নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৫ ০৮:৫৫ এএম
ছবি: সংগৃহীত
বিবদমান ভূ-রাজনীতির অগ্নিকুণ্ডে ঘি ঢেলেছে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ ইস্যু। কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ দীর্ঘদিনের। এবার যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটে পড়েছে ভারত। রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে রয়েছে বহু বছরের বন্ধুত্বের সুসম্পর্ক।
এতদিন সীমান্ত সমস্যাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধ থাকলেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণাত্মক আচরণে কাছাকাছি চলে এসেছে চীন ও ভারত। এভাবে বেশি মাত্রায় চাপ প্রয়োগ করতে গিয়ে এশিয়ার তিন মহারথী ‘চীন-রাশিয়া-ভারত’কে ঐকমত্যে আসার পরিবেশ সৃষ্টি করে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এই ভূ-রাজনীতির প্রভাব নানাভাবে বাংলাদেশের ওপর পড়বেই। এমন মন্তব্য বিশ্লেষকদের।
ভূ-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা কৌশল প্রয়োগ করে চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি সফলতার মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। অনেক দেশকে যুদ্ধের হুমকি দিতেও দ্বিধা করছেন না। বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যে পাল্টা শুল্কারোপ চূড়ান্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই পাল্টা শুল্কারোপেও ভূ-রাজনীতির ছাপ দেখতে পাচ্ছেন অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিকরা। তারা বলছেন, নিজেদের সিদ্ধান্ত ও স্বার্থবিরোধী দেশগুলোর বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে বেশি শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অনেক দেশের বিরুদ্ধে মার্কিন পদক্ষেপ বাণিজ্য সম্পর্কিত নয়, বরং এটি রাজনৈতিক।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও তার শুল্কের রোষানল থেকে রেহাই পাননি। ট্রাম্প প্রশাসনের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ, বাণিজ্যিক হুমকি এবং একতরফা নীতি প্রয়োগে চাপে পড়েছে প্রায় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ।
তবে এবার এসব চাপ ও হুমকিকে গুরুত্ব না দিয়ে একজোট হতে পারে বিশ্বের অন্যতম তিন মহাশক্তি রাশিয়া-চীন ও ভারত।
মার্কিন বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে একসঙ্গে কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছে রাশিয়া-চীন ও ভারত। যা বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুনমাত্রা যোগ করতে পারে।
দীর্ঘ ছয় বছর পর চীন সফরে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সফরের ঘোষণা এমন এক সময় এলো যখন এক সময়ের কৌশলগত মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এক প্রকার তলানিতে।
রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখায় ভারতের ওপর আবারও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। এনিয়ে গত বৃহস্পতিবার ক্রেমলিনে রুশ প্রশাসনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, আমরা (ট্রাম্পের) অনেক বিবৃতির কথাই শুনছি, যেগুলো আসলে হুমকি। বিভিন্ন দেশকে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমরা এই বিবৃতিগুলোকে বৈধ এবং ন্যায্য বলে মনে করছি না।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, পেসকভের বক্তব্যে কোথাও সরাসরি ভারতের নাম উল্লেখ করা না হলেও ভøভ্লাদিমির পুতিনের দেশ যে ট্রাম্পের শুল্কবাণের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির পাশে দাঁড়াচ্ছে, তা স্পষ্ট।
ট্রাম্পের এই হুমকির মাঝে চীনের তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে যাচ্ছেন মোদি। আর একই সময়ে চীন সফরে যাবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøভ্লাদিমির পুতিনও।
আগামী ৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে এই সম্মেলন। মোদি সর্বশেষ চীন সফরে গিয়েছিলেন ২০১৯ সালে। ২০২০ সালে লাদাখ সীমান্তে চীন-ভারত সেনাদের সংঘাতের পর দুই দেশের সম্পর্কে বেশ উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠে। তবে সেই সম্পর্ক উন্নতির পথে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ফাটল ধরার পর।
এনডিটিভির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এসএসিও সম্মেলনে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ, বাণিজ্যসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। ভারতের পক্ষ থেকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সম্ভাবনাও রয়েছে। লক্ষ্য, সম্পর্ক পুনরুদ্ধার ও সীমান্ত ইস্যুতে উত্তেজনার হ্রাস।
এর আগে, ২০২৪ সালে অক্টোবরে রাশিয়ায় ব্রিকসের সম্মেলনে মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে বৈঠক হয়। এ বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমনে নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতার শুরু হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের একতরফা নীতির কারণে বিশ্বের কূটনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট হচ্ছে। এই মুহূর্তে চীন, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে নতুন এক মেরূকরণ গড়ে উঠছে। যা ভবিষ্যতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
ট্রাম্প নতুন করে ভারতের ওপর ঘোষিত অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্কারোপে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে চীনও। নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত জু ফেইহং এক্সে দেওয়া পোস্টে ট্রাম্পকে ‘মাস্তান’ বলে কটাক্ষ করেন।
তিনি লেখেন, ‘মাস্তানকে এক ইঞ্চি জায়গা দিলে মাইলকে মাইল দখল করে নেবে।’ তার মতে, শুল্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অন্য দেশগুলোকে দমন করার চেষ্টা জাতিসংঘের বাণিজ্য নীতির পরিপন্থি এবং এই ধরনের পদক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
এদিকে, শুল্কারোপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, দেশের কৃষকদের স্বার্থে কোনো আপস করবেন না। সে জন্য তাকে অনেক মূল্য দিতে হতে পারে। তিনি প্রস্তুত।
গুরুত্বের সঙ্গে ঝুঁকিও বেড়েছে বাংলাদেশের: ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চোখ এখন বাংলাদেশের দিকে। ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বের পাশাপাশি ঝুঁকিও বেড়েছে দেশটির। কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল ছাড়া বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে বিশ্বাসী বাংলাদেশ। কিন্তু বর্তমানে ভূ-রাজনীতি বিশেষ করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে সমানতালে সামাল দিতে গিয়ে দেশটিকে বারবার বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
বিশ্বরাজনীতির অন্যতম শক্তি চীন ও আঞ্চলিক শক্তি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নৈকট্য এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলে এই দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনায় অনেক আগেই এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এ বিবেচনায় এবার যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তির কাছে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্ব পাচ্ছে।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত এক দশকে অবস্থার বদল ঘটেছে একাধিক্রমে চীনের উত্থান, বিশ্ব পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস, দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য ভারতের সুস্পষ্ট প্রয়াস এবং তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং তার আলোকে বাংলাদেশের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির কারণে।
১/১১-এর হামলার পর মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনার কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। নিরাপত্তার বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া এবং বুশ প্রশাসনের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ বিবেচনা থেকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয় নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়। জর্জ ডব্লিউ বুশের আমল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র মূলত ভারতের চোখেই বাংলাদেশকে দেখে এসেছে। এর পেছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে, এ অঞ্চলে ভারতীয় আধিপত্য নিশ্চিত করে যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি চীনকে ঠেকাতে চায়।
চীন কেবল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারীই নয়, এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ লক্ষ করা যায়।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ ও চীন একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে চীন ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঋণ প্রতিশ্রুতি। যদিও চীনের দেওয়া ঋণের ডিসবার্সমেন্ট খুবই কম। আর রাশিয়া ও বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যা এখনও বেশ সুদৃঢ়।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাখাইন করিডোর নিয়েও চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। মিয়ানমারে এই তিন মহারথীর রয়েছে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ। মিয়ানমারের সঙ্গে চীন ও ভারতের সীমান্ত যুক্তের বিষয়টিও বেশ স্পর্শকাতর। সব মিলিয়ে মিয়ানমার বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তার মেনে নেবে না ভারত, চীন ও রাশিয়া।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদুল আলম বলেন, বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যেখানে কেবল সামরিক শক্তি ব্যবহারই তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন্ন রাখতে পারে। এখানে সত্যিকার অর্থে শান্তি প্রতিষ্ঠা, পারস্পরিক সহাবস্থান এবং শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি করার মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব চীন ও রাশিয়ার মতো দেশকেও উগ্রপন্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী পদক্ষেপের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বেই। পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদি হলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতিকে ধীর করবে এবং এর ফলে বৈশ্বিক কর্মসংস্থানে ও বাংলাদেশের মতো স্বল্পমাত্রায় রপ্তানি করে এমন দেশগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
ভোরের আকাশ/মো.আ.