে। জনগণের সার্বজনীন অভিপ্রায়ে তৈরি করা সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানের ৯৩(২) অনুচ্ছেদ বা অন্য কোনো আইন বা রায় থাকা সত্ত্বেও কার্যকর ও প্রাধান্য লাভ করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সম্বলিত অধ্যাদেশ জারি করার ওয়াদার বিষয়টিও রয়েছে।
জানা গেছে, জুলাই সনদে খসড়ায় দেশের শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার প্রস্তাব বা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধনের কথা রয়েছে।
অঙ্গীকারনামায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানকে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং গণঅভ্যুত্থানের সময়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দলগুলোর কাছে ওয়াদা নেওয়া হবে।
এদিকে জুলাই ঘোষণাপত্রের আইনিভিত্তি এবং সনদের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বুধবার বিক্ষোভ মিছিল করেছে করেছে জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনের আগে সংস্কার কার্যকরে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, ভোটের অনুপাত (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডসহ সাত দফা দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করে দলটি। এর আগেও একই দাবিতে কয়েক লক্ষাধিক নেতাকর্মী নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশের করে জামায়াত।
এ বিষয় জামায়াতে ইসলামী জানায়, ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে জনআকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন হয়নি। একই সঙ্গে জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে বলে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের হওয়ার ক্ষেত্রে জামায়াতের কোনো আপত্তি নেই। তবে তার আগে জুলাই সনদদের আইনি ভিত্তি ও নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। দুই বছর পরে নির্বাচিত সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে এমনটা করার সুযোগ নেই। ভোটের আগেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। এই জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচন দিতে হবে।
জুলাই সনদ নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টিও সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদ কার্যকর ও সংস্কার বাস্তবায়ন ছাড়া এনসিপি নির্বাচনে যাবে না। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে দেশ আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি তাতে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দেয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অনেকগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করা হবে কি না, সেটা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত না হলে শহীদদের ত্যাগ ও সবার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
এনসিপি নেতা আরিফুল ইসলাম আদীব জানান, উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, দলীয় পদে প্রধানমন্ত্রীর না থাকা, দুই সংসদের নির্বাচিত প্রার্থীদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের মতো কিছু বিষয়ে একমতে আসা না গেলে এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, যেকোনও সাংবিধানিক ও আইনি প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের সম্মতি আছে। এর বাইরেও যদি কোনো প্রক্রিয়া কেউ প্রস্তাব করে, সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। আমরা নিশ্চয়ই আলোচনায় অংশগ্রহণ করবো, সবসময় জুলাই সনদ নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য রাজি। তবে কমিশন চূড়ান্ত জুলাই সনদ পাঠালে আলোচনা অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেই বিএনপি তাতে স্বাক্ষর করবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ