ফাইল ছবি
জুলাই সনদ ইস্যুতে গণভোটের পক্ষে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
রোববার (৫ অক্টোবর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের চতুর্থ দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।
আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক ঐক্যে পৌঁছেছে দলগুলো। এটি বড় ধরনের অর্জন। আশা করি, অন্যান্য বিষয়েও দ্রুত একমত হবো। আগামী ৮ অক্টোবর এ বিষয়ে আবারও বৈঠকে বসবে কমিশন।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে ইতোপূর্বে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এখন অনেকে এ বিষয়ে কিছুটা সরে আসছেন। এ জন্য দলগুলোকে ধন্যবাদ। আশা করি, একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দিতে পারবো। প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, আমরা ১৫ অক্টোবরের মধ্যে একটি মিমাংসায় আসতে পারবো।
তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার বিষয়ে তিন চতুর্থাংশ দলের কাছে নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেকে নাম দিয়েছেন, অনেকে এখনও দেননি। দ্রুত নাম দিতে তিনি দলগুলোকে অনুরোধ করেন।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আরও বলেন, দুই-এক দিনের মধ্যে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আবারও বৈঠকে বসবে কমিশন। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), আমার বাংলাদেশ পার্টিসহ (এবিপার্টি) ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশ নেন। কমিশনের সদস্য হিসেবে ছিলেন– বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
ভোরের আকাশ/এসএইচ
সংশ্লিষ্ট
কান্না ভেজা চোখে শহীদ আবরার ফাহাদের বাবা মো. বরকত উল্লাহ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার ছেলের দোষ কী ছিল? সে শুধু আগ্রাসনবিরোধী লেখালেখি করেছিল।’ তিনি বলেন, আবরার বলেছিল— ‘আমার রুমের আশেপাশে সবাই ছাত্রলীগের ছেলে। কেউ এলে ওরা আমাকে মারতে দেবে না।’ মঙ্গলবার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় আবরার ফাহাদের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সারা দেশের জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে একযোগে প্রামাণ্যচিত্র ‘ইউ ফেইলড টু কিল আবরার ফাহাদ’ প্রদর্শন করা হয়।আবেগঘন বক্তব্যে বরকত উল্লাহ বলেন, সে শুধু আগ্রাসনবিরোধী লেখালেখি করেছিল। শুরুতে আমরাও জানতাম না সে এমন লিখে। পরে জানতে পেরে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তখন সে বলেছিল— ‘আমি খারাপ কিছু লিখি না, কেউ আমাকে কিছু বলবে না।’ সে আরও বলেছিল— ‘আমার রুমের আশেপাশে সবাই ছাত্রলীগের ছেলে। কেউ এলে ওরা আমাকে মারতে দেবে না।’ কিন্তু আমার ছেলে যেদিন ছুটি শেষে হলে ফিরে গেল, তার পরের দিনই ছাত্রলীগের ছেলেপেলে তাকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলে।তিনি আরও বলেন, আমার ছেলের দোষ ছিল— সে দেশের পক্ষে লেখালেখি করেছে। দেশের ক্ষতি হচ্ছিল যেগুলোতে, সে সেগুলো তুলে ধরত। তার ফেসবুকে লিখেছিল— ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর কলকাতা বন্দর ব্যবহার না পেয়ে বাংলাদেশ গোলাপপোর্ট চালু করে, এরপর থেকেই ইলিশ কমে যায়। সে আরও লিখেছিল, পানি চুক্তিতে ভারত আমাদের সময়মতো পানি দেয় না, অথচ আমরা বিনা শর্তে দিয়েছিলাম ১ লাখ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি। এই ধরনের স্ট্যাটাসের কারণেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনীর ছেলেরা ও তার রুমমেট মিজান মিলে ওকে ‘শিবিরের ছেলে’ তকমা দেয়। এই মিথ্যা অভিযোগেই ছুটি শেষে হলে ফিরে আসার পরের দিন রাত ৮টা থেকে সারারাত নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।আবরারের বাবা আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, আমার ছেলে খুব ভীত ছিল। যদি ওদের কেউ বলত ‘লিখবে না’— তাহলে সে কখনো হলে ফিরে যেত না। কিন্তু ওরা তার কোনো কথা শোনেনি। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল কে কে শিবির করে, অথচ সে কোনো দলের ছিল না। যারা আমার ছেলের হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, আল্লাহ তাদের বিচার করেছেন।তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমার ছেলের মামলাটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে। এ বিচার যেন দ্রুত শেষ হয়।আবরারের বাবা আরও বলেন, ২০১৯ সালে আবরার ফাহাদ শহীদ হওয়ার পর থেকে প্রতি বছরই তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়েছে। এ পালন করতে গিয়ে গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনের কর্মীসহ সাধারণ মানুষ অনেকেই নির্যাতন, নিপীড়ন, এমনকি জেল খেটেছেন। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর এই প্রথম সারা দেশে সবাই একসঙ্গে এ মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছে— এজন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।তিনি আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন— বিগত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের নামের তালিকা প্রস্তুত করা হবে। কিন্তু সেই তালিকা এখনো প্রকাশ হয়নি। আমি চাই, তালিকাটি দ্রুত তৈরি ও প্রকাশ করা হোক।শেষে তিনি বলেন, আবরার ফাহাদসহ জুলাই-আগস্টে যারা শহীদ হয়েছেন, আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন— বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক শেখ রেজাউদ্দিন আহমেদ স্ট্যালিন, নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক দীপক কুমার গোস্বামীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা।অনুষ্ঠানে শহীদ আবরার ফাহাদের স্মরণে প্রামাণ্যচিত্র ‘ইউ ফেইলড টু কিল আবরার ফাহাদ’ প্রদর্শিত হয়।ভোরের আকাশ/মো.আ.
গাজা অভিমুখী ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে অপহৃত হয়েছেন বাংলাদেশি আলোকচিত্রী, লেখক ও দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলম।বুধবার (৮ অক্টোবর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক ভিডিওবার্তায় এ কথা জানান শহিদুল আলম নিজেই।পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমি শহীদুল আলম, বাংলাদেশের একজন আলোকচিত্রী এবং লেখক। আপনি যদি এই ভিডিওটি দেখে থাকেন, তাহলে এতক্ষণে আমাদের সমুদ্রে আটক করা হয়েছে। আমাকে ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী অপহরণ করেছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির সক্রিয় সহযোগিতা এবং সহায়তায় গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। আমি আমার সকল কমরেড এবং বন্ধুদের কাছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।এর আগে মঙ্গলবার ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি জানিয়েছিলেন, বুধবার ভোর নাগাদ ‘রেড জোন’ তথা বিপজ্জনক অঞ্চলে পৌঁছে যেতে পারেন।পোস্টে রেড জোন বলতে শহিদুল আলম বুঝিয়েছেন, যেখানে ইসরায়েলি সেনারা সম্প্রতি সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরকে আটকে অধিকারকর্মীদের আটক করেছেন।শহিদুল আলম সেই পোস্টে লেখেন, ‘আমরা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছি। কারণ ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস’ নৌবহরে থাকা ছোট ও ধীরগতির নৌযানগুলো যেন পেছনে পড়ে না যায়, তা নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। এসব জাহাজও এফএফসির (ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন) অংশ। তবে আমরা সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরের চেয়ে অনেক দ্রুত এগিয়েছি। ওই নৌবহর প্রচণ্ড বাতাস ও ঝড়ের কারণে সাময়িকভাবে থেমে গিয়েছিল।’শহিদুল আলম লিখেন, ‘ধীরগতির নৌযানগুলো (থাউজেন্ড ম্যাডলিনস) এখন আমাদের সমকাতারে এসেছে। আমরা এখন ‘রেড জোন’ থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে আছি। এটি সেই অঞ্চল যেখানে আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী অবৈধভাবে ফ্লোটিলার নৌযানগুলোকে আটক করেছিল।’ভোরের আকাশ/মো.আ.
আমাদের ভবিষ্যতের মা ও নাগরিক হিসেবে কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা, মানসম্মত শিক্ষা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু, যাদের প্রায় অর্ধেকই কন্যাশিশু। তাই, এই কন্যাশিশুরাই আগামীর স্বপ্ন, যারা দেশ মাতৃকার কল্যাণে অকুতোভয়ে কাজ করবে, বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বুধবার (৮ অক্টোবর) ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস-২০২৫’ উপলক্ষে মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) দেওয়া এক বাণীতে তিনি এসব কথা বলেন।ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি কন্যাশিশু-স্বপ্ন গড়ি, সাহসে লড়ি, দেশের কল্যাণে কাজ করি’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশব্যাপী ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস-২০২৫’ উদযাপিত হচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত। এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী প্রতিপাদ্য বলে আমি মনে করি। এই দিনে আমি বাংলাদেশের সব কন্যাশিশু ও তাদের অভিভাবকদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।এ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষায় জুলাই-আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সম্মুখ সারিতে ছিল আমাদের কিশোরী ও নারীরা। তারা আমাদেরকে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে।প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সমাজে কন্যাশিশু ও ছেলে শিশুর সমতার লক্ষ্যে সরকার নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশসহ বেশ কিছু সাংবিধানিক ও কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।সবশেষে বাণীতে ড. ইউনূস ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস-২০২৫’ উপলক্ষে আয়োজিত সব কর্মসূচির সফলতা কামনা করেন।ভোরের আকাশ/মো.আ.
রাজধানীতে মশার উপদ্রব লাগামহীন। মশা মারতে ‘কামান দাগানো’র মতো হাজার কোটি টাকা খরচেও রাজধানীবাসীর জন্য তা স্বস্তি এনে দিতে পারেনি। উল্টো মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে ‘কচু পাতার পানি’র মতো। এখানে একটি ছোট মশা নগরবাসীর জীবন বিপন্ন করে তুলছে।যখন-তখন প্রাণ চলে যাচ্ছে মানুষের। একেকটি পরিবার স্বজন হারিয়ে নিঃস্ব-অসহায় হয়ে পড়ছে। দুই সিটির বিশেষজ্ঞ, অঢেল টাকা খরচ আর প্রচার-প্রচারণা সবই যেন জলে যাচ্ছে। শুধু চলতি বছরই মারণব্যাধি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ১৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিস্ময়কর হলো দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১০৫ জন মারা গেলেও উত্তর সিটিতে মারা গেছে ২৯ জন।একই শহরের একাংশে কম মৃত্যু আর আরেক অংশে কয়েক গুণ বেশি মৃত্যুতেও দক্ষিণ সিটির তেমন বিকার নেই। উদ্যোগ আর হাঁকডাকেরও শেষ নেই। কিন্তু মশার উপদ্রব কমে না। মশার কামড়ে সৃষ্ট ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যুর মিছিলও থামে না। এতে নগরবাসীর দিন কাটছে চরম দুর্দশায়।এই যেমন রাজিবুল হক ও সানজিদা ইসলাম দম্পতি। তারা থাকেন রাজধানীর ভাটারা এলাকার দুই রুমের একটি ফ্ল্যাটে। একমাত্র মেয়ে জাইমা নিদাতের বয়স চার বছর।জাইমা চঞ্চল প্রকৃতির হলেও কাটাতে হচ্ছে বন্দি জীবন! এই দম্পতির বাসায় তিনটি জানালা ও একটি বারান্দা থাকলেও সূর্যের খানিক আলোতেই ভরসা করতে হয়। মশা তথা ডেঙ্গু আতঙ্কে তিন জানালায় নেট লাগানো। এতে হালকা আলো এলেও বাতাস আর প্রবেশ করতে পারে না। একটি মাত্র বারান্দায় নেট লাগানোর ব্যবস্থাও না থাকায় রাতদিন বন্ধই রাখতে হচ্ছে। এমন বন্দি দশায়ই কেটে যাচ্ছে জাইমার শৈশব।একটি প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি করা রাজিবুল হক বলেন, ‘কী আর বলব। এভাবেই কেটে যাচ্ছে। মেয়ের মাকে বলেছি দিনের বেলায় বারান্দার পাশটা একটু খুলে দিতে। কিন্তু অল্প সময়ের জন্য খুললেও বাসা মশার দখলে চলে যায়। ভয়ে ভয়ে থাকি। কারণ ডেঙ্গুতে আক্রান্তে মৃত্যুর মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি দেখছি।’সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই দম্পতির মতো একই অবস্থা রাজধানীর বেশির ভাগ বাসিন্দারই। সম্প্রতি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। মশার উপদ্রব বাড়ায় ভয় ও ভোগান্তিতে দিন কাটাচ্ছে নাগরিকরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর প্রভাব আরো বাড়তে থাকবে। আগে শীতকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ না থাকলেও এবার দেখা যেতে পারে ভিন্ন চিত্র।দুই সিটিতে ডেঙ্গুতে মৃত্যু: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ডিএনসিসিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ছয় হাজার ৪২ জন, ডিএসসিসিতে সাত হাজার ৭৭৬ জন। ডিএনসিসি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ২৯ জনের আর ডিএসসিসিতে ১০৫ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত নতুন করে দুই সিটিতে আরো ২৫০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরে ১৪১ জন, দক্ষিণে ১১৪ জন ভর্তি হয়। গত সোমবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত উত্তরে একজন এবং দক্ষিণে আরো একজন মারা গেছে। বর্তমানে দুই সিটির বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগী আছে ৮৫৯ জন।ঢাকার দুই সিটির মশক পরিস্থিতি এবং সাবধানতা নিয়ে মশা বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যদি সব কাজ করেই থাকে তাহলে নিয়ন্ত্রণ কেন হচ্ছে না? এটি একটি বড় প্রশ্ন। কে কী করছে, সচেতনতা কতটা বাড়ল, এগুলো ছাড়িয়ে বড় কথা হচ্ছে ডেঙ্গু আরো বাড়বে। এখন যে চিত্র আমরা দেখছি এটি কিন্তু স্বাভাবিক চিত্র নয়। চলতি মাসে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে। এই বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে শীতেও ডেঙ্গু থাকবে। হয়তো কিছুটা কমে আসবে, তবে অন্যান্য বছর এই সময়ে ততটা না থাকলেও এবার থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে মশক কার্যক্রমে গতি আনা উচিত।’বছর বছর মশা নিধনে বাজেট বাড়লেও উপদ্রব কমে না: দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ বছরে ঢাকার মশা নিধনের নানা পদক্ষেপের পেছনে খরচ হয়েছে এক হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে দুই সিটিতে মশা নিধনে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫৪ কোটি টাকা। ডিএসসিসি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় রাখা হয়। অন্যদিকে উত্তরে প্রায় ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে রাখা হয় ৬৫ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহন, ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক এবং মশা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ রাখা হয়।২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নতুন অর্থবছরে এক কোটি টাকা বাড়িয়ে মশা নিধনে ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ডিএসসিসি। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে মশা নিধনে ফগার, হুইল ও স্প্রে মেশিন বাবদ আরো দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটিতে মশা নিয়ন্ত্রণ কাজের জন্য ১৮৭ কোটি টাকা টাকা, মোট বাজেটের ৩ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ আগের বছরে ছিল ১১০ কোটি টাকা।মশা নিধনে দুই সিটির কার্যক্রম: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন সকাল-বিকাল প্রতিটি ওয়ার্ডে লার্ভিসাইডিং ও এডাল্টিসাইডিং করা হয়। এ বছর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর জনসচেতনতার কাজে জোর দেওয়া হয়েছে। করপোরেশনের প্রতিটি অঞ্চলে ছোট ছোট টিম করে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করা হচ্ছে। ওয়ার্ড সচিবদের সমন্বয়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা কাজ করছেন।এক কর্মকর্তা বলেন, আসলে যে যাই বলুক শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যদি তাই হতো নিয়মিত ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, লার্ভিসাইড বা কীটনাশক প্রয়োগ করা হলেও কেন মশা কমছে না। আসল সমস্যা এই শহরের কাঠামোতে। কারণ এ শহরে ড্রেন, ডোবা, নর্দমা, বিল, ঝিল ও খালে পানির প্রবাহ নেই। এসব স্থানে দীর্ঘদিন ধরে মানুষ ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। এতে পানির ঘনত্ব বেড়ে মশা প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আর সবাই সিটি করপোরেশনকেই দোষ দিচ্ছে। তবে সিটি করপোরেশন এমনটা বললেও দক্ষিণে প্রতিটি ওয়ার্ডে লার্ভিসাইডিং করার জন্য সকালে সাত মশককর্মী আর বিকেলে ছয় মশককর্মী থাকার কথা থাকলেও বাসিন্দাদের অভিযোগ বাস্তবে এমনটা দেখা যায় না।জানা গেছে, উত্তর সিটিতে মশা নিয়ন্ত্রণে স্বাভাবিক সময়ের স্প্রে থেকে শুরু করে সব কার্যক্রম চালু রয়েছে। এ ছাড়া অনেক ধরনের কমিটি করা হয়েছে। কারিগরি কমিটি, স্পেশাল টাস্কফোর্স কমিটি, ওয়ার্কিং কমিটি, ওয়ার্ড লেভেল কমিটি, এখন আবার নতুন কীটনাশকের গুণাগুণ যাচাইয়ের জন্য কমিটি। এসব কমিটিতে বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। কিন্তু এর পরও মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।তবে উত্তরে এই মশককর্মীর কার্যক্রম তদারকির জন্য বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সহযোগিতা নিলেও দক্ষিণ সেটি করেনি বলে জানা গেছে। ডিএনসিসি জলাশয়গুলোতে নোভালরুন ট্যাবলেট ছিটিয়েছে। দুই সিটিতেই জলাশয়গুলোর কচুরিপানা ও আবর্জনা পরিষ্কারেও এবার গতি কম।এমন পরিস্থিতিতে মাঝেমধ্যেই ভারি বৃষ্টিতে মশার বংশবিস্তার হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমের আগে উন্মুক্ত ড্রেন, বক্স-কালভার্টের বর্জ্য যেভাবে অপসারণের প্রয়োজন ছিল, সেখানেও এবার ঘাটতি আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। উত্তরে মশক নিধনের জন্য কিছু হুইলব্যারো মেশিন সংগ্রহ করা হলেও সেগুলো পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টেকনিক্যাল কমিটি বুঝে না নিলে কিছু করা যাচ্ছে না। যে যা-ই বলুক বাসিন্দাদের ভোগান্তি আর কমছে না।ঢাকার লালবাগের শহীদনগরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় বসবাস ওয়াশিউর রহমান নামের এক টেকনিশিয়ানের। তিনি বলেন, ‘দিনরাত নাই। সব সময় মশার যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে। কয়েল, মশারি কিছুতেই নিস্তার নেই। কিভাবে যে ঢুকে তা বুঝতে পারি না। বাসায় কারো জ্বর হলেই ভয়ে থাকি।’মিরপুরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা রেজাউল করীম মাঝি বলেন, ‘বৃষ্টি হলে আমাদের বাসার গলিতে পানি জমে। কয়েক ঘণ্টা পর পানি সরে গেলেও কিছু জায়গায় পানি আটকে থাকে। ড্রেন আর জমা পানিতে মশার বাচ্চা কিলবিল করতে দেখি। আগে সিটি করপোরেশনের কর্মীদের যে পরিমাণ স্প্রে করতে দেখতাম এখন ততটা দেখি না। মনে হয় দায়সারা কাজ করে।’জানা গেছে, বর্তমানে ১০ থেকে ১২টি ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তারা ওয়ার্ড সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞাত না থাকায় সমস্যা হচ্ছে। ফলে কোন এলাকায় মশক নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে, সেটি তারা বুঝতে পারছেন না। আগে ড্রোন দিয়ে ওপর থেকে মশার ক্লাস্টার চিহ্নিত করে সেখানে ওষুধ ছিটানোর কাজও চলেছে কখনো কখনো। ভ্রাম্যমাণ আদালত নির্মীয়মাণ ভবন বা স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা, মশা বা মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ পেলেই জরিমানা করা হয়েছে। গুণী ও জনপ্রিয় তারকাদের নিয়ে ডেঙ্গুবিষয়ক নানা প্রচারাভিযানও চালাতে দেখা গেছে। এখন এসব দেখা যায় না।সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ১০টি করে ২০টি অঞ্চলে ২০ জন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও আছেন ১১ জন। আগে মশককর্মীদের ওষুধ দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতেন প্রতিটি ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর। দুই সিটি করপোরেশনে কাউন্সিলর ছিলেন ১২৬ জন। এখন কাঠামোতে সমস্যা হওয়ায় মাঠের কাজেও প্রভাব পড়ছে।সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কী বলছেন: এসব বিষয়ে ডিএসসিসির সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং ডেঙ্গু ফোকাল পারসন ডা. ফারিয়া ফয়েজ বলেন, ‘আগে ওয়ার্ড সচিবদের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও এখন আঞ্চলিক অফিসের মাধ্যমে হচ্ছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের যোগাযোগ রয়েছে। এখানে কোনো ঘাটতি নেই। বরং আগের চেয়ে এখন ভালোভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর বিভিন্ন ওয়ার্ডের মশককর্মীরা অনুপস্থিত থাকায় ঘাটতি তৈরি হয়। এটি পরবর্তী সময়ে পূরণ হয়ে গেছে। যদিও একটু অদক্ষ হওয়ায় তাদের সময় লাগছে।’১০৫ জন মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দক্ষিণে ২৪ জন মারা গেছে। আর যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা চিকিৎসা নিতে এসে মারা গেছে।’ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মশক নিধনে আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। সচেতনতা বৃদ্ধিতেও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। হুইলব্যারো মেশিনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন ডা. ইমদাদুল হক।’পরে উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. ইমদাদুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হুইলব্যারো মেশিন এখনো রিসিভ করা হয়নি। দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে রিসিভ করা হবে। আমাদের কাছে এলেও এটি টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে রিসিভ করতে হবে।’তিনি আরও বলেন, ‘প্রধান নির্বাহী স্যার কেন আমার সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন তা জানি না। এই বিষয়ে কথা বলবেন আমাদের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা স্যার। তিনি আমাকে বললে আমি কথা বলতে পারতাম। আমরা চাইলেই কথা বলতে পারব না। মিটিং হয়েছে এবং প্রজ্ঞাপনও হয়েছে, আমরা এগুলো নিয়ে কথা বলব না।’পরে এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরীর অফিশিয়াল নাম্বারে বারবার চেষ্টা করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সূত্র: কালের কণ্ঠভোরের আকাশ/মো.আ.