সারাদেশে টিকা কার্ডের সংকট
সারাদেশে দেখা দিয়েছে টিকা কার্ডের সংকট। বাচ্চার জন্মের পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) টিকা দিতে হয়। টিকা প্রদানের পর নতুনদের পরবর্তী টিকাদানের তারিখ উল্লেখ করে টিকাদান কার্ড দেওয়া হয় এবং পুরাতনদের কার্ডে পরবর্তী টিকাদানের তারিখ উল্লেখ করা হয়। দুর্ভোগ ও বিপাকে পড়ছেন বাচ্চাদের অভিভাবকরা। আর টিকা কার্ড না পাওয়ায় সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ করাতে পারছেন না তারা।
শুধু তাই নয়, কার্ড না থাকায় টিকা কর্মসূচির কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এদিকে শিশুদের টিকা প্রদানের হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি অর্জন করলেও উল্লেখযোগ্য ব্যবধান রয়ে গেছে বলে সতর্ক করেছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভি।
ইপিআই কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন সময় (প্রাপ্যতা অনুযায়ী) যক্ষ্মা, ডিফথেরিয়া, ধনুষ্টংকার, হুপিংকাশি, পোলিও, হেপাটাইটিস বি, হিমো-ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, হাম ও রুবেলা এই ৯টি রোগের প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করা হয়। পাশাপাশি ১৫ থেকে ৪৯ বছরের নারীদের পাঁচ ডোজ টিটি টিকা দেওয়া হয়।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. আবুল ফজল মো. সাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘এই সংকট হুট করে হয়নি। গত বছর আমাদের টেন্ডার হয়নি। সাপ্লাই দেয়নি। আমরা বিলও দেইনি। বছর শেষ হয়ে গেছে, আমরা কী করবো? এবার প্রিন্টিংয়ে যাচ্ছে। দু-এক মাস লাগবে হয়তো। এরপর সব জায়গায় পৌঁছে দেবো।’
দুর্ভোগ ও বিপাকে অভিভাবকরা
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার জয়রামকুড়া গ্রামের দম্পতি মো. কামাল ও জুলেখা। তারা ভোরের আকাশকে জানান, আমাদের নবজাতক শিশুকে টিকা দেওয়ানোর জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিলাম। টিকা কার্ড না থাকার কথা জানালেন স্বাস্থ্য সহকারী মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কার্ড পৌঁছলে জানানো হবে। কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা জানানো হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কামাল ও জুলেখা দম্পতি। একই অবস্থা পার্শ্ববর্তী ধোবাউড়া উপজেলাতেও।
সদর ইউনিয়নের স্বপন সরকার বলেন, ‘ কয়েক সপ্তাহ ধরে টিকা কার্ডের জন্য যোগাযোগ করছি। একজন স্বাস্থ্য সহকারীকে বলে রেখেছি। কার্ড আসা মাত্রই খবর পাবো বলে জানান স্বপন সরকার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েক স্বাস্থ্য সহকারী ভোরের আকাশকে জানান, গত কয়েক মাস ধরে পর্যাপ্ত টিকা কার্ড পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে আমাদের কোনো অবহেলা নেই। কেন্দ্রীয় অফিস থেকে জেলায় এবং সেখান থেকে উপজেলায় এসে পৌঁছায়। সংকটের কারণ জানি না।
দুর্গাপুরের মাধবপুর গ্রামের বাসিন্দা সুজন মারাক। তিনি উপজেলা সদরে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ করেন। তিনি জানান, বেশিরভাগ এলাকায় সাদা কাগজে হাতে লিখে টিকা দেওয়ার তথ্য সংরক্ষণ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। কোথাও অনলাইন থেকে প্রিন্ট করে কাগজ দেওয়া হচ্ছে। যদিও এগুলো অফিসিয়াল কাজে গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানান সুজন মারাক।
টিকা কার্ড পাননি এমন ভুক্তভোগীদের একজন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার তৌহিদুজ্জামান বলেন, ‘গত জানুয়ারি মাসে আমার একটি ছেলে সন্তান জন্ম লাভ করে। জন্মের ৪৫ দিনের মাথায় স্থানীয় মা ও শিশু কেন্দ্রে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে কোনো টিকা কার্ড দেয়নি। তাদের জিজ্ঞেস করা হলে জানায়, কার্ড শেষ হয়ে গেছে অনেক দিন আগে। কিন্তু সরকার থেকে এখনো তাদের কাছে কার্ড সরবরাহ করা হয়নি। তৃতীয় দফায় টিকা দেওয়া হলেও কার্ড এখনো দেয়নি। টিকা কার্ড না দেওয়ার কারণে জন্ম নিবন্ধন সনদ করতে পারছি না।’
একই এলাকার আবু সাঈদও এ ঘটনার ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা অনলাইন পেপার দিয়েছে। সেটা দিয়ে আপাতত টিকা দিচ্ছি। কিন্তু কার্ড দেয়নি। এ কারণে ভবিষ্যতে তো আমরা বিপাকে পড়বো। জন্ম নিবন্ধন সনদ করা যাবে না। এ সংক্রান্ত অন্যান্য সেবা থেকেও বঞ্চিত হবো।’ একই চিত্র বরগুনা জেলায়। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে কয়েক সপ্তাহে ঘুরে শিশু আসফিয়া তাইয়েবার টিকা দেওয়া গেলেও কার্ড পাননি তার মা শাহিমা আকতার।
শাহিমা আকতার বলেন, ‘আমরা হাসপাতালে গিয়ে যথাসময়ে টিকা দিতে পারছি না। এক সপ্তাহেরটা আরেক সপ্তাহে দিতে হচ্ছে। আর টিকা কার্ড তো নাই। দিবে কোত্থেকে? চার মাস হয়ে গেলেও টিকা কার্ড পাইনি। যার কারণে জন্ম নিবন্ধন সনদের আবেদনও করতে পারছি না।’
টিকা কার্ডের সংকট রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়ও। জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী নীহার রঞ্জন আচার্য্য বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই টিকা কার্ডের সংকট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ নেই।’
চার লাখ শিশু সব টিকা পায়নি, আওতায় আসেনি ৭০ হাজার
শিশুদের টিকা প্রদানের হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি অর্জন করলেও উল্লেখযোগ্য ব্যবধানু রয়ে গেছে বলে সতর্ক করেছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভি। প্রায় চার লাখের মতো শিশু ঠিকমতো সব টিকা পায়নি বলে জানিয়েছে সংস্থাগুলো।
এছাড়া তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৭০ হাজার শিশু একেবারেই টিকার আওতায় আসেনি। এতে এসব শিশুর অবস্থা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। গত ২৮ এপ্রিল এক যৌথ বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলগুলোতে টিকা না পাওয়ার হার বেশি। এখানে মাত্র ৭৯ শতাংশ পুরোপুরি টিকা পেয়েছে। কিন্তু ২ দশমিক ৪ শতাংশ এক ডোজ টিকাও পায়নি এবং নয় দশমিক আট শতাংশ টিকার সব ডোজ ঠিকমতো পায়নি। সেই তুলনায় গ্রামাঞ্চলে ৮৫ শতাংশ শিশু টিকার সব ডোজ পেয়েছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ
সংশ্লিষ্ট
সারাদেশে দেখা দিয়েছে টিকা কার্ডের সংকট। বাচ্চার জন্মের পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) টিকা দিতে হয়। টিকা প্রদানের পর নতুনদের পরবর্তী টিকাদানের তারিখ উল্লেখ করে টিকাদান কার্ড দেওয়া হয় এবং পুরাতনদের কার্ডে পরবর্তী টিকাদানের তারিখ উল্লেখ করা হয়। দুর্ভোগ ও বিপাকে পড়ছেন বাচ্চাদের অভিভাবকরা। আর টিকা কার্ড না পাওয়ায় সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ করাতে পারছেন না তারা।শুধু তাই নয়, কার্ড না থাকায় টিকা কর্মসূচির কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এদিকে শিশুদের টিকা প্রদানের হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি অর্জন করলেও উল্লেখযোগ্য ব্যবধান রয়ে গেছে বলে সতর্ক করেছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভি।ইপিআই কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন সময় (প্রাপ্যতা অনুযায়ী) যক্ষ্মা, ডিফথেরিয়া, ধনুষ্টংকার, হুপিংকাশি, পোলিও, হেপাটাইটিস বি, হিমো-ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, হাম ও রুবেলা এই ৯টি রোগের প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করা হয়। পাশাপাশি ১৫ থেকে ৪৯ বছরের নারীদের পাঁচ ডোজ টিটি টিকা দেওয়া হয়।সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. আবুল ফজল মো. সাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘এই সংকট হুট করে হয়নি। গত বছর আমাদের টেন্ডার হয়নি। সাপ্লাই দেয়নি। আমরা বিলও দেইনি। বছর শেষ হয়ে গেছে, আমরা কী করবো? এবার প্রিন্টিংয়ে যাচ্ছে। দু-এক মাস লাগবে হয়তো। এরপর সব জায়গায় পৌঁছে দেবো।’দুর্ভোগ ও বিপাকে অভিভাবকরাময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার জয়রামকুড়া গ্রামের দম্পতি মো. কামাল ও জুলেখা। তারা ভোরের আকাশকে জানান, আমাদের নবজাতক শিশুকে টিকা দেওয়ানোর জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিলাম। টিকা কার্ড না থাকার কথা জানালেন স্বাস্থ্য সহকারী মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কার্ড পৌঁছলে জানানো হবে। কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা জানানো হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কামাল ও জুলেখা দম্পতি। একই অবস্থা পার্শ্ববর্তী ধোবাউড়া উপজেলাতেও।সদর ইউনিয়নের স্বপন সরকার বলেন, ‘ কয়েক সপ্তাহ ধরে টিকা কার্ডের জন্য যোগাযোগ করছি। একজন স্বাস্থ্য সহকারীকে বলে রেখেছি। কার্ড আসা মাত্রই খবর পাবো বলে জানান স্বপন সরকার।নাম প্রকাশ না করার শর্তে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েক স্বাস্থ্য সহকারী ভোরের আকাশকে জানান, গত কয়েক মাস ধরে পর্যাপ্ত টিকা কার্ড পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে আমাদের কোনো অবহেলা নেই। কেন্দ্রীয় অফিস থেকে জেলায় এবং সেখান থেকে উপজেলায় এসে পৌঁছায়। সংকটের কারণ জানি না।দুর্গাপুরের মাধবপুর গ্রামের বাসিন্দা সুজন মারাক। তিনি উপজেলা সদরে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ করেন। তিনি জানান, বেশিরভাগ এলাকায় সাদা কাগজে হাতে লিখে টিকা দেওয়ার তথ্য সংরক্ষণ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। কোথাও অনলাইন থেকে প্রিন্ট করে কাগজ দেওয়া হচ্ছে। যদিও এগুলো অফিসিয়াল কাজে গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানান সুজন মারাক।টিকা কার্ড পাননি এমন ভুক্তভোগীদের একজন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার তৌহিদুজ্জামান বলেন, ‘গত জানুয়ারি মাসে আমার একটি ছেলে সন্তান জন্ম লাভ করে। জন্মের ৪৫ দিনের মাথায় স্থানীয় মা ও শিশু কেন্দ্রে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে কোনো টিকা কার্ড দেয়নি। তাদের জিজ্ঞেস করা হলে জানায়, কার্ড শেষ হয়ে গেছে অনেক দিন আগে। কিন্তু সরকার থেকে এখনো তাদের কাছে কার্ড সরবরাহ করা হয়নি। তৃতীয় দফায় টিকা দেওয়া হলেও কার্ড এখনো দেয়নি। টিকা কার্ড না দেওয়ার কারণে জন্ম নিবন্ধন সনদ করতে পারছি না।’একই এলাকার আবু সাঈদও এ ঘটনার ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা অনলাইন পেপার দিয়েছে। সেটা দিয়ে আপাতত টিকা দিচ্ছি। কিন্তু কার্ড দেয়নি। এ কারণে ভবিষ্যতে তো আমরা বিপাকে পড়বো। জন্ম নিবন্ধন সনদ করা যাবে না। এ সংক্রান্ত অন্যান্য সেবা থেকেও বঞ্চিত হবো।’ একই চিত্র বরগুনা জেলায়। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে কয়েক সপ্তাহে ঘুরে শিশু আসফিয়া তাইয়েবার টিকা দেওয়া গেলেও কার্ড পাননি তার মা শাহিমা আকতার।শাহিমা আকতার বলেন, ‘আমরা হাসপাতালে গিয়ে যথাসময়ে টিকা দিতে পারছি না। এক সপ্তাহেরটা আরেক সপ্তাহে দিতে হচ্ছে। আর টিকা কার্ড তো নাই। দিবে কোত্থেকে? চার মাস হয়ে গেলেও টিকা কার্ড পাইনি। যার কারণে জন্ম নিবন্ধন সনদের আবেদনও করতে পারছি না।’টিকা কার্ডের সংকট রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়ও। জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী নীহার রঞ্জন আচার্য্য বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই টিকা কার্ডের সংকট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ নেই।’চার লাখ শিশু সব টিকা পায়নি, আওতায় আসেনি ৭০ হাজারশিশুদের টিকা প্রদানের হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি অর্জন করলেও উল্লেখযোগ্য ব্যবধানু রয়ে গেছে বলে সতর্ক করেছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভি। প্রায় চার লাখের মতো শিশু ঠিকমতো সব টিকা পায়নি বলে জানিয়েছে সংস্থাগুলো।এছাড়া তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৭০ হাজার শিশু একেবারেই টিকার আওতায় আসেনি। এতে এসব শিশুর অবস্থা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। গত ২৮ এপ্রিল এক যৌথ বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়।সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলগুলোতে টিকা না পাওয়ার হার বেশি। এখানে মাত্র ৭৯ শতাংশ পুরোপুরি টিকা পেয়েছে। কিন্তু ২ দশমিক ৪ শতাংশ এক ডোজ টিকাও পায়নি এবং নয় দশমিক আট শতাংশ টিকার সব ডোজ ঠিকমতো পায়নি। সেই তুলনায় গ্রামাঞ্চলে ৮৫ শতাংশ শিশু টিকার সব ডোজ পেয়েছে।ভোরের আকাশ/এসএইচ
দুইবার ‘মাইল স্ট্রোক’ এর শিকার হয়েছেন ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার বণিক্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা যাকোব মান্দিক (৬৫)। তিনি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। তার পক্ষে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন এবং চিকিৎসাসেবা গ্রহণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। স্ট্রোকের শিকার হওয়ার আগে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেননি তিনি। এভাবে দেশের হাজার হাজার মানুষ অজান্তেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, জানার আগেই উচ্চ রক্তচাপ এমন পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন জটিল অসংক্রামক রোগ বাসা বাঁধে। আর অনেক রোগীকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। রাজধানীর মগবাজার এলাকার ইনসাফ বারাকাহ হাসপাতালের বিপরীত পার্শ্বে ফুটপাতে চা বিক্রি করেন মো. ইয়াসিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম। স্বামীকে না জানিয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য এক রিক্রুটিং এজেন্সিকে কয়েক লাখ দিয়েছেন ফাতেমা বেগম। বিষয়টি জানার পর টেনশনে অস্থির মো. ইয়াসিন।ফাতেমা বেগম ভোরের আকাশকে জানান, তার স্বামী উচ্চ রক্তচাপের রোগী। আর বিষয়টি জানার পর দুই সপ্তাহ আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে মেডিকেল পরীক্ষা করানোর পর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার কথা তারা জানতে পারেন। রাগে অস্থির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার স্বামীর শরীর কাঁপতে থাকে বলে জানান ফাতেমা বেগম। ঘাড় ব্যথা ও বমি বমি ভাব হওয়ার কারণ বুঝতে পারেননি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অটো রিকশাচালক মো. আবুল কাশেম। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পরীক্ষা করানোর পর বিষয়টি ধরা পড়ে। রোগীর সঙ্গে আছেন বড় ভাই জলিল মিয়া। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ঘাড় ব্যথা ও বমি বমি ভাব হওয়ার পর বিছানায় হেলে পড়েন তার ছোট ভাই আবুল কাশেম। গরমের কারণে এমনটি হতে পারে বলে তারা প্রথমে ধারণা করেন। কিন্তু শরীর নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী উচ্চ রক্তচাপের কারণেই রোগীর এমন অবস্থা হয়ে বলে জানান মো. জলিল মিয়া। এভাবে বাংলাদেশে নীরব ঘাতক হয়ে উঠেছে উচ্চ রক্তচাপ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভাষ্য এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্তদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকে। নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে মাত্র ১৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে ১ জন। বাকি ৮৫ শতাংশ রোগী উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন ওষুধ সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই অসংক্রামক রোগজনিত অকালমৃত্যু অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে রক্তপ্রবাহের চাপ অনেক বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাডপ্রেশার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। দুটি মানের মাধ্যমে এই রক্তচাপ রেকর্ড করা হয়। যেটার সংখ্যা বেশি সেটাকে বলা হয় সিস্টোলিক প্রেশার; আর যেটার সংখ্যা কম, সেটা ডায়াস্টলিক প্রেশার। প্রতিটি হৃদস্পন্দন, অর্থাৎ হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও সম্প্রসারণের সময় একবার সিস্টোলিক প্রেশার এবং একবার ডায়াস্টলিক প্রেশার হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের রক্তচাপ থাকে ১২০-৮০ মিলিমিটার মার্কারি। কারও ব্লাডপ্রেশার রিডিং যদি ১৪০-৯০ বা এর চেয়েও বেশি হয়, তখন বুঝতে হবে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে। অন্যদিকে রক্তচাপ যদি ৯০-৬০ বা এর আশপাশে থাকে, তাহলে তাকে লো ব্লাড প্রেশার হিসাবে ধরা হয়। যদিও বয়স-নির্বিশেষে রক্তচাপ খানিকটা বেশি বা কম হতে পারে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও’র-২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের (৩০-৭৯ বছর বয়সী) অর্ধেকই (৫৫ শতাংশ পুরুষ, ৪৬ শতাংশ নারী) জানে না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে।গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই)-এর গবেষণা প্রতিবেদন জানানো হয়, বাংলাদেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, কিডনি রোগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি উচ্চ রক্তচাপ। ডব্লিউএইচও’র গ্লোবাল রিপোর্ট অন হাইপারটেনশন-২০২৩ (সর্বশেষ) এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ২ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করেছে, যার ৫৪ শতাংশের জন্য দায়ী উচ্চ রক্তচাপ।এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ অনেকটাই কমানো সম্ভব। সরকার ইতোমধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে ওষুধ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে এ খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।তিনি আরও বলেন, দেশের হাজার হাজার মানুষ অজান্তেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। জানার আগেই উচ্চ রক্তচাপ এমন পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন জটিল অসংক্রামক রোগ বাসা বাঁধে। আর অনেক রোগীকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।উচ্চ রক্তচাপের কারণ ও লক্ষণ নিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. এস টি এ আজম ভোরের আকাশকে বলেন, উচ্চ রক্তচাপের একেবারে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ সেভাবে প্রকাশ পায় না। তবে সাধারণ কিছু লক্ষণের মধ্যে রয়েছে- প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করা, মাথা গরম হয়ে যাওয়া এবং মাথা ঘোরানো, ঘাড় ব্যথা করা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, অল্পতেই রেগে যাওয়া বা অস্থির হয়ে শরীর কাঁপতে থাকা, রাতে ভালো ঘুম না হওয়া, মাঝে মাঝে কানে শব্দ হওয়া এবং অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রোগী। এসব লক্ষণ দেখা দিলে নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করতে এবং ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. এস টি এ আজম।উচ্চ রক্তচাপের কারণসমূহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাধারণত মানুষের ৪০ বছরের পর থেকে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে। এছাড়া অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা, পরিবারে কারও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে, নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম না করলে, প্রতিদিন ছয় গ্রাম অথবা এক চা চামচের বেশি লবণ খেলে, ধূমপান বা মদ্যপান বা অতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য/পানীয় খেলে, দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের সমস্যা হলে এবং শারীরিক ও মানসিক চাপ থাকলে থাকলে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে।ভোরের আকাশ/এসএইচ
কিডনি প্রতিস্থাপনে রয়েছে আইনি নানা জটিলতা। একইসঙ্গে চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। দরিদ্র মানুষের পক্ষে কিডনি প্রতিস্থাপন করে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাদের বেঁচে থাকার সম্বল এই ডায়ালাইসিস। তথ্য বলছে, দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। বছরে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয়। এ রোগের চিকিৎসাও ব্যয়বহুল।এ ছাড়া ৮০ শতাংশ সেবাকেন্দ্র ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় চিকিৎসা নিয়ে অতল সাগরে পড়েন জেলা পর্যায় ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীরা। এমন বাস্তবতায় কিডনি চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ ও রোগীর ভোগান্তি কমাতে ২০২০ সালে প্রায় ২৫৫ কোটি ২২ লাখ টাকার ‘১৫টি মেডিকেল কলেজে ও ৪৪টি জেলায় ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন’ নামে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল সরকার। সেই প্রকল্পটি আজও আলোর মুখ দেখেনি। প্রকল্প পরিচালক বদল হয়েছেন পাঁচ জন। প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়েছে তিন বার। তারপরও কাজের অগ্রগতি শূন্য। প্রকল্পটি যেন কচ্ছপের পিঠে চড়ে বসেছে।পাঁচ বছর পার হলেও নানা ফিকির আর ষড়যন্ত্রে এক আনা কাজও এগোয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ শুধু বাড়ছেই। তৃতীয় বারের মতো প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু ৩ হাজার ৮৭৪ জনবল নিয়োগের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। পাওয়া যাচ্ছে না পর্যাপ্ত জায়গা। এর আগেই যন্ত্রপাতি কেনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে কয়েকটি চক্র।জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির কেন এমন দশা তা জানতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে ভোরের আকাশ। তারা বলছেন, জনবল নিয়োগ না হওয়া এবং স্থান সংকটের কারণেই এখনও শুরু করা যায়নি কাজ। এর বাইরে রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। স্বাস্থ্য খাতে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন বাণিজ্য হয়। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী ঠিকাদার গ্রুপ অধিকহারে কমিশন দিতে পারে। কেনাকাটার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ চক্রটি যোগসাজোশ করে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে অধিক মুনাফা হাতিয়ে নিতে উদগ্রীব ছিল।তবে অন্য চক্রগুলো কাজ না পেয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে এ করে প্রকল্পের কেনাকাটার প্রক্রিয়া ঝুলে যায়। এ পর্যন্ত প্রকল্পের টাকা খরচ হয়েছে মাত্র দুই লাখ। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে গোঁজামিল দিয়ে তিন দফা দরপত্র আহ্বান করে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ। তবে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শর্ত পূরণ করতে না পারায় প্রতিবারই দরপত্র বাতিল করতে হয়। কেনা যায়নি যন্ত্রপাতি। ফলে ‘১৫টি মেডিকেল কলেজে ও ৪৪ জেলার কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস সেবা এখনও অধরা থেকে গেছে। এ অবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে আগামী ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হারুন-অর-রশিদ ভোরের আকাশকে বলেন, এ ধরনের প্রকল্পের জন্য আগে স্থান নির্ধারণ করতে হয়। এরপর দক্ষ জনবল নিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই দুইটি কাজ এখনও শুরুই হয়নি। এর আগের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় নজর দেওয়া হয়েছে। যন্ত্রপাতি কিনে কোথায় রাখা হবে-সেই জায়গাই তো নেই। আবার এগুলো কারা অপারেট করবে-তারাও নেই। তাহলে যন্ত্রপাতি কিনে কী লাভ হবে। এগুলো ফেলে রাখতে তো নষ্ট হয়ে যাবে। স্বাস্থ্যে এ ধরনের অনেক যন্ত্রপাতি ক্রয় করে বছরের পর বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। যেগুলো অপারেট করার মতো জনবল নেই। এ কারণে বাক্সবন্দি থেকেই হাজার হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। কিডনি রোগীদের চিকিৎসায় গৃহীত এ প্রকল্পটির যেন এ অবস্থা না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজর দেওয়ার অনুরোধ জানান এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) মো. মঈনুল আহসান বলেন, একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে অবকাঠামো নির্মাণে জন্য জায়গা নির্বাচন করা হয়। অনেক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল জায়গা দিতে পারেনি। এ ছাড়া কেনাকাটায় জটিলতা তো রয়েছেই। কেনাকাটা শেষ হলে তিন হাজার জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে পাঁচ বছর পেরোলেও এই প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই-এমন প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি। ভাগবাটোয়ারার ফাঁদে প্রকল্পটিসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু কমিশন ভাগবাটোয়ারা নিয়ে জটিলতার ফাঁদে পড়ে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখছে না। এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা। এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে এখনই শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে স্বাস্থ্যসেবাকে জনমুখী করা সম্ভব হবে না। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কেনাকাটায় জটিলতা তো আছেই। তবে জনবল নিয়োগ না হওয়া ও স্থান সংকটের কারণে এখনও শুরু করা যায়নি প্রকল্পের কাজ।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫টি মেডিকেল কলেজে ৫০ শয্যা করে আর ৪৪ জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস ইউনিট করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও যন্ত্রপাতি কেনাকাটা জটিলতায় সেটি থেমে যায়। এরপর এক বছর করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। তৃতীয় দফায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ২ লাখ টাকা খবর হয়েছে। এ অবস্থায় আগামী বছরের জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সর্বশেষ গত বছর যন্ত্রপাতি ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে প্রকল্পের জিডিই-১ লটের আওতায় গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আট মেডিকেল কলেজ ও ১৬ জেলার জন্য ডায়ালাইসিস যন্ত্র কেনাকাটার দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে প্রাক্কলন খরচ ধরা হয় ৯৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। এতে চার প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। তবে দরপত্রে এমন নির্দেশাবলি (স্পেসিফিকেশন) দেওয়া হয়, যাতে নিপ্রো-জেএমআই ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নিতে না পারে। নিপ্রো-জেএমআই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক। করোনাকালে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা ও মাস্ক সরবরাহের ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। সে সময় তিনি গ্রেপ্তারও হন।জিডিই-১ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জিডি-২ লটে ডায়ালাইসিস যন্ত্রের ১২ ইঞ্চি বা এর চেয়ে বড় টিউনাবল টাচ স্ক্রিনের শর্ত দেওয়া হয়। তবে জিডি-১ লটে ১০ ইঞ্চি বা এর চেয়ে বড় টিউনাবল টাচ স্ক্রিন চাওয়া হয়। প্রকল্পের ২০২২ সালের কেনাকাটায় ডায়ালাইসিস মেশিনের ডায়ালাইসেট ফ্লোরেট ৩০০-৮০০ মিলি/মিনিটের মধ্যে হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। তবে এই লটে ফ্লো রেট চাওয়া হয়েছে ২০০-৮০০ মিলি/ মিনিট। জিডিই-১ প্রকল্পের কেনাকাটায় হেমোডায়ালাইসিস ফাংশন (এইচডিএফ) চাওয়া হয়েছে।এর আগে ডায়ালাইসিস যন্ত্র কেনাকাটার দরপত্রে এইচডিএফ চাওয়া হয়নি। সরবরাহকারীকে পাঁচ বছরের মধ্যে একটি দরপত্রে শুধু ডায়ালাইসিস যন্ত্র কেনাকাটায় ৭০ কোটি কিংবা তার বেশি টাকার যন্ত্র সরবরাহের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। অথচ এই প্রকল্পে ২০২২ সালের জিডি-২ লটের কেনাকাটায় পাঁচ বছরের মধ্যে আলাদা দুটি দরপত্রে ২২ কোটি টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়।এমন শর্ত ও অনিয়মের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেন একাধিক দরদাতা। পরে ওই দরপত্র বাতিল হয়ে যায়। এর আগে তিনবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও যোগ্য দরদাতা নির্বাচন করা যায়নি। এরই মধ্যে তিনবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আগামী জুনে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। গত পাঁচ বছরে প্রকল্পের মাত্র দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কাজের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতিও নেই। প্রকল্প পরিচালক বদল হয়েছেন পাঁচ জন।প্রকল্পের পরিচালক ডা. আ ন ম এহসানুল করিম ভোরের আকাশকে বলেন, আগের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। আগামী জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। জুনের মধ্যে কেনাকাটা করা সম্ভব হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও এক বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার বিষয়ে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায়) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, প্রকল্পটির দরপত্রের শর্তে কিছু ত্রুটি থাকায় এতদিন বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রত্যশা, দ্রুত সময়ে এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।কেনাকাটায় অনিয়ম, দুদকের হানা‘১৫টি মেডিকেল কলেজে ও ৪৪টি জেলায় ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন প্রকল্প’ -এর আওতায় ডায়ালাইসিস মেশিন ক্রয়ের দরপত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বদলি বাণিজ্যসহ নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয় থেকে গত মার্চ মাসে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করে। টিম প্রথমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস এন্ড ইউরোলজিতে (এনআইকেডিইউ) অবস্থিত প্রকল্প অফিস থেকে প্রয়োজনীয় নথিপত্র যাচাই করে। টিম জানতে পারে, ওই প্রকল্পের টেন্ডার মোট ৩ বার আহ্বান করা হয়। প্রথম টেন্ডারের ক্ষেত্রে টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি কোনো প্রতিবেদন দাখিল করেনি এবং সর্বশেষ টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির পরে মৌখিক নির্দেশনায় বাতিল করা হয়েছে।সার্বিক বিবেচনায়, অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের যোগসাজশে জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের টেন্ডার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে বলে দুদকের কাছে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়। কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে বারবার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করার কারণে টেন্ডার কার্যক্রমে বিলম্ব হচ্ছে বলে অভিযানকালে টিমের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে। টিম অভিযানকালে টেন্ডার সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে।জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল ভোরের আকাশকে বলেন, যন্ত্র কেনাকাটায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব নেই। তবে টাকা ভাগবাটোয়ারা নিয়ে জটিলতার কারণে এসব প্রকল্প আটকে যায়। এর জন্য দায়ী রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা। আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে দেওয়া হয় বিভিন্ন শর্ত। এতে অন্য যোগ্য কোম্পানিগুলো বাদ পড়ে। এখানে লাগে বিপত্তি। এতে বছরের পর বছর আটকে যায় প্রকল্পের কাজ। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোগীকে। দেশে মোট রোগীর মাত্র ২০ শতাংশ ডায়ালাইসিস করার সুযোগ পায়। ৪৪ জেলায় ডায়ালাইসিস সুবিধা নিশ্চিত হলে এই সেবার জন্য মানুষকে ঢাকামুখী হতে হতো না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের লোকজন জানে এই প্রকল্প কার কারণে আটকে রয়েছে। কমিশনখোর ব্যক্তিদের এই প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া জরুরি। অন্যথায় এ প্রকল্প কোনোদিন আলোর মুখ দেখবে না বলে মনে করেন তিনি।স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘কিডনি রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকার ১ হাজার ডায়ালাইসিস মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে যে হারে কিডনি রোগী বাড়ছে, তাতে হাজার যন্ত্র স্থাপনের পরেও সব রোগীর ডায়ালাইসিস দেওয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। দেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ নানা ধরনের কিডনি জটিলতায় ভুগছে। এই রোগীদের ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হলেও প্রায় ৭০ শতাংশই এই সেবা নিতে পারছে না। এই সংকট নিরসনে ডায়ালাইসিস মেশিন কেনার পাশাপাশি কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া সহজ করতে আইনি জটিলতা সংশোধন করছে সরকার। স্কুল পাঠ্যপুস্তকে কিডনি রোগ সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে।এছাড়া দেশে কতজন কিডনি রোগী আছে, তা জানতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কিডনি রোগী নিবন্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অভ কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিকে। এছাড়া কিডনি প্রতিস্থাপনে আইনি জটিলতা রয়েছে। এটি সংশোধন করা হচ্ছে। চাইলে এ বিষয়ে যে কেউ মতামত দিতে পারেন।’ভোরের আকাশ/এসএইচ
নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে না পেরে অকালে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার গাংগাইল ইউনিয়নের পংকরহাটি গ্রামের বাসিন্দা রাজু মিয়া। বেসরকারি হাসপাতালে সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিসের খরচ ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। দরিদ্র পরিবারের বেকার সন্তান রাজু মিয়ার পক্ষে এ টাকা ব্যয় করে ডায়ালাইসিস সেবা গ্রহণ করা সম্ভব নয়।সরকারি হাসপাতালে কম খরচে কিডনি ডায়ালাইসিস করানো যায়, এক প্রতিবেশির কাছে-এ খবর জানতে পেরে রাজু মিয়া রাজধানীর ন্যাশনাল কিডনি ইনস্টিটিউটি অব ইউরোলজিতে (নিকডু) কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা গ্রহণের ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছেন গত কয়েক দিন ধরে।গত বৃহস্পতিবার হাসপাতাল চত্বরে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথা হয়। রাজু মিয়া জানান, গত তিন দিন ধরে ঘুরেও ডায়ালাইসিসের কোনো সুরাহা করতে পারেননি। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, কিডনি ডায়ালাইসিসের অনেক সিরিয়াল জমে আছে। সিরিয়ালে থাকা রোগীরা মাসের পর মাস ধরে আবার কেউবা এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু সিরিয়াল মিলছে না। এ অবস্থায় গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার।রাজু মিয়ার সঙ্গে আলাপের সূত্র ধরে হাসপাতাল ঘুরে কিডনি ডায়ালাইসিস চিকিৎসার অবর্ণনীয় দুর্ভোগের চিত্র পাওয়া গেছে। কিডনি চিকিৎসার একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান রাজধানীর ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে ডায়ালাইসিসের জন্য আবেদনের স্তূপ জমেছে।হাসপাতালটিতে গতকাল পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের সুযোগ চেয়ে ৫ হাজার ৫৮০ জন আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে এক হাজার ১৭৬ সিরিয়াল পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের সুযোগ পেয়েছেন। অন্যরা এখনও অপেক্ষায়। সিরিয়াল দেওয়া রোগীর মধ্যে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তার হিসাব নেই কারও কাছে। কিডনি ইনস্টিটিউটে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ৬০টি মেশিনে ডায়ালাইসিস করে। সেগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ১১০ থেকে ১২০ জন রোগী পাওয়া যায়। মাত্র ৫১০ টাকায় ডায়ালাইসিস সুবিধার কারণে রোগীর ভিড় থাকে উপচে পড়া।আক্রান্তরা প্রভাবশালীদের সুপারিশ নিয়ে ডায়ালাইসিসের সিরিয়াল পেতে আবেদন করছেন। প্রতিদিন অন্তত অর্ধশত রোগী ডায়ালাইসিস করার সুযোগ চেয়ে ভিড় করলেও কর্তৃপক্ষ তাদের আবেদন নিতে পারছে না। দেড়শ’ শয্যার এ হাসপাতালে ভর্তি প্রার্থীর সংখ্যা কয়েক গুণ থাকে। আউটডোরেও গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী চিকিৎসা নেন। লজিস্টিক সাপোর্টের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যান্ডরের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে প্রতি ডায়ালাইসিসে স্যান্ডর পায় তিন হাজার টাকা। এর মধ্যে ৫৬০ টাকা দেয় রোগী, বাকিটা সরকার বহন করে। তবে পুরোনো রোগীদের সেবা দিতেই শেষ ডায়ালাইসিসের নির্ধারিত কোটা। তাই বাধ্য হয়ে অনেক রোগী বেসরকারিভাবে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় ডায়ালাইসিস নিচ্ছে।ডায়ালাইসিস যুদ্ধেই প্রাণক্ষয়কিডনি হাসপাতালে কথা হয় শরীয়তপুরের বাসিন্দা বিউটি আক্তার চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে এসেছেন। তার বাবা বাচ্চু মিয়ার দুইটি কিডনি বিকল হয়ে পড়েছিল। চিকিৎসক সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস নিতে বলেছিলেন। বেসরকারিভাবে চড়া দামে ডায়ালাইসিসের পেছনে টাকা খরচ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। সরকারিভাবে কিছুটা কম দরে ডায়ালাইসিস সেবা পেতে ২০২২ সালের ১৮ নভেম্বর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে (নিকডু) আবেদন করেন। তাতে সুপারিশ করেন তখনকার এক প্রভাবশালী এমপি। কিন্তু সিরিয়াল মেলেনি। ডায়ালাইসিস নিতে না পেরে তার বাবা বাচ্চু মিয়া ওই বছরের ২১ ডিসেম্বর মারা যায়। দু’টি কিডনিই বিকল হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার মধ্য সাদুল্যা ফকিরপাড়া গ্রামের মেধাবী শিক্ষার্থী লিমা আক্তারের(১৮)। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বাবা আব্দুল লতিফ। চিকিৎসার মাঝপথে টাকার অভাবে থমকে গেছে লিমার ডায়ালাইসিস চিকিৎসা। তার মাতা মাছুমা বেগম বলেন, মেয়েটা কিছু খায় না, সারাদিন কান্নাকাটি করে থাকে। পেটের ভেতর জ্বালাপোড়া করে। প্রতি সপ্তাহে দুইবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। খরচ পড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। আমরা গরিব মানুষ, ঠিকমতো খেতে পারি না। এতো টাকা কিভাবে জোগাড় করি। চিকিৎসার পেছনে ভিটেমাটি হারিয়ে পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে গেছে বলে জানান মাছুমা বেগম।লিমার বাবা আব্দুল লতিফ জানান, চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যেতে হয়। চিকিৎসা ব্যয়ের সঙ্গে যাতায়াত ও ঢাকায় থাকা-খাওয়ার পেছনেও অনেক টাকা লাগে বলে জানান আব্দুল লতিফ। প্রথমবার ডায়ালাইসিস শুরু হয়েছে ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার ধাইরপাড়া গ্রামের কিডনি বিকল রোগী সুফলা সাংমার। তার স্বামী পিপলু মানখিন বলেন, ঢাকায় চিকিৎসা করাতে এসে স্ত্রীর দু’টি কিডনিই বিকল ধরা পড়েছে। রাজধানীর জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতালে এক সপ্তাহে দু’বার ডায়ালাইসিস দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এই হাসপাতালের ছয় মাসের ডায়ালাইসিস প্যাকেজ পাওয়ার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু সুযোগ পাইনি। অসংখ্য আবেদন পড়ে আছে বলে জেনেছি। বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করানোর আর্থিক সামর্থ্য আমাদের নেই। জেলা পর্যায়ে নেই এই চিকিৎসাসুবিধা। ঢাকায় বাসা নিয়ে চিকিৎসা করাতে অনেক টাকার দরকার। নিয়মিত ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাওয়া নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি বলে জানান পিপলু মানখিন। এভাবে দেশে কিডনি বিকল রোগীরা ভুগছেন জীবনের অনিশ্চয়তায়। কিডনি প্রতিস্থাপন অথবা ডায়ালাইসিস- যে পদ্ধতিই খুঁজি না কেন, কিছু আটকে যাচ্ছে ব্যয়বহুল চিকিৎসার কাছে। ডায়ালাইসিস সেন্টারের সংকটের কারণে সারাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ রোগীকে রাজধানীমুখী হতে হয়। ফলে চিকিৎসার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের বড় অংশই যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার পেছনে খরচ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা বলছে, দেশে এখন কিডনি রোগী প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। একজন রোগীর নিয়মিত ডায়ালাইসিস সেবা নিতে মাসে গড়ে ৪৬ হাজার ৪২৬ টাকা খরচ হয়। ৯২ দশমিক ৮৭ শতাংশ পরিবারই এই খরচ চালাতে গিয়ে আর্থিক সমস্যায় পড়ে। সাড়ে ১৯ শতাংশ রোগী প্রয়োজনের চেয়ে কম ডায়ালাইসিস করান।ডায়ালাইসিস সেন্টার ও চিকিৎসা সংকট জেলা পর্যায়ে কিডনি রোগের চিকিৎসা নেই। দুই কোটির বেশি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হলেও দেশের বড় বড় হাসপাতালে এ রোগের জন্য নেই পৃথক কোনো ইউনিট। দেশে মাত্র ৮০ থেকে ৯০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। পুরোনো আটটি মেডিকেল কলেজের সবগুলোতে ডায়ালাইসিস সেন্টার নেই। নিকডু ছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, সোহরাওয়ার্দী, মুগদা, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা. সিলেট, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা এবং সিরাজগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু আছে।কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, দেশে কিডনি রোগীর মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ ডায়ালাইসিস করার সুযোগ পায়। অন্যরা অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। মাত্র ৯৬টি ডায়ালাইসিস সেন্টারে ১৮ হাজার রোগী সপ্তাহে সেবা পায়। ডায়ালাইসিস ব্যয় কমাতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।চিকিৎসা ব্যয় বহন করে প্রতিবছর দেশের ৫০ লাখ মানুষ গরিব হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম। তিনি বলেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ সুদের ওপর বা ধার করে টাকা নিয়ে চিকিৎসা করেন। পরে তাদেরকে টাকা শোধ করতে হয় নিজেদের জমি-জমা বিক্রি করতে হয়।উপাচার্য বলেন, দেশের জনসংখ্যা বিশাল। প্রচুর রোগী রয়েছে। তাই এখানে চাইলেই গবেষণা করা যায়। অনেক উন্নত দেশ আছে আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু রোগী কম। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্র আলাদা।বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বলেন, দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কিডনি রোগী। তবে চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে চিকিৎসা করাতে পারেন না। এ জন্য জেলা পর্যায়ে ডায়ালাইসিস ইউনিট করা গেলে কিডনি রোগীর চিকিৎসা খরচ কমানো যেত।নিকডুর পরিচালক ডা. সৈয়দ আলফাসানি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘হাসপাতালের লজিস্টিক সাপোর্ট অনুযায়ী ৫০ জন রোগীর মধ্যে মাত্র একজনের ডায়ালাইসিস এবং ৬০ জনে মাত্র একজন রোগী তারা ভর্তি করতে পারছেন। এতে বেশিরভাগ রোগীই চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। যন্ত্রপাতির পাশাপাশি শয্যাসংখ্যা না বাড়ালে রোগীর সেবা নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’ভোরের আকাশ/এসএইচ