করোনা প্রতিরোধ
ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৫ ১০:৩৪ এএম
ফাইল ছবি
ভারতসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশে করোনাভাইরাসের নতুন সাব-ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সতর্কতা জারি করেছে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু করোনা প্রতিরোধ-সংক্রান্ত তৎপরতা প্রায় নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে করোনার তথ্য সংগ্রহ-সংক্রান্ত কাজও ঢিমেতালে চলছে। রাজধানীর কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল ছাড়া দেশের কোথাও করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ ও শনাক্তের ব্যবস্থা নেই। রয়েছে কীটের তীব্র সংকট। নমুনা পরীক্ষার সুব্যবস্থা থাকলে দেশে করোনা রোগী শনাক্তের হার অনেকগুণ বেশি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আইসিডিডিআরবির গবেষকেরা করোনার নতুন একটি ধরন শনাক্তের কথা বলছেন। এর নাম এক্সএফজি। এর পাশাপাশি এক্সএফসি ধরনটিও পাওয়া গেছে। দুটোই করোনার শক্তিশালী ধরন অমিক্রনের জেএন-১ ভ্যারিয়েন্টের উপধরন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ৯ জুন দেশে করোনা ভাইরাসের ৪১টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শনাক্তের হার ১২ দশমিক ১৯। গত ৮ জুন ৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩ জন শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ছিল ৭৫। স্বাস্থ্য বাতায়নের ১৬২৬৩ নম্বরে করোনাবিষয়ক কলের সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়েছে। এ নম্বরে ফোন করে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত যেকোনো পরামর্শ পাওয়া যায়।
গত বৃহস্পতিবার দেশে করোনায় একজনের মৃত্যু হয়। আশঙ্কাজনক না হলেও দেশে এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে। আর সেই সঙ্গে ১৬২৬৩ নম্বরে কলও বাড়ছে। গত ৯ জুন এ সংক্রান্ত কল ছিল ১১ হাজার ১০৬টি। স্বাস্থ্য বাতায়নের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘করোনায় মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই আমরা এসংক্রান্ত কল বেশি করে পাচ্ছি। যেটা আগে ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও করোনা বৃদ্ধির কথা বলছে।’
রাজধানীর তিনটি সরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে করোনা পরীক্ষার কিট পাওয়া যায়নি। এ পরিস্থিতিতে করোনার সম্ভাব্য বিস্তার বন্ধে এর পরীক্ষার সরঞ্জাম সংখ্যা বাড়ানো এবং আবার টিকা দেওয়া শুরুর কথা বলছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। তারা বলছেন, যারা বয়স্ক, অন্তঃসত্ত্বা, ভিন্ন কোনো জটিল রোগে ভুগছেন তাদের জন্য তো বটেই, এমনকি যেসব ব্যক্তির সর্বশেষ টিকা নেওয়ার মেয়াদ ছয় মাস পার হয়ে গেছে, তাদেরও করোনার টিকা নেওয়া উচিত।
তবে রাজধানীর তিনটি সরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে করোনা পরীক্ষার কিট পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সূত্র জানাচ্ছে, এখন তাদের হাতে ৩১ লাখ টিকা মজুত আছে। এর মধ্যে ১৭ লাখের মেয়াদ আগামী আগস্ট মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। করোনার টিকা আবার নতুন করে শুরু করার বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারণী স্তরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গত ২৩ মে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, এনবি.১.৮.১ ধরন এখন ক্রমেই ছড়াচ্ছে। এর সংক্রমণের হারও বেশি। তবে করোনার আগের ধরনগুলোর চেয়ে এই ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি নয়। ভারতে ছড়িয়ে পড়া এই ধরন বাংলাদেশে যে আসবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং ঝুঁকি আছে যথেষ্ট, এমনটাই মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। তার কথা, এ জন্য করোনা প্রতিরোধে প্রস্তুতি দরকার। কিন্তু এখনো এ নিয়ে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
কিট সংকট, টিকা অপর্যাপ্ত
করোনার সংক্রমণ রোধে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা কিটের মজুতের কথা বলছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বড় এই তিন হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার কোনো কিট নেই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখনো রোগী আসছে না। কিন্তু রোগী এলেও পরীক্ষার তো ব্যবস্থা নেই। হয়তো এটা জেনেই এখানে কেউ আসে না। করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকার মুখে গত ২২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক সভায় উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে করোনার টিকা দেওয়ার কথা বলে। সেই চিঠি সরকারের নানা পর্যায়ে পাঠানো হয়।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) প্রোগ্রাম ম্যানেজার এ এফ এম শাহাবুদ্দিন খান জানান, তাদের হাতে এখন ৩১ লাখ ফাইজারের তৈরি করোনার টিকা আছে। এর মধ্যে গত দুই মাসে ১৭ লাখ ১৬ হাজার ৯০০ ডোজ ফাইজারের টিকা সব জেলায় পাঠানো হয়েছে, যার মেয়াদ শেষ হবে ৬ আগস্ট। এখন হাতে আছে আসলে ১৪ লাখ টিকা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, শুধু ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী নয়, আসলে যাদের করোনার টিকা নেওয়ার মেয়াদ ছয় মাস পার হয়ে গেছে, তাদেরও টিকা নিতে হবে। আর সেই উদ্যোগ যদি নিতে হয় তবে এখন যে টিকা আছে, তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়। সরকার ইচ্ছে করলে এ নিয়ে ডব্লিউএইচও বা অন্য দাতাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে। তবে টিকা কেনা শুধু নয়, টিকা নিতে উৎসাহিত করতে যে প্রচারের দরকার, তার জন্যও প্রয়োজনীয় অর্থ হাতে নেই বলে জানান এ এফ এম শাহাবুদ্দিন খান। তিনি এ জন্য গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
করোনা-সংক্রান্ত প্রস্তুতি এখনো তেমন দেখা যাচ্ছে না। করোনার পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে বার্তা দেয়, তাতে অসংগতি যথেষ্ট। যেমন ১ ও ২ জুন একই বিজ্ঞপ্তি তুলে ধরা হয়েছে। অধিদপ্তরের যে ডেস্ক থেকে তথ্য ঠিকঠাক করা হতো, সেখানেও লোক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অধিদপ্তরের সূত্র জানিয়েছে।
করোনার কিটের অপর্যাপ্ততার বিষয়টি স্বীকার করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু জাফর। তিনি বলেন, ‘কিটের সংকট আছে। সেগুলো মেটানোর চেষ্টা আমরা করছি। দেশের কিছু স্থানে করোনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। তবে বিষয়টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেই।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সতর্কবার্তা
ভারতসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশে করোনাভাইরাসের নতুন সাব-ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সতর্কতা জারি করেছে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশিদের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অমিক্রনের নতুন সাব-ভেরিয়েন্ট যেমন এলএফ.৭, এক্সএফজি, জেএন-১ ও এনবি ১.৮.১ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে এই ভেরিয়েন্টগুলোর সংক্রমণ ঠেকাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ করে ভারত ও অন্যান্য সংক্রামক দেশ থেকে বাংলাদেশে আগত এবং বাংলাদেশ থেকে ওইসব দেশে ভ্রমণরত যাত্রীদের ক্ষেত্রে দেশের সকল স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধি ডেস্কে নজরদারি জোরদার করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে।
দেশে প্রবেশের পথের জন্য নির্দেশনাসমূহের মধ্যে রয়েছে- দেশের বিভিন্ন স্থল/নৌ/ বিমানবন্দরগুলোতে আইএইচআর স্বাস্থ্য ডেস্কসমূহে সতর্ক থাকা, হেলথ স্ক্রিনিং এবং সার্ভেইল্যান্স জোরদার করুন। দেশের পয়েন্টস অব এন্ট্রিসমূহে থার্মাল স্কান্যার/ডিজিটাল হেন্ড হেল্ড থার্মোমিটারের মাধ্যমে নন টাচ টেকনিকে তাপমাত্রা নির্ণয় করুন। চিকিৎসাকাজে স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মাস্ক, গ্লাভস এবং রোগ প্রতিরোধী পোশাক মজুত রাখুন (পিপিই)।
ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য রোগ প্রতিরোধ নির্দেশনাগুলো প্রচার করুন। জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত ভারত ও অন্যান্য আক্রান্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকুন। সবার জন্য সাধারণ পরামর্শসমূহের মধ্যে রয়েছে- সাতবার প্রয়োজনমতো সাবান দিয়ে হাত ধোবেন (অন্তত ২৩ সেকেন্ড)। নাক-মুখ ঢাকায় জন্য মাস্ক ব্যবহার করুন। আক্রান্ত ব্যক্তি হতে কমপক্ষে ৩ ফুট দূরে থাকতে হবে। অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করবেন না। হাঁচি-কাশির সময় বাহু/টিস্যু/ কাপড় দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখুন।
সন্দেহজনক রোগীদের ক্ষেত্রে করণীয়: অসুস্থ হলে ঘরে থাকুন, মারাত্মক অসুস্থ হলে নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করুন। রোগীর নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে বলুন। প্রয়োজন হলে আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করুন (০১৪০১-১৯৬২৯৩)।
ভোরের আকাশ/এসএইচ