ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৫ ১২:৪৮ পিএম
ফাইল ছবি
অব্যাহত রয়েছে করোনা ভাইরাসের নীরব সংক্রমণ। ডেঙ্গু আতঙ্কে দেশবাসী। বেশকিছু উপসর্গের মিল থাকায় এই দুই রোগ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনা মানুষের রক্তে যে সমস্যা তৈরি করে, তেমনি রক্তে একই রকম সমস্যা তৈরি করে ডেঙ্গু। আর ডেঙ্গু ও করোনার প্রাথমিক উপসর্গে থাকে জ্বর। একই ব্যক্তি করোনা ও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হলে ওই রোগীর মৃত্যুঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ অ্যান্ড ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। এ সময়ে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০৮ জন। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ভর্তি হয়েছেন ১০৮ জনের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১১ জন। আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৯৭ জন।
বিজ্ঞপ্তি থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, চলতি বছর আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৫ হাজার ৪১১ জন। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ নারী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সরকারি পরিসংখ্যানের দ্বিগুণ হবে বেসরকারি চিত্র। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ‘ ডেঙ্গু তথ্য’ প্রেরণ করে না। আর উপসর্গ থাকার পরও পরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবা গ্রহণে উদাসীন অনেক রোগী। ফলে ডেঙ্গু পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে না।
করোনা পরিস্থিতি: দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ কর্মসূচি অনেকটা সংকুচিত হয়ে গেছে। রাজধানীর কিছু সংখ্যক হাসপাতাল ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি উপসর্গ থাকার পরও রোগীরাও নমুনা পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে উদাসীন। ফলে করোনা ভাইরাস নিয়ে সরকার ও সাধারণ মানুষ এখন ভাবে না বললেই চলে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
এদিকে, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের(আইইডিসিআর) সাবেক উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, যতদিন সংক্রমণ থাকবে ততদিন করোনা নিয়ে অবহেলা করা যাবে না। করোনা ভাইরাস শনাক্তরণ ও হাসপাতালে যাওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেশের করোনা পরিস্থিতিতে ভুমিকা রাখবে। নীরবে করোনার সংক্রমণ ঘটছে। টেস্ট করাতে না যাওয়ার কারণে শনাক্তের বাইরে রয়ে যাচ্ছে অনেক করোনা রোগী। করোনার সংক্রমণ সর্বত্র বিস্তার ঘটতে খুব বেশি সময় লাগে না। একসঙ্গে ডেঙ্গু, করোনা ও মৌসুমী জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সকলকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. মুস্তাক হোসেন।
করোনা ও ডেঙ্গু: বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, ডেঙ্গু ও করোনা দুটিতেই আক্রান্ত হওয়ার রোগী পাওয়া যাচ্ছে। জ্বর হলেই প্রথমে করোনা ও পরে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে উদাসীনতা ও ঘামখেয়ালিপনা করলে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, করোনা ও ডেঙ্গু- এ দুটির উপসর্গ প্রায় একই। তবে কিছু কিছু পার্থক্য আছে। করোনার উপসর্গ হলো জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, শরীরে ব্যথা ও ঘ্রাণ না পাওয়া। আর ডেঙ্গুর লক্ষণ হলো, ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি শরীর কাপানো জ্বর, চোখের পাতার পেছনে ব্যথা ও ব্যাপক পেইন এবং গিড়ায় গিড়ায় ব্যথা। শরীরে র্যাশও উঠতে পারে। কোনো কোনো ডেঙ্গু রোগী আক্রান্ত হওয়ার চার দিন পর প্লাটিলেট কমে গিয়ে নাক, দাঁত, পায়খানা ও বমির মাধ্যমে রক্তক্ষরণ হতে পারে। করোনা রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ওষুধ চিকিৎসা সেবায় প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু ডেঙ্গু রোগীর শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে হবে, এসপিরিন জাতীয় ওষুধসহ কোনো ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যাবে না। তবে সেকেন্ডারি ইনফেকশন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হতে পারে। এছাড়া ডেঙ্গু রোগীর বেশি করে ওরস্যালাইন, ডাব ও অতিরিক্ত পানি খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আরো বলেন, এডিস মশার কারণে ডেঙ্গুজ্বর হয়। এডিস মশা দিনে কামড়ায়। গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, ডেঙ্গু ও করোনার উপসর্গ প্রায় একই। তবে কিছু পার্থক্য আছে। দুটির ক্ষেত্রেই জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি, কাশি এবং স্বাদ না থাকা হতে পারে। করোনার ক্ষেত্রে এসব লক্ষণের সঙ্গে নাকে ঘ্রাণ পায় না এবং কারো কারো পাতলা পায়খানা হয়।
এছাড়া করোনার ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা হতে পারে, যেটি ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে হয় না। ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে চার-পাঁচ দিন পরে শরীরে লাল অ্যালার্জির মতো র্যাশ হতে পারে। তখন রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা কমে যেতে পারে। তিনি বলেন, একজন রোগীর ডেঙ্গু ও করোনা এক সঙ্গে হচ্ছে। তাই জ্বর হলেই করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। নিজের জীবন রক্ষার স্বার্থে দুটি পরীক্ষা করাতে হবে।
ভাইরোলজিস্ট ডা. নজরুল ইসলাম বলছেন, যদি একইসঙ্গে ডেঙ্গুর কারণে রক্তে প্লাটিলেট স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি কমে যায় এবং কোভিডের কারণে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রাও ৯০ এর নিচে নেমে যায়, তাহলে বিষয়টি বিপজ্জনক। তখন একইসঙ্গে প্লাটিলেট দিতে হবে, অক্সিজেন দিতে হবে। চিকিৎসকরা এর সিদ্ধান্ত নেবেন। আবার করোনার কারণে যদি ফুসফুস বেশি আক্রান্ত হয়, হৃদযন্ত্রের আর্টারি আক্রান্ত হয়, তখন খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। এমন রোগীদের ফেরানো মুশকিল।
ভোরের আকাশ/এসএইচ