জুলাই গণঅভ্যুত্থান
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২৫ ০৯:০৩ এএম
ছবি-ভোরের আকাশ
ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে গত বুধবার বিশেষ তিনটি দিবসের ঘোষণা দেয় সরকার। এই তিনটি দিবসের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দিন ৮ আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে আপত্তি ও প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। প্রথমে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা শুরু করলেও পরবর্তীতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রজনতাও সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন।
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন ৫ আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণার জোর দাবি জানিয়েছেন তারা। তীব্র সমালোচনা ও আপত্তির মুখে সরকার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার কথা ভাবছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন ৫ আগস্টকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দিনটিকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া গণআন্দোলন চলাকালে রংপুরে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের নিহত হওয়ার দিন ১৬ জুলাইকে ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ ঘোষণা করা হয়েছে।
গত বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করা হয়েছে বলে সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে। তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, প্রতিবছর যথাযথভাবে এ তিন দিবস প্রতিপালন করতে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে অনুরোধ করা হয়েছে। ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত এবং অপর দুটি দিবস ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে বলে তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে। তবে এ খবর প্রকাশের পরপরই আপত্তি জানান গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টির(এনসিপি) প্রথম সারির কয়েকজন নেতা।
৮ আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ করার ঘোষণায় সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম এবং আখতার হোসেন। তাদের মধ্যে আখতার হোসেন নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’র সদস্য সচিব এবং সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ দলটির যথাক্রমে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মূখ্য সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে হাসনাত আবদুল্লাহ লেখেন, ‘নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ৫ আগস্ট, ৮ আগস্ট নয়। সাধারণ ছাত্রজনতার এই অর্জনকে সরকারের কুক্ষিগত করার চেষ্টা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না।’
সারজিস আলমও একই দিনে ফেসবুকে লেখেন, ‘৮ আগস্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতা শুরু হয়নি, বরং ওইদিন থেকেই দ্বিতীয় স্বাধীনতা নষ্টের, ছাড় দেওয়ার এবং বিপ্লব বেহাতের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’
তিনি আরো লেখেন, ‘৫ আগস্টই ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ এবং ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত হওয়া উচিত।’ হাসনাত ও সারজিসের বক্তব্যের পর এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেনও ফেসবুকে এ নিয়ে নিজের অবস্থান জানিয়েছেন। তিনি লেখেন, ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস সেদিনই হবে, যেদিন জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হবে এবং মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ গৃহীত হবে।’
এবার ৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভেরিফাইড আইডিতে গত শুক্রবার এক পোস্টে তিনি লেখেন, ৮ নয় ৫ই আগস্টকেই নতুন বাংলাদেশ দিবস ঘোষণা করা উচিত।
তবে এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গত শুক্রবার রাতে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দিবসসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ইতোমধ্যে ঘোষিত তিনটি দিবস নিয়ে সরকারের বিভিন্ন স্তরে আলোচনা চলছে।
সরকার গঠনের দিন একটি বিশেষ দিবস হিসেবে পালিত হওয়া উচিত কি-না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘উচিত কি উচিত না সেটা বলা আমার দিক থেকে ঠিক হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দিবসগুলোর বিষয়ে সরকার পুনর্বিবেচনা করছে। দুদিনের মধ্যে এ বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
আসিফ মাহমুদ জানান, ‘অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই যেকোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে নমনীয়। সবার মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা করে আসছে।’
এদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান বলেন, ‘কেবল নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ ছাড়া এই দিনটির আর বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই। দিবস ঘোষণার মধ্যদিয়ে মূলত সরকার তার লিগ্যাসি (উত্তরাধিকার) রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু, সেটা তো করবে কাজের মধ্যদিয়ে। যদি অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, তাহলে এই সরকারকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে। তার জন্য একটা আস্ত দিবস রাখা তো অর্থহীন।’
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান তার ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া বক্তব্যে এই সিদ্ধান্তগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার মতে, ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ নামকরণটিকে অনেকেই স্বৈরশাসন পরবর্তী আচরণের অনুরূপ বলে মনে করছেন।
তিনি বলেন, ‘সরকার নিজেই নিজের কর্মকাণ্ডকে গৌরবমণ্ডিত করছে, এটি শেখ হাসিনা শাসনামলের প্রতিচ্ছবি মনে করিয়ে দেয়।’
আলোচনায় শহীদ আবু সাঈদের স্মরণে ১৬ জুলাই ‘আবু সাঈদ দিবস’ ঘোষণা নিয়েও মতামত দেন তিনি। আবু সাঈদের আত্মত্যাগকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও আবেগঘন উল্লেখ করলেও তিনি মনে করেন, আলাদা দিবস ঘোষণার প্রয়োজন ছিল না। তার ভাষায়, ‘গণঅভ্যুত্থানে অনেকেই শহীদ হয়েছেন। কিন্তু সবার জন্য আলাদা দিবস করা হয়নি। তাই ভারসাম্য থাকা উচিত।’
জাহেদ উর রহমান আরো বলেন, ‘৫ আগস্টের ঘটনাকে যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত ও নামকরণ করা দরকার ছিল। এই দিনটির গুরুত্ব বিবেচনায়, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নাম নির্ধারণ করলে তা অধিক গ্রহণযোগ্য হতো।’
বর্তমান সরকারের পারফরম্যান্স নিয়েও হতাশা প্রকাশ করে তিনি মন্তব্য করেন, সরকার নিজেরাই নতুন বাংলাদেশ দিবস ঘোষণা করছে, এটা হাস্যকর। বরং একটি মাত্র দিন ৫ আগস্টকে গণঅভ্যুত্থান দিবস হিসেবে রেখে তাতেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ভোরের আকাশ/এসএইচ