‘ভূ-রাজনীতি’র খেলার শিকার বাংলাদেশ
মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০১:৫৯ এএম
ছবি: সংগৃহীত
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার আদেশে দেশটির রাখাইন প্রদেশে ২০১৭ সাল থেকে হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন-লুটপাটের শিকার ও বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লাখ মানুষ এখন বাংলাদেশের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আট বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করলেও তাদের নিজ বাসভূমে প্রত্যাবসন এখনও অনিশ্চিত। ফলে বাংলাদেশকে আর্থিক, সামজিক, পরিবেশ, নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে, মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী চাতুরতা, গৃহযুদ্ধ এবং ‘আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলো’র খেলার বলী হয়ে গেছে ভাগ্যবিড়ম্বিত, দেশহারা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষ। আর এর বিষফল ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
একদিকে, তারা একদিকে রোহিঙ্গাজনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশভুমের ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আর এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে মানবিক দৃষ্টিতে নিজদেশে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশও দীর্ঘদিন ধরে নানান জটিল সমস্যার মুখে নিপতিত। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে-রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষ এবং তাদের আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তিন পরাশক্তি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন এবং আঞ্চলিক শক্তি ভারতের ‘ভূ-রাজনীতি’র খেলার শিকারে পরিণত হয়েছে। আর বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের তাদের নিজদেশে প্রত্যাবসনের নানান প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও বিষয়টি এখনও সমাধানের পথ পায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সমন্বিত উদ্যোগ ও আন্তরিকতা বেশি জরুরি। আর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এককভাবে এ সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব। বিষয়টি নিয়ে ভারতসহ পরাশক্তিগুলোর ‘ভূ-রাজনীতি’র খেলা ছাড়াও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যসহ দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের বিষয়ে জটিলতা দিন দিন আরো বাড়ছে।
এর পেছনে ‘ভূ-রাজনৈতিক’ জটিলতার পাশাপাশি নিজেদের স্বার্থে মিয়ানমারের প্রতি দুই বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ-ভারত ও চীনের রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত পক্ষপাতও। আমেরিকা-ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমা বিশ্ব যখন মিয়ানমারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখন চীন তাকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়ায়। ভারতও তাদের নিজেদের স্বার্থে এ সংকট নিরসনে বাংলাদেশকে প্রত্যাশিত সহায়তা করেনি। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতীয় ঐকমত্যও অপরিহার্য।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান জরুরি বলেও মনে করেন তারা। তাদের মতে, রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ায় বাংলাদেশের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা হচ্ছে, দিন দিন আন্তঃসীমান্ত নিরাপত্তা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটছে। রাখাইনের গৃহযুদ্ধে আরাকান আর্মির পক্ষে কুকি চীন আর্মি সদস্যদের অংশগ্রহণ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান, খাগরাছড়ি এলাকার জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকিও সৃষ্টি করেছে। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টির আশু সুরাহা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর তাদের নিজদেশে প্রত্যাবসন প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম ‘ভোরের আকাশ’কে বলেন, রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে প্রত্যাবসনের বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তরিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মানবিক কারণে বাংলাদেশে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়া হলেও বিষয়টি এখন বাংলাদেশের জন্য ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে ফারুক-ই আজম বলেন, বিষয়টির স্থায়ী সমাধানে এবং মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন তরান্বিত করতে জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে ‘সাইড লাইন’ বৈঠকে উঠবে। এ বিষয়ে ট্রিপল আরসি সংশ্লিষ্ট সকল স্টেক-হোল্ডাররা অংশ নেবে।
কাতার ও নেদারল্যান্ডস এ বিষয়ে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের দেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য মাথাপিছু ১২ ডলারের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সাহায্যগোষ্ঠী ৬ ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব করছে, ফলে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করাও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন।
উপদেষ্টা বলেন, বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরাশক্তি ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলো নানা খেলায় মত্ত হয়ে পড়েছে, ফলে বিষয়টি সমাধানযোগ্য হলেও তা অত্যন্ত জটিল অবস্থায় পড়েছে।
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা তাদের নিজদেশে ফেরত যেতে খুবই আন্তরিক ও উদগ্রীব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের সময় তাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি অনুভব করেছি। মিয়ানমারে রেহিঙ্গাদের প্রত্যাবসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইতিপুর্বে বিভিন্ন প্রস্তাব দেওয়া হলেও মিয়ানমার এ সংক্রান্ত প্রস্তাব মানেনি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনে দেশটির চলমান গৃহযুদ্ধও অন্যতম বাধা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, বিষয়টি বেশ জটিল অবস্থায় রয়েছে, সেখানে যুদ্ধরত আরাকান আর্মি, বার্মিজ (মিয়ানমার) সেনাবাহিনী ও দেশটির সরকার-কোন পক্ষই রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। এসব বাধা মোকাবেলা করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্দ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার রেহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, গত মাসে আমরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানকল্পে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা, এনজিও এবং বিভিন্ন স্টেক হেল্ডোরদের নিয়ে মিটিং করেছি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস এ বেঠকে অংশ নিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা হচ্ছে-রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা। এজন্য আমরা ‘বিশ্ব জনমত’ গড়ে তোলার সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এক প্রশ্নের জবাবে ফারুক ই আজম বলেন. আশা করি রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবসন সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদের আট বছর ইতোমধ্যে পার হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল, লেবানন-ইসরায়েল, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধসহ সাম্প্রতিক ইরান-ইসরাইল এবং মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধসহ বৈশ্বিক অন্যান্য সংঘাতের ডামাডোলের পাশাপাশি বাংলাদেশে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসন ইস্যু অনেকটাই ঝিমিয়ে গেছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর একদিকে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে কক্সবাজারসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামাজিক পরিবেশ ও প্রতিবেশও এতে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্নস্থানে। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার এ সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত তৎপর রয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা প্রত্যাবসন সমস্যাকে ‘টাইম বোমা’ বলে ইতিপুর্বে আখ্যা দিয়েছেন এবং এ সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের মহাসচিবকে এ সমাধানে এ কাজে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস গত রমজান মাসে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে তাদের নিজদেশে প্রত্যাবসনে উদ্যোগও নিয়েছেন। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস এ সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতকিছুর পরেও রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভুমিতে ফেরার বিষয়টি এখনও অনিশ্চিতই রয়ে গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ২০১৭ সালে বিতাড়িত রেহিঙ্গাদের তাদের নিজদেশে প্রত্যাবসনে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতের অসম্মতি ও অসহযোগিতার কারণে বিষয়টি এগোতে পারেনি। আর তখন ভারতনির্ভর আওয়ামী লীগ সরকারও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিকভাবে এ বিষয়টি নিয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেয়নি।
বর্তমানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিভাবে গ্রহণযোগ্য সরকার ক্ষমতায় থাকায় দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা এ বিষয়টি সমাধানের দিকে নেওয়া সম্ভব। আর রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল ভাগ্যবিড়ম্বিত মুসলিম এই জনগোষ্ঠীর অনিশ্চিত, অনিরাপদ, আশাহীন জীবনের অবসান ঘটানোর পাশাপাশি তা বাংলাদেশের জন্য এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও গুরুত্বপুর্ণ এবং বাস্তবসন্মত পদক্ষেপ হতে পারে।
রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারে ‘নিরাপদ অঞ্চল’র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলে তা রোহিঙ্গাদের জন্য যথাযথ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ও মানবিক সাহায্য নিশ্চিত করা, তাদের বাড়িঘর এবং জমি ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপুর্ণ হবে। তবে বিষয়টি অসামরিক উপায়ে করতে হবে। যাতে নিজদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সহিংসতা ও নিপীড়ন-নির্যাতন মুক্ত থাকে এবং তাদের নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি জাতিসংঘের অধীনে রোহিঙ্গাদের নিজদেশে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দিতে হবে মিয়ানমারকে।
উপরন্ত, সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ এবং তাদের জীবনযাপন ও অর্থনেতিক কর্মকান্ডকে নিশ্চিত করতে জাতিসংঘকে অগ্রণী ভুমিকা নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘নিরাপদ অঞ্চল’ দেশটিতে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা এবং জান-মালের নিরাপত্তায় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হতে পারে। তবে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বাংলাদেশের একক নিয়ন্ত্রণের বিষয় নয়-এটাই বাস্তবতা। এজন্য আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এ বিষয়ে মিয়ানমারকে রাজি করানো সম্ভব। এজন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরালো কুটনৈতিক পদক্ষেপ জরুরি, যা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষে সম্ভব বলেও মনে করেন তারা।
পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিগত সরকারের চুক্তি অকার্যকর ছিল। এ সমস্যার নিরসনে একটা দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপ সইতে হচ্ছে। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এই সমস্যা একা সমাধান করতে পারবে না। এখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যথাযথভাবে সহযোগিতা করতে হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মূল সহায়ক শক্তি হতে পারে চীন, মিয়ানমার, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমারকে এসব বিষয়ে রাজি করাতে দেশটির ওপর সবচেয়ে প্রভাব বজায় রাখা ‘চীন’কে বাণিজ্যিক ইস্যুতে কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের রয়েছে বড়ধরনের বাণিজ্যিক লেনদেনের সম্পর্ক। তবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের যে রাখাইন প্রদেশ থেকে উৎখাত করা হয়েছে, সেই রাখাইনেই আছে চীনের বিশাল ‘অর্থনৈতিক কর্মসূচি’।
সেখানে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে এবং স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করেছে, যাতে তারা সহজেই নিজদেশ থেকে স্থলপথে বঙ্গোপসাগরে যেতে পারে। আর এই অবস্থায় ভারতও পিছিয়ে নেই। তাদেও সেভেন সিষ্টার্স রাজ্যগুলোর আমদানি রপ্তানির জন্য ‘কালাডান প্রজেক্ট’ চলমান। মিয়ানমারে বিনিয়োগও বাড়িয়েছে দেশটি।
এছাড়া আছে আমেরিকার ‘বার্মিজ আ্যাক্ট’। সবমিলিয়ে এজন্য এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-পশ্চিমা বিশ্ব তথা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে স্বীকৃতি আদায়ের ব্যবস্থা তরান্বিত করা। তবে এক্ষেত্রে বড় বাধা বাংলাদেশের ‘দুর্বল কূটনীতি’। যথাযথ কুটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিষয়টি জাতিসংঘে প্রস্তাব আকারে তুলে এবং তা পাস করানোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে।
আর জটিল এ বিষয়টি সমাধানে মিয়ানমারের রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এবং দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধ, আঞ্চলিক ভূ-কৌশলগত জটিলতা, নিরাপত্তাজনিত প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি দেশটির সরকারের বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ঢুকতে না দেওয়ার মানষিকতা থেকে মুক্ত করতে ব্যাপক ‘আন্তর্জাতিক চাপ’ এবং কুটনৈতিক জোরালো উদ্যোগ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিজ দেশের স্বার্থে ‘মেরদন্ড’ সোজা করে জোরালো কুটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরাশক্তির পাশাপাশি আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের শিলিগুড়ি করিডর (চিকেন নেক) ইস্যুকেও কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সাল থেকে এ যাবত মিয়ানমার থেকে পর্যায়ক্রমে প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গা নারীপুরুষ ও শিশু তাদের জন্মভূমি মিয়ানমার থেকে দেশটির সেনাবাহিনী-আধাসামরিক বাহিনী এবং পুলিশের দ্বারা হত্যা-নির্যাতন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের মুখে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছিল।
তবে এ ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিকতা দেখিয়ে ‘নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আশা’ বাংলাদেশকে এ সমস্যায় ফেলতে অনেক বড় ভুমিকা রেখেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ২০১৭ সালের আগে থেকেই আরও কয়েক লাখ বিতাড়িত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল।
আর ২০১৭ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত একজন বিতাড়িত রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এলাকায় ইতোমধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মাদক ও অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা চলছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ঘিরে মিয়ানমারের কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে।
তবে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে-রোহিঙ্গারা তাদের নিজ জনমভুমিতে শত শত বছর ধরে বাস করে আসলেও, সেই দেশটি এখন তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করছে না। তারা রোহিঙ্গাদের ‘আদার পিপল’ বা ‘বেঙ্গলি মুসলিম’ হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকে। অথচ দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামেও রেহিঙ্গাদের রয়েছে বিশাল অবদান।
১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সেনাশাসন শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো রোহিঙ্গারাও নাগরিক হিসেবে দেশটিতে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। অথচ কালের পরিক্রমায় রোহিঙ্গারা এখন নিজ দেশেই পরবাসী এবং বিতাড়িত।
ভোরের আকাশ/এসএইচ