নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৫ ০৯:৫৩ পিএম
নিউ মার্কেট-এলিফ্যান্ট রোডে জমেছে ঈদের কেনাকাটা
শিপংকর শীল : মায়ের হাত ধরে হাটছে ১০ বছরের শিশু ফাতেমা। একের পর এক জামা-কাপড়ের দোকান দেখেই চলেছেন মা সুফিয়া বেগম। ঈদের জামা-কাপড় কেনার জন্য রাজধানীর নিউ মার্কেটে এসেছেন তারা। পছন্দের কাপড় ও দাম- এই দুটো বিষয়ের এক না হওয়ায় এক ঘণ্টা ঘুরেও তাদের কেনাকাটা হচ্ছে না। এভাবে সুফিয়া বেগম ও তার মেয়ের মত হাজার হাজার ক্রেতার ভিড়ে জমে উঠেছে নিউ মার্কেটসহ আশেপাশের মার্কেটগুলোর ঈদবাজার।
নিউ মার্কেটর দোতলার একটি দোকান থেকে একটি জিন্সপ্যান্ট কিনে বেরিয়ে যাচ্ছেন মো. সোবহান নামে এক যুবক। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ‘ পছন্দের ফুলপ্যান্ট পেয়েছি। দাম ১৩শ’ টাকা। একটা প্যান্ট কিনতে কয়েকটি মার্কেট ঘুরতে হয়েছে। এলিফ্যান্ট রোড থেকে ৭শ’ টাকায় শার্ট কিনেছি।’
নিউ মার্কেটে জুতার দোকান আছে কবির হোসেনের। তিনি বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে বাজার জমে উঠেছে। বেড়েছে বেচাকেনাও। ঈদের রাত পর্যন্ত বেচাকেনা চলে। গতবারের তুলনায় এবার বিক্রি বেশি হবে বলে আশা করছি।’
গাউছিয়া মার্কেটের নিচতলায় প্রসাধীপণ্য কেনাকাটায় ব্যস্ত আলপনা আখতার। তিনি মেরুলবাড্ডার বাসিন্দা। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ‘ দু’ মেয়ে ও নিজের জন্য ঈদ প্রসাধনী কিনতে এসেছি। দু’ হাজার টাকার পণ্য কিনেছি। আরও কয়েকটি আইটেম কেনার বাকি রয়েছে।’
নিউ মার্কেটে ঈদের পোশাক কিনতে এসেছেন রহিম হোসেন। পরিবারের সদস্যদের জন্য মার্কেটে ঘুরে ঘুরে শাড়ি, থ্রি-পিসসহ পাঞ্জাবি কিনেছেন বলে জানালেন। তিনি বলেন, ‘আসলে ঈদের তো দু’ সপ্তাহ বাকি। এই সময়ে জিনিসপত্রের দাম একটু বেশি নেয়। কিন্তু তেমন বেশি মনে হচ্ছে না। স্বাভাবিক আছে।’
ফুটপাতে নারীদের রেডি পোশাক বিক্রি করেন কামরুজ্জামান। ঈদের বিক্রি কেমন জানতে চাইলে বলেন, ‘মানুষের প্রত্যাশার শেষ নাই। তবে শেষ বেলায় যা দিছে আল্লায় ভালোই দিছে।’ ঢাকার নিউ মার্কেট সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহিন বলেন, ‘এ বছর ঈদ কেনাকাটায় যে প্রত্যাশা ছিল শেষ পর্যন্ত তার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছোঁয়া যেতে পারে।’
বেশ কয়েক দিন ধরে মার্কেটে উপচেপড়া ভিড়ের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তবে এখনও আমাদের যে প্রত্যাশা সে অনুযায়ী বিক্রি হয়নি। জেলা পর্যায়েও এখন বড় বড় শপিংমল গড়ে উঠেছে। সেখানে গিয়ে শপিং করছেন অনেকেই। আবার মফস্বলের অনেকেই এখন রাজধানীতে শপিং করতে আসেন না। ফলে দোকানগুলোয় বিক্রি তেমন হচ্ছে না।’
অন্য বছরগুলোতে রোজার সময় বিকেলে কিংবা সন্ধ্যার পর থেকে নিউ মার্কেট ও আশেপাশের মার্কেটগুলোতে কেনাকাটার জন্য মানুষজনের উপস্থিতি দেখা গেলেও এ বছর দুপুরের আগে থেকেই মানুষজন মার্কেটে ভিড় করছেন। এতে করে আগেভাগেই ঈদের বাজারে তৈরি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মার্কেট এবং শপিংমলগুলোতে সকাল থেকে শুরু হচ্ছে ব্যস্ততা। নানা ধরনের অফার এবং ঈদ স্পেশাল কালেকশন বিক্রি করা হচ্ছে জনপ্রিয় শপিংমলগুলোতে। পোশাকের দোকানগুলোতে পুরুষদের পায়জামা-পাঞ্জাবি, শার্ট-প্যান্ট, গেঞ্জি, টিশার্ট, নারীদের শাড়ি, থ্রিপিস, ওয়ান পিস, কুর্তা এবং বাচ্চা ও শিশুদের পায়জামা-পাঞ্জাবি, ফ্রক, গেঞ্জিসেটসহ আধুনিক ডিজাইনের পোশাক পাওয়া যাচ্ছে। একইসঙ্গে কসমেটিকস, জুতা, ঘর সাজানোর সামগ্রী এবং গহনার দোকানগুলোতেও ভিড় জমাচ্ছেন মানুষজন।
নিউ মার্কেটের চন্দ্রিমা মার্কেটের মনির ফ্যাশনের বিক্রয়কর্মী আজগর আলী বলেন, ‘সারাদিন বেচাকেনা যেমনই হোক না কেন ভিড় বাড়ে সন্ধ্যার পর থেকে। সবাই ইফতারের পর থেকেই কেনাকাটা করতে আসে। ঈদ উপলক্ষ্যে সুতি ও আরামদায়ক কাপড়ের শার্ট, টিশার্ট, প্যান্টের নতুন কালেকশনের চাহিদা অনেক বেশি। আশা করছি দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেচাকেনা আরও বেশি জমজমাট হবে।’
এছাড়া, বেশ জমজমাট অবস্থা দেখা গেছে রাজধানীর সাইন্সল্যাব, নিউমার্কেট এবং এলিফ্যান্ট রোড এলাকায়। এসব এলাকাজুড়ে মার্কেট, শপিং মলের পাশাপাশি ফুটপাতেও বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পোশাক, গহনা ও কসমেটিকস। এরমধ্যে নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, নূর ম্যানশন মার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট এবং নূরজাহান ম্যানশনে মহিলা ক্রেতার পরিমাণ বেশি দেখা গেছে। চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ও ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট, নুরজাহান সুপার মার্কেট এবং গ্লোব শপিং সেন্টারের শার্ট-প্যান্টের দোকানগুলোতে ভিড় বেশি ছিল তরুণ ক্রেতাদের। আর সাইন্সল্যাবের বাইতুল মামুর জামে মসজিদ মার্কেট, প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারে পাঞ্জাবি-পায়জামার দোকান এবং এলিফ্যান্ট রোডের জুতার দোকানগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেছে।
এসব মার্কেটের বিক্রেতারা বলছেন, মানুষের মধ্যে ছিনতাইয়ের একটি আতঙ্ক বিরাজ করছে, যার কারণে অনেকেই দিনের বেলাতে কেনাকাটা করার প্রতি ঝুঁকছেন। এতে করে আবার এই এলাকায় অন্য বছরের মতো মধ্যরাত পর্যন্ত কেনাকাটার পরিবেশে ভাটা পড়েছে। আবার ব্যবসায়ী ও দোকানিরাও কিছুটা আতঙ্কে সময় পার করছেন। সেজন্য, আগের তুলনায় এবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বেশি জোরদার করার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের বিক্রেতা মাহবুবুর রহমান বলেন, অন্য বছর সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ব্যাপক বেচাকেনা হয়েছে। এবার অধিকাংশ ক্রেতারাই দিনের বেলা কেনাকাটা করে ফেরত যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত বেশ ভালোই বিক্রি হচ্ছে। আমরাও ক্রেতার চাহিদা প্রাধান্য দিয়ে দোকানে কাপড় তুলেছি। আশা করছি এবার অন্যবারের তুলনায় ব্যবসা ভালো হবে।
ক্রেতারা বলছেন, বরাবরের মতোই ঈদকে সামনে রেখে কাপড়ের বাড়তি দাম চাইছেন বিক্রেতারা। স্কুলকলেজ রোজার শুরু থেকেই বন্ধ থাকার কারণে অনেকেই আগেভাগে কেনাকাটা করে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন। সেই বিষয়টি বুঝতে পেরে দাম ছাড়তে চাইছেন না বিক্রেতারা।
মুমিনা খাতুন নামের এক ক্রেতা বলেন, যেহেতু বাচ্চার স্কুল বন্ধ সেজন্য শেষ সময়ে ঝামেলা এড়াতে আগেভাগেই গ্রামের বাড়িতে চলে যাব। তাই প্রিয়জনের জন্য কাপড় কেনাকাটা করছি। ব্যবসায়ীরা দাম কিছুটা বেশিই চাচ্ছেন। দামাদামি করে নিতে হচ্ছে। তাছাড়া এবার সবাই রোজা রেখে কষ্ট হলেও দিনের বেলাতেই কেনাকাটা শেষ করতে চাচ্ছেন। সেজন্য ভিড়ও একটু বেশি।
আল-মামুন নামের আরেক ক্রেতা বলেন, প্রতিবছর রোজার ঈদেই সবার জন্য নতুন জামাকাপড় কেনাকাটা করা হয়। শেষ সময়ে ভিড় বেশি থাকে সেজন্য আগেভাগেই কেনাকাটা করছি। একটু বেশি ঘুরতে হচ্ছে, তারপরও পরিবার-পরিজনের খুশির কাছে এই কষ্ট কিছুই না।
অন্যদিকে, নিউমার্কেট থানার আওতাধীন পুরো এলাকাজুড়ে কেনাকাটা করতে আসা মানুষজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহসেন উদ্দীন। তিনি বলেন, ঢাকার অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে নিউমার্কেট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো, আমাদের এখানে অপরাধের পরিমাণ নগণ্য। তারপরও কেনাকাটা করতে আসা মানুষজনের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা আরও সতর্ক হয়েছি। পুরো এলাকাজুড়ে দশটি স্পটে অবজারভেশন ফোর্স কাজ করছে। চারটি পেট্রোল টিম সার্বক্ষণিকভাবে ঘুরেফিরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। একইসঙ্গে মোবাইল-টাকা চুরিসহ ছোটখাটো অপরাধ ঠেকাতে সাদা পোশাকেও পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন।