ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৫ ০৬:২২ পিএম
সংগৃহীত ছবি
সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ঘরে-বাইরে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে দেশের মানুষ। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। এমন সব ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটলেও পরিস্থিতির শিকার ব্যক্তি বা পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না কেউ। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ঘটনাস্থলে দেখা মিলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। বিভিন্নভাবে অভিযান চালিয়েও সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। দেশের অন্য সব এলাকার তুলনায় রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি আরও উদ্বেগের। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারের গত ছয় মাসের প্রতিবেদনে ঢাকার এমন অপরাধমূলক চিত্রই প্রকাশ পেয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- গত ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ঢাকা মহানগরের ৫০ থানায় ৩৩টি ডাকাতি, ২৪৮টি ছিনতাই, ১২১টি খুন এবং ১ হাজার ৬৮টি চুরির মামলা হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ২০টির বেশি খুন, পাঁচটি ডাকাতি ও ৪১টি ছিনতাই মামলা রেকর্ড হয়েছে। এ ছাড়া মাসে ৭০টি চাঁদাবাজির মামলাও হয়েছে।
বুধবার (৩০ জুলাই) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরে ডিসি মিডিয়া মোহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডিএমপি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। কেউ যদি চেষ্টা করে তাহলে তাদের আইন অনুযায়ী মোকাবিলা করা হবে। এর বাইরে গোয়েন্দা তথ্য কাজে লাগিয়ে আইনশৃঙ্খলা স্থিতিশীল রাখতে কাজ করছি।
তিনি জানান, জননিরাপত্তা বিধান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ঢাকা মহানগর পুলিশ নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এরই অংশ হিসেবে টহল ও চেকপোস্ট বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডিএমপিতে ৪৪১টি টহল টিম মোতায়েন ছিল। এর মধ্যে দিনে ২৫৯ ও রাতে ২২১টি। ফুট পেট্রোল ২২১টি, মোটরপেট্রোল ২৭টি।
এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত স্থানে চেকপোস্ট পরিচালনা করা হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় সাড়াশি অভিযানে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ৪১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে ডাকাত, চোর, মাদক কারবারি ও পরোয়ানভুক্ত আসামি রয়েছে।
তিনি বলেন, অভিযানে মোবাইল ও নগদ ১৩ হাজার টাকা, মাদক উদ্ধার করা হয়। থানা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার ডিবি ওয়ারির একটি টিম ১২৩টি চোরাই মোবাইলসহ চক্রের ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মোহাম্মদপুরের কিশোর গ্যাং কব্জি কাটা গ্রুপের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বিঘ্নিত করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। সেই কব্জি কাটা গ্রুপের আনোয়ারের দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন- নিশাত ও রাসেল ওরফে পেস্টিং রাসেল।
এছাড়া গুলশানে সাবেক সংসদ সদস্যের বাসায় ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় ৫ জন রিমান্ডে রয়েছে। তাদের একজনের বাসা থেকে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এই ঘটনায় একটি মামলা কলাবাগান থানায় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে জানান মোহাম্মদ তালেবুর রহমান।
এদিকে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনায় পুরো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ব্যাপক হামলা, অনাস্থা আর আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশ কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায় দুষ্কৃতকারীদের কেউ কেউ সুযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে বলে মনে করছে পুলিশ। দেশে জুন মাসে অন্তত ৬৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মে মাসে এই সংখ্যা ছিল ৫৯। একই সময়ে বেড়েছে গণপিটুনির ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা। জুনে ৪১টি গণপিটুনির ঘটনায় ১০ জন নিহত ও ৪৭ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। আগের মাসে ৩৪টি ঘটনায় সাতজন নিহত ও ৩৮ জন আহত হয়েছিলেন। চলতি মাসে প্রকাশিত মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) জুন মাসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুনে ৩৬৩টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা গত মাসের তুলনায় ১০৫টি কম। তবে জুনে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ধর্ষণের শিকার ৬৩ জনের মধ্যে ১৯ শিশু ও ২৩ কিশোরী রয়েছে। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২ শিশু, ৭ কিশোরী ও ৮ নারী। ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে ১ কিশোরী ও ৩ নারী। ধর্ষণের চেষ্টা ছিল ২৭টি, যৌন হয়রানি ৩৯টি, শারীরিক নির্যাতনের ৫১টি ঘটনা ঘটেছে। জুনে ২১ কিশোরী, ২৬ নারীসহ মোট ৩৫ জন আত্মহত্যা করেছেন। অপহরণের শিকার হয়েছে ১ শিশু, ২ কিশোরী ও ১ নারী। এছাড়া ৩ শিশু, ৩ কিশোরী ও ৩ নারী নিখোঁজ রয়েছেন। জুনে ৩ শিশু, ৪ কিশোরী ও ৭ নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ৯২ শিশু, কিশোরী ও নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এরমধ্যে ৫৫ জন শিশু-কিশোরী রয়েছে।
এমএসএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুনে গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে। গণপিটুনির শিকার ৩০ জনকে আহত অবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়। জুনে ৪৯টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার হয়েছে। অল্পসংখ্যক ঘটনা ছাড়া সব লাশের পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছে। মে মাসে এর সংখ্যা ছিল ৫৫। গত ১০ মাসে দেশের আট বিভাগে ১৭২ জনকে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
সংস্থাটির তথ্য বলছে, কোথাও চোর-ছিনতাইকারী-চাঁদাবাজ এবং কোথাও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সহযোগী ও দোসর অপবাদ দিয়ে মব সৃষ্টি করে এসব মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ