বিশ্ব শিশু শ্রমবিরোধী দিবস আজ
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৫ ০৯:১১ এএম
ফাইল ছবি
১৩ বছর বয়সেই শ্রম বিক্রিতে নেমেছে মো. আইনাল হোসেন। টাঙ্গাইলের বীরতারা ইউনিয়নের গোপিনপুর গ্রামে তার বাড়ি। রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় গাড়ির যন্ত্রণাংশের একটি দোকানে গত দুই বছর ধরে কাজ করছে। মগবাজার রেড ক্রিসেন্ট রোডের একটি রেস্টুরেন্টে পানি বিতরণের কাজ করছে ১২ বছরের মো. ইয়াকুব। এভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আইনাল, ইয়াকুবের মতো দেশের হাজার হাজার শিশুশ্রম বিক্রি করছে। শিশুশ্রম বন্ধের ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ সরকারের। তৈরি করতে পারেনি অসহায় শিশুদের বেঁচে থাকার অবলম্বন।
ঈদের আগে গত ৪ জুন রাজধানীর বাংলা মোটর-মগবাজার লিংক রোডের ‘লিঙ্কন পার্টস হাউস’ নামে গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রির একটি দোকানে কথা হয় মো. আইনাল হোসেনের সঙ্গে। সে ভোরের আকাশকে জানায়, বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মায়ের হাত ধরে ঢাকায় এসেছি। থাকি খিলগাঁও এলাকায়। তাকে দোকানে দুপুরের খাবার দেয়া হয়। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত থাকতে হয়। মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা পাওয়া যায় বলে জানায় আইনাল হোসেন।
রেস্টুরেন্টের কাজ খুব কষ্টের বলে দীর্ঘশ্বাস টানল ১২ বছরের মো. ইয়াকুব। সে ভোরের আকাশকে জানায়, সকালের নাস্তার ডিউটি করি না। বেলা ১২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা বলে জানায় মো. ইয়াকুব।
রাজধানীর কারওয়ানবাজার কাঠপট্টির পাশে একটি চা দোকানে কাজ করে ১৩ বছরের মো. আসলাম। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার ভরাডোবা ইউনিয়নের খারুয়ালী গ্রামে তার বাড়ি। কারওয়ানবাজার বস্তিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। সে ভোরের আকাশকে জানায়, বাবা রিকশা চালায়, মাছ কুটার কাজ করেন মা। ছোট দুই ভাইবোন রয়েছে। বাবা-মাকে সাহায্য করার পাশাপাশি নিজের পকেট খরচ মেটাতে চা দোকানে কাজ করি বলে জানায় মো. আসলাম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সর্বত্রই শিশু শ্রমের করুণ চিত্র। হাজার হাজার শিশুর স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় শিশুশ্রমে। শিশুকালে তাদের রঙিন স্বপ্ন বোনার কথা। স্বপ্নে আকাশে উড়ে বেড়ানো পাইলট হওয়ার কথা, সেই শিশুর স্বপ্নগুলো ধ্বংস হয় ইটভাটার আগুনে, রেস্টুরেন্টে আসা লোকজনের অমানবিক আচরণ ও অকথ্য বকুনিতে। একমুঠো ভাতের জন্য দিনের পর দিন সকাল-সন্ধ্যা শিশুরা অসহানীয় যন্ত্রণা সহ্য করে থাকে। একবেলা খেতে পারবে সেই আশায়। কখনোবা তাদের শিকার হতে হয় কারখানার মালিকদের অমানবিক নির্যাতনের। দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কম নয়। রাজধানী ঢাকায় শিশুশ্রমের করুণ অবস্থা সবারই জানা। দেশের অন্যান্য স্থানেও আশঙ্কাজনক হারে এ চিত্র বাড়ছে।
বাংলাদেশের আইন অনুসারে ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজ করতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই। বাসাবাড়িতে কাজ করে নিজেকে বাঁচানোর জন্য দুমুঠো ভাতের জন্য গৃহকর্তা-গৃহকত্রীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় মা-পিতৃহারা শিশুরা। মূল্যবান জীবন ইটপোড়া কারখানা থেকে শুরু করে পাথরভাঙা, বাসাবাড়িতে কাজ করা, বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ গাড়ির গ্যারেজ, দোকানে কাজ করে শিশুরা।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ধারায় শিশুদের সুবিধাপ্রাপ্তি বিশেষসংক্রান্ত আইন রয়েছে, যা শ্রম আইন ২০০৬ নামে পরিচিত। এতে কাজে যোগদানের কমপক্ষে বয়স ১৪ বছর আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে ১৮ বছর; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ১৪ বছর হওয়ার আগেই শিশুদের বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকার চিত্র অহরহ। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ শ্রম সংশোধন ২০১৮-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কেউ যদি শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেয় তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কিন্তু বাস্তবে ভিন্ন চিত্র।
শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, শিশুশ্রম নিরসনে সকল মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিশুশ্রম একটি বড় সমস্যা। কৃষক পরিবারের শিশুরা মাঠে কাজ করছে, জেলেরা তাদের সন্তানদের নিয়ে মাছ ধরছে এবং ইটভাটায় শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। এ কারণে অনেক শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এসব শিশু পরিবারের আর্থিক চাপ কমাতে বাধ্য হয়ে কাজে নামছে, যা তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তিনি বলেন, শিশুদের অধিকার, সুরক্ষা ও তাদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিতে জাতীয় শিশু কল্যাণ পরিষদ কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া, উপদেষ্টা সুবিধাবঞ্চিত, পথশিশু, শ্রমজীবী ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাসকারী শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি সকল সংস্থাকে কাজ করার আহ্বান জানান।
উপদেষ্টা বলেন, শিশু শ্রম নিরসনে গঠিত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি এবং উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের কমিটি কাজ করছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও শিশুদের শিক্ষা ও বিকাশের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে শিশু শ্রম একটি জটিল সামাজিক সমস্যা এবং এটি নিরসনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় শিশুশ্রম নিরসন বিষয়ক নানাবিধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। যার মধ্যে রয়েছে পুনর্বাসন, সামাজিক সুরক্ষা ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো (বিবিএস) এর সর্বশেষ জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০২২ এর ফলাফল অনুযায়ী, দেশে শিশুর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এর মধ্যে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন শিশুশ্রমিক। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। তাদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশুশ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। কৃষি, শিল্প ও সেবা, এই তিন খাতেই শিশুশ্রম আছে।
এরমধ্যে কৃষিতে এক লাখ ৭০ হাজার, শিল্পে ১১ লাখ ৯০ হাজার এবং সেবায় ১২ লাখ ৭০ হাজার। সরকার ৪৩টি খাতকে শিশুশ্রমের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়নের অভাব, শিশুশ্রম নিরসনের প্রধান বাধা বলে মনে করেন শিশু বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক দুরবস্থাও শিশুশ্রমের অন্যতম কারণ। গ্রামে কাজের অপ্রতুল সুযোগ, সামাজিক অনিশ্চয়তা, মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাব ইত্যাদি কারণে গ্রাম থেকে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। নদীভাঙন, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে। এ জাতীয় প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনাই শিশুদের কায়িক শ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাবা-মায়ের স্বল্প শিক্ষা, দারিদ্র্য এবং অসচেতনতার কারণে তারা শিক্ষাকে একটি অলাভজনক কর্মকাল মনে করে। এ ছাড়া শিশুশ্রমের কুফল সম্পর্কে অভিভাবকদের অসচেতনতা বা উদাসীনতায় দেশে শিশুশ্রম বাড়ছে।
এ বিষয়ে শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত স্ট্রিট চিলড্রেন অ্যাক্টিভিস্টস নেটওয়ার্ক (স্ক্যান) বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মুকুল। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, শিশু শ্রমিকদের আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার শিশুশ্রম বন্ধে গত ১২ বছরে ৩৫২ কোটি টাকা ব্যয় করলেও শিশুশ্রম বন্ধ কমেনি, বরং বেড়েছে। এক দশকে দেশে প্রায় এক লাখ শিশুশ্রমিক বেড়েছে।
তিনি আরো বলেন, দারিদ্র্যতা, অশিক্ষা, অসচেতনতা, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা শিশুদের শ্রমের ঠেলে দিচ্ছে। আবার শিশুদের সস্তা শ্রমের জন্য কিছু অসাধু ব্যক্তি নানা রকম প্রলোভনে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে টেনে আনে। আইন ও নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়নে এটা বন্ধ করা সম্ভব।
দীর্ঘ বছর শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করছে উন্নয়ন সংস্থা ‘অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি)’। তাদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত সুপারিশে বলা হয়েছে, পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ ও নিকৃষ্ট ধরনের শ্রমসহ সকল ধরনের শ্রম থেকে শিশুদের প্রত্যাহার করতে হবে। এ জন্য শিশুশ্রম নিরসনে আইন সংস্কার ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো শিশুকে ১৪ বছর বয়সের আগে কোনো ধরনের শ্রমে নিয়োজিত করা যাবে না। এখনো ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সি প্রায় ১৮ লক্ষ শিশুশ্রমে নিয়োজিত। ওই সকল শিশুদের শ্রম থেকে প্রত্যাহারের লক্ষ্যে তাদের পিতামাতার জন্য আয় বৃদ্ধিমূলক কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, কাজের তালিকা, মজুরি নির্ধারিত থাকতে হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ