জুলাই সনদ
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:২৪ এএম
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশন। কিন্তু কমিশনের প্রস্তাবিত স্পর্শকাতর কিছু সুপারিশের সঙ্গে অনৈক্য রয়ে গেছে বিএনপির। আগের মতই বিএনপির বিপরীত অবস্থানে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আর সনদ বাস্তবায়নে এই তিন দল তিন ধরনের পদ্ধতির কথা বলেছে। গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত সুপারিশসমূহের মধ্যে রয়েছে- গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন।
প্রস্তাবে বলা হয়, জুলাই সনদের সংবিধানের বিষয়গুলো বাস্তবায়নে দলগুলো বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়। সেগুলোর মধ্যে- পূর্ণাঙ্গ সনদ বা তার কিছু অংশ নিয়ে গণভোট অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতার বলে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে বাস্তবায়ন করা। নির্বাচনের মধ্যে একটি গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা করা। ত্রয়োদশ সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এই সনদ বাস্তবায়ন। সংসদকে সংবিধান সংস্কার সভারূপে প্রতিষ্ঠিত করে সনদের বিষয়গুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে এই মর্মে মতামত চাওয়া যে, অন্তর্বর্তী সরকার এই সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা।
দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে ঐকমত্য কমিশন। বিশেষজ্ঞ প্যানেল একাধিক বৈঠকে বিভিন্ন ধরনের বিকল্প বিবেচনা করে প্রাথমিক পর্যায়ে পাঁচ পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের জন্যে সুপারিশ করে; এগুলো হচ্ছে অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ এবং ১০৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়া। পরবর্তীতে আরও বিস্তারিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই জাতীয় সনদ ২০১৫-এ অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিষয়সমূহকে (যার মধ্যে ভিন্নমত/ নোট অব ডিসেন্ট আছে) সেগুলো চারভাবে বাস্তবায়নের জন্যে পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো- অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট এবং বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ।
কমিশন কিছু চাপিয়ে দেবে না : আলী রীয়াজ
দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্ক শেষে রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক ১৯টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছানোর কথা বলেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে ১০টিতে বিভিন্ন দলের কাছ থেকে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) এসেছে। বাকি নয়টিতে ‘শতভাগ ঐকমত্য’ রয়েছে। আবার সংবিধানসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারির সুপারিশ করে রেখেছে ঐকমত্য কমিশন। আর সংবিধান-সম্পর্কিত নয়, এমন প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে। সব কিছু মিলিয়ে সর্বদলীয় সম্মতিতে সনদ চূড়ান্তের বিষয়টি এখনও অনিশ্চয়তায় ভরা। কিন্তু জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোকে সই করার জন্য কমিশন কিছু চাপিয়ে দেবে না বলে জানিয়েছেন বলছেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে এ কথা বলেন আলী রীয়াজ। ২৯টি রাজনৈতিক দল এদিন আলোচনায় অংশ নেয়।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর তারা জোর করে কিছু চাপিয়ে দেবেন না। সনদ বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা কমিশনের কাছে নেই। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন সরকারকে জানাতে পারে।’
ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, ‘সর্বশেষ আলোচনায় নোট অফ ডিসেন্টসহ কিছু কিছু জায়গায় আমরা একমাত্র হতে পেরেছিলাম। তার একটি খসড়া আমরা আপনাদের দিয়েছিলাম, আপনারা মতামত দিয়েছেন। অঙ্গীকারনামার বিষয়ে বেশকিছু আলোচনা হয়েছে। আশা করছি, চূড়ান্ত খসড়া বিকাল নাগাদ পৌঁছে দেওয়া যাবে।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল করে আমরা একাধিকবার আলোচনা করেছি। এই প্যানেলে দুইজন সাবেক বিচারপতি, তিনজন আইনজীবী, একজন আইনের শিক্ষক ছিলেন। প্যানেলে আলোচনার এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে যোগ দিতে বলেছিলাম, তিনি যোগ দিয়েছিলেন। আইন উপদেষ্টা একটা বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞ প্যানেল ও রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে বুঝতে পেরেছি, জুলাই সনদের কিছু কিছু বিষয় অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবের নিয়ে আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাচ্ছি না। জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেব না। আমরা চাচ্ছি বিশেষজ্ঞ প্যানেল এবং দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সরকারকের কাছে সুপারিশ করতে।’
এর আগে দ্বিতীয় দফার বৈঠক শেষে ঐকমত্য কশিনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল কমিশন ওই দফার আলোচান শেষেই জুলাই সনদে স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া শেষ করবে। তবে তা হয়নি।সবশেষ জুলাই সনদের চূড়ান্ত সমন্বিত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে মতামতের জন্য ২২ অগাস্ট পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। এরপরই এ নিয়ে আবার দলগুলোর ভিন্ন মতের খবর আসে।
প্রধান তিন দলের ভিন্নমত
সনদ বাস্তবায়নে বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিÑ এই তিন দল তিন ধরনের পদ্ধতির কথা বলেছে। সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো আগামী জাতীয় সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের পক্ষে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির প্রক্লেমেশন (রাষ্ট্রপতির ঘোষণা) বা গণভোটের মাধ্যমে এবং এনসিপি গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন চেয়েছে। এর বাইরে অন্তত ১০টি দল সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয়।
অন্যদিকে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন মনে করে, সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারির সুপারিশ করা হবে। এটি সনদ বাস্তবায়নের সবচেয়ে ভালো বিকল্প। আর সংবিধান-সম্পর্কিত নয়, এমন প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে। তবে আজকের আলোচনায় কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো সুপারিশ রাখা হবে না বলে জানা গেছে।
বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ চায় জামায়াত
বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতা ও আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মনির এ দাবি জানান। অন্যদিকে দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জুলাই সনদের ভিত্তিতেই হতে হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গতকাল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের মধ্যাহ্নে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন দলটির নেতারা।
ডা. তাহের বলেন, জুলাই সনদ কোন পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখনও চলমান। আশা করি একটি যৌক্তিক সমাধান বের হবে।
অপরদিকে অ্যাডভোকেট শিশির মোহাম্মদ মনির বলেন, আমরা মনে করি জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে গত বছরের ৫ আগস্ট। তাই একটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে এর বাস্তবায়নের তারিখ দেখাতে হবে ৫ আগস্ট থেকে।
ব্রিফিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ। ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে যায়নি সিপিবি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নেয়নি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। সিপিবির পক্ষ থেকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে লিখিত মতামত পাঠানো হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ শুরু হয়। সংলাপে অনুপস্থিতির বিষয় সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স লিখিতভাবে জানিয়েছেন, সনদ বাস্তবায়নে আমাদের সুনির্দিষ্ট মতামত একাধিকবার আলোচনায় ও লিখিতভাবে জানিয়েছি। যেসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার জন্য সংবিধান সংশোধন দরকার সেগুলো আগামী নির্বাচিত জাতীয় সংসদের জন্য রেখে দেওয়া দরকার হলে মনে করি।
সনদ বাস্তবায়ন না করে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না : সালাহউদ্দিন
‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন না করে কোনো রাজনৈতিক দল ভবিষ্যতে রাজনীতি করতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। গতকাল এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছেন, বিএনপি ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন করবে না বলে যে সন্দেহ অনেকের মনে রয়েছে, তাও অমূলক।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ ধরে তিনি বলেন, “আমি সংস্কার প্রস্তাব দেখেছিলাম ৮২৬টা তার মধ্যে মাত্র ৫১টা বাদে বাকি সব সংস্কার প্রস্তাব আমরা একমত হয়েছি, ১১৫টা সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে আমরা ভিন্নমত অথবা মন্তব্যসহ একমত হয়েছি। এর বাইরে হচ্ছে, ১৯টা সংবিধান সংক্রান্ত মৌলিক সংস্কার হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
‘কেউ না চাইলেও এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতেই হবে আমাদের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট হিসেবে, কারণ আমরা এই ৩১ দফার সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছি এটা আমাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটা নতুন গণতান্ত্রিক শক্তিশালী বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণ করাই আমাদের প্রতিশ্রুতি।’
ভোরের আকাশ/এসএইচ