× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ডায়ালাইসিস যুদ্ধেই প্রাণক্ষয়

নিখিল মানখিন

প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৫ ০৯:৫৯ এএম

ডায়ালাইসিস যুদ্ধেই প্রাণক্ষয়

ডায়ালাইসিস যুদ্ধেই প্রাণক্ষয়

নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে না পেরে অকালে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার গাংগাইল ইউনিয়নের পংকরহাটি গ্রামের বাসিন্দা রাজু মিয়া। বেসরকারি হাসপাতালে সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিসের খরচ ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। দরিদ্র পরিবারের বেকার সন্তান রাজু মিয়ার পক্ষে এ টাকা ব্যয় করে ডায়ালাইসিস সেবা গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

সরকারি হাসপাতালে কম খরচে কিডনি ডায়ালাইসিস করানো যায়, এক প্রতিবেশির কাছে-এ খবর জানতে পেরে রাজু মিয়া রাজধানীর ন্যাশনাল কিডনি ইনস্টিটিউটি অব ইউরোলজিতে (নিকডু) কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা গ্রহণের ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছেন গত কয়েক দিন ধরে।

গত বৃহস্পতিবার হাসপাতাল চত্বরে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথা হয়। রাজু মিয়া জানান, গত তিন দিন ধরে ঘুরেও ডায়ালাইসিসের কোনো সুরাহা করতে পারেননি। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, কিডনি ডায়ালাইসিসের অনেক সিরিয়াল জমে আছে। সিরিয়ালে থাকা রোগীরা মাসের পর মাস ধরে আবার কেউবা এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু সিরিয়াল মিলছে না। এ অবস্থায় গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার।

রাজু মিয়ার সঙ্গে আলাপের সূত্র ধরে হাসপাতাল ঘুরে কিডনি ডায়ালাইসিস চিকিৎসার অবর্ণনীয় দুর্ভোগের চিত্র পাওয়া গেছে। কিডনি চিকিৎসার একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান রাজধানীর ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে ডায়ালাইসিসের জন্য আবেদনের স্তূপ জমেছে।

হাসপাতালটিতে গতকাল পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের সুযোগ চেয়ে ৫ হাজার ৫৮০ জন আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে এক হাজার ১৭৬ সিরিয়াল পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের সুযোগ পেয়েছেন। অন্যরা এখনও অপেক্ষায়। সিরিয়াল দেওয়া রোগীর মধ্যে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তার হিসাব নেই কারও কাছে। কিডনি ইনস্টিটিউটে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ৬০টি মেশিনে ডায়ালাইসিস করে। সেগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ১১০ থেকে ১২০ জন রোগী পাওয়া যায়। মাত্র ৫১০ টাকায় ডায়ালাইসিস সুবিধার কারণে রোগীর ভিড় থাকে উপচে পড়া।

আক্রান্তরা প্রভাবশালীদের সুপারিশ নিয়ে ডায়ালাইসিসের সিরিয়াল পেতে আবেদন করছেন। প্রতিদিন অন্তত অর্ধশত রোগী ডায়ালাইসিস করার সুযোগ চেয়ে ভিড় করলেও কর্তৃপক্ষ তাদের আবেদন নিতে পারছে না। দেড়শ’ শয্যার এ হাসপাতালে ভর্তি প্রার্থীর সংখ্যা কয়েক গুণ থাকে। আউটডোরেও গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী চিকিৎসা নেন। লজিস্টিক সাপোর্টের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যান্ডরের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে প্রতি ডায়ালাইসিসে স্যান্ডর পায় তিন হাজার টাকা। এর মধ্যে ৫৬০ টাকা দেয় রোগী, বাকিটা সরকার বহন করে। তবে পুরোনো রোগীদের সেবা দিতেই শেষ ডায়ালাইসিসের নির্ধারিত কোটা। তাই বাধ্য হয়ে অনেক রোগী বেসরকারিভাবে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় ডায়ালাইসিস নিচ্ছে।

ডায়ালাইসিস যুদ্ধেই প্রাণক্ষয়
কিডনি হাসপাতালে কথা হয় শরীয়তপুরের বাসিন্দা বিউটি আক্তার চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে এসেছেন। তার বাবা বাচ্চু মিয়ার  দুইটি কিডনি বিকল হয়ে পড়েছিল। চিকিৎসক সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস নিতে বলেছিলেন। বেসরকারিভাবে চড়া দামে ডায়ালাইসিসের পেছনে টাকা খরচ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। সরকারিভাবে কিছুটা কম দরে ডায়ালাইসিস সেবা পেতে ২০২২ সালের ১৮ নভেম্বর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে (নিকডু) আবেদন করেন। তাতে সুপারিশ করেন তখনকার এক প্রভাবশালী এমপি। কিন্তু সিরিয়াল মেলেনি। ডায়ালাইসিস নিতে না পেরে তার বাবা বাচ্চু মিয়া ওই বছরের ২১ ডিসেম্বর মারা যায়। দু’টি কিডনিই বিকল হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার মধ্য সাদুল্যা ফকিরপাড়া গ্রামের মেধাবী শিক্ষার্থী লিমা আক্তারের(১৮)। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বাবা আব্দুল লতিফ। চিকিৎসার মাঝপথে টাকার অভাবে থমকে গেছে লিমার ডায়ালাইসিস চিকিৎসা। 

তার মাতা মাছুমা বেগম বলেন, মেয়েটা কিছু খায় না, সারাদিন কান্নাকাটি করে থাকে। পেটের ভেতর জ্বালাপোড়া করে। প্রতি সপ্তাহে দুইবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। খরচ পড়ে  ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। আমরা গরিব মানুষ, ঠিকমতো খেতে পারি না। এতো টাকা কিভাবে জোগাড় করি। চিকিৎসার পেছনে ভিটেমাটি হারিয়ে পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে গেছে বলে জানান মাছুমা বেগম।

লিমার বাবা আব্দুল লতিফ জানান, চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যেতে হয়। চিকিৎসা ব্যয়ের সঙ্গে যাতায়াত ও ঢাকায় থাকা-খাওয়ার পেছনেও অনেক টাকা লাগে বলে জানান আব্দুল লতিফ। প্রথমবার ডায়ালাইসিস শুরু হয়েছে ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার ধাইরপাড়া গ্রামের কিডনি বিকল রোগী সুফলা সাংমার। 

তার স্বামী পিপলু মানখিন বলেন, ঢাকায় চিকিৎসা করাতে এসে স্ত্রীর দু’টি কিডনিই বিকল ধরা পড়েছে। রাজধানীর জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতালে  এক সপ্তাহে দু’বার ডায়ালাইসিস দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এই হাসপাতালের ছয় মাসের ডায়ালাইসিস প্যাকেজ পাওয়ার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু সুযোগ পাইনি। অসংখ্য আবেদন পড়ে আছে বলে জেনেছি। বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করানোর আর্থিক সামর্থ্য আমাদের নেই। জেলা পর্যায়ে নেই এই চিকিৎসাসুবিধা। ঢাকায় বাসা নিয়ে চিকিৎসা করাতে অনেক টাকার দরকার। নিয়মিত ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাওয়া নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি বলে জানান পিপলু মানখিন।  

এভাবে দেশে কিডনি বিকল রোগীরা ভুগছেন জীবনের অনিশ্চয়তায়। কিডনি প্রতিস্থাপন অথবা ডায়ালাইসিস- যে পদ্ধতিই খুঁজি না কেন, কিছু আটকে যাচ্ছে ব্যয়বহুল চিকিৎসার কাছে। ডায়ালাইসিস সেন্টারের সংকটের কারণে সারাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ রোগীকে রাজধানীমুখী হতে হয়। ফলে চিকিৎসার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের বড় অংশই যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার পেছনে খরচ হয়ে যাচ্ছে।  

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা বলছে, দেশে এখন কিডনি রোগী প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। একজন রোগীর নিয়মিত ডায়ালাইসিস সেবা নিতে মাসে গড়ে ৪৬ হাজার ৪২৬ টাকা খরচ হয়। ৯২ দশমিক ৮৭ শতাংশ পরিবারই এই খরচ চালাতে গিয়ে আর্থিক সমস্যায় পড়ে। সাড়ে ১৯ শতাংশ রোগী প্রয়োজনের চেয়ে কম ডায়ালাইসিস করান।

ডায়ালাইসিস সেন্টার ও চিকিৎসা সংকট 
জেলা পর্যায়ে কিডনি রোগের চিকিৎসা নেই। দুই কোটির বেশি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হলেও দেশের বড় বড় হাসপাতালে এ রোগের জন্য নেই পৃথক কোনো ইউনিট। দেশে মাত্র ৮০ থেকে ৯০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। পুরোনো আটটি মেডিকেল কলেজের সবগুলোতে ডায়ালাইসিস সেন্টার নেই। নিকডু ছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, সোহরাওয়ার্দী, মুগদা, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা. সিলেট, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা এবং সিরাজগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু আছে।

কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, দেশে কিডনি রোগীর মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ ডায়ালাইসিস করার সুযোগ পায়। অন্যরা অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। মাত্র ৯৬টি ডায়ালাইসিস সেন্টারে ১৮ হাজার রোগী সপ্তাহে সেবা পায়। ডায়ালাইসিস ব্যয় কমাতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

চিকিৎসা ব্যয় বহন করে প্রতিবছর দেশের ৫০ লাখ মানুষ গরিব হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম। তিনি বলেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ সুদের ওপর বা ধার করে টাকা নিয়ে চিকিৎসা করেন। পরে তাদেরকে টাকা শোধ করতে হয় নিজেদের জমি-জমা বিক্রি করতে হয়।

উপাচার্য বলেন, দেশের জনসংখ্যা বিশাল। প্রচুর রোগী রয়েছে। তাই এখানে চাইলেই গবেষণা করা যায়। অনেক উন্নত দেশ আছে আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু রোগী কম। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্র আলাদা।

বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বলেন, দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কিডনি রোগী। তবে চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে চিকিৎসা করাতে পারেন না। এ জন্য জেলা পর্যায়ে ডায়ালাইসিস ইউনিট করা গেলে কিডনি রোগীর চিকিৎসা খরচ কমানো যেত।

নিকডুর পরিচালক ডা. সৈয়দ আলফাসানি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘হাসপাতালের লজিস্টিক সাপোর্ট অনুযায়ী ৫০ জন রোগীর মধ্যে মাত্র একজনের ডায়ালাইসিস এবং ৬০ জনে মাত্র একজন রোগী তারা ভর্তি করতে পারছেন। এতে বেশিরভাগ রোগীই চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। যন্ত্রপাতির পাশাপাশি শয্যাসংখ্যা না বাড়ালে রোগীর সেবা নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

ভোরের আকাশ/এসএইচ

  • শেয়ার করুন-
 স্কয়ার ফার্মার উৎপাদন দেখে জাম্বিয়া শিল্প সচিবের প্রশংসা

স্কয়ার ফার্মার উৎপাদন দেখে জাম্বিয়া শিল্প সচিবের প্রশংসা

 রাজধানীর ৯ স্থানে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ: ডিএমপি

রাজধানীর ৯ স্থানে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ: ডিএমপি

 দপ্তরীর মেয়ে বিথিও স্বপ্ন দেখছেন দেশ গড়ার

দপ্তরীর মেয়ে বিথিও স্বপ্ন দেখছেন দেশ গড়ার

 চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে সুনির্দিষ্ট রূপ দেওয়া হবে: আলী রীয়াজ

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে সুনির্দিষ্ট রূপ দেওয়া হবে: আলী রীয়াজ

 মান্দায় শিশুদের মাঝে পল্লী শিশু ফাউন্ডেশনের পুরস্কার বিতরণ

মান্দায় শিশুদের মাঝে পল্লী শিশু ফাউন্ডেশনের পুরস্কার বিতরণ

সংশ্লিষ্ট

কোথায় বসবে কে চালাবে ঠিক না করেই মেশিন কেনার তোড়জোড়

কোথায় বসবে কে চালাবে ঠিক না করেই মেশিন কেনার তোড়জোড়

ডায়ালাইসিস যুদ্ধেই প্রাণক্ষয়

ডায়ালাইসিস যুদ্ধেই প্রাণক্ষয়

তাপপ্রবাহে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরুরি নির্দেশনা

তাপপ্রবাহে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরুরি নির্দেশনা

মহাখালীতে খোলা হলো হিটস্ট্রোক সেন্টার

মহাখালীতে খোলা হলো হিটস্ট্রোক সেন্টার