বেগুনি আর লাল-হলুদের রাঙা ঝলক
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৫ ০৫:১৯ পিএম
চোখজুড়ানো শান্ত স্নিন্ধতা
দূর থেকে তাকালেই মনে হয়- পথজুড়ে ছড়িয়ে আছে রঙিন ফুলের ঢেউ। কোথাও সোনালি ঝলক, কোথাও আবার বেগুনির কোমল ছায়া। বাতাস এলেই দুলছে, ঝরছে। গাছে গাছে সবুজের চোখজুড়ানো শান্ত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। গ্রীষ্মের খরতাপেও এখানে হেঁটে গেলে গরমটা যেন আর গায়ে লাগে না।
সোমবার মৌলভীবাজারের একটি প্রান্ত, কমলগঞ্জের আদমপুর বাজার থেকে শুরু হয়ে কোনাগাঁও গ্রামের দিকে কজন এগিয়ে চলছি। সঙ্গে গ্রামে গ্রামে চারণের মতো ঘুরে বেড়ানো সংগঠক ও লোকগবেষক আহমদ সিরাজ, কমলগঞ্জ উপজেলা মধুচাষি উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি আলতাফ মাহমুদ ও মধুচাষি মঙ্গল মিয়া। দীর্ঘ এই সড়ক এখন ফুলের ‘অরণ্য’। সোনালু, জারুল, কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, কাঞ্চনের মিলনমেলা। সড়কের দুই পাশে শুধু বাড়িই নয়, খোলা মাঠও আছে। এসব মাঠে এখন পাকা, আধা পাকা বোরো ফসল আহ্লাদে ঢুলুঢুলু করছে। এখন মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হয়, তাই পাতারা আরও সবুজ হয়ে উঠছে। এখানে প্রতিদিন পথিকের মন ভরিয়ে দিচ্ছে।
সেদিন ‘পাহাড়ে মুক্তোর বাড়ি’ও রকম পাহাড়ঘেঁষা একটি বাড়ি থেকে ফেরার পথে কোনাগাঁওয়ে একটি বাড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়াতে হয়। ওখানে বাড়ির প্রবেশপথে, ফটকের কাছে একটি লাল সোনাইলগাছ ফুলে ফুলে রঙের হাট খুলে বসেছে। সবুজ গ্রামের ভেতর অমন মন উচাটন করা ফুল সচরাচর চোখে পড়ে না। ওখানে গ্রামের ভেতর জারুল, কৃষ্ণচূড়া কিংবা অন্য কোনো বুনোফুল যতটা দেখা যায়, লাল সোনাইলের অতটা দেখা মেলে না। গ্রামের ভেতরে অনেকের কাছে ফুলটি এখনো অচেনা। ওখানে বাড়িটিকে আলাদা করেছে ওই লাল সোনাইল।
বাড়ির মালিক জেনেশুনেই হয়তো গাছটিকে পথের পাশে, ফটকের কাছে লাগিয়েছিলেন। এখন ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে গাছ। কিছুটা লম্বাটে, সবুজ পাতা ছাপিয়ে গোলাপি রঙের এই ফুল বাতাসকে সঙ্গে করে হেলেদুলে এখন সময় কাটায়। শহরে মাঝেমধ্যে কারও বাসাবাড়ির আঙিনায়, কারও বাড়ির পথের পাশে একা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় দু-একটা লাল সোনাইল। বাতাস এলে পাপড়ি খসে পড়ে, পথকে রঙিন করে। ফুলগুলো এমনই, এই ফুলে চোখ রাখতে হয় পথচারীকে।
কমলগঞ্জ-কুরমা সড়ক ধরে যাওয়ার পথে মধ্যভাগে আরও কিছু গাছের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে একটি সোনালি-হলুদ রঙের সোনালুগাছ। গাছটির শাখাপ্রশাখাজুড়ে সোনার মতো রঙের ফুল অসংখ্য ঝুমকা হয়ে ঝুলে আছে। গাছের পাতারা ম্লান হয়ে আছে ফুলের কাছে। বিকেলের রোদে ফুলগুলো আরও উজ্জ্বল, আরও ঝকঝকে, আরও রঙিন।
এই সড়কের ইসলামপুর এলাকায় এক স্থানে লাল হয়ে আছে একটি কৃষ্ণচূড়ার গাছ। গাছটিতে যেন আগুন লেগেছে শূন্যের ওপর। ওড়নার মতো উড়ছে সেই থোকা থোকা আগুন, আগুনের লকলকে শিখা। বৈশাখের শেষ বেলার রোদে আরও জ্বলজ্বলে হয়ে আছে কৃষ্ণচূড়ার ফুল। অনেক দূর থেকেই অন্য সব গাছ ছাপিয়ে সেই তাকেই আগে চোখে পড়ে। গাছটি শুধু ওখানেই নয়, আরও অনেক জায়গাতেই এখন ‘পুষ্পপাগল কৃষ্ণচূড়ার শাখা’ দুলছে। সবুজের বুকে অমন অসহ্য সুন্দর লালে চোখজোড়া আটকে যায়। কমলগঞ্জের কোনাগাঁও, মধ্যভাগসহ আরও কিছু স্থানে ও রকমই কয়েকটি কৃষ্ণচূড়াগাছ আছে।
কমলগঞ্জ-কুরমা সড়ক ধরে আসা-যাওয়ার পথে শুধু কৃষ্ণচূড়াই নয়, হঠাৎ বেগুনি রঙের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কোনো বাড়ির দিকে ঝোপের ভেতর, বাঁশবনের কাছে, খেতের পাশে একটা–দুটো জারুলগাছ। জলার্দ্র নরম বেগুনি ফুলে কী যে মায়া! বাতাস এলে একবার ওদিকে ফুলগুলো কাত হয়, একবার ওদিকে ঢলে পড়ে। সড়কের ইসলামপুর এলাকায় এ রকমই একটি গাছ আছে। গাছটিতে ঝেঁপে ফুল এসেছে।
গাছটির শাখাগুলোজুড়ে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ অবস্থা। পথের অনেকটা দূর থেকেই গাছটি চোখে পড়ে। হয়তো গ্রাম এখন এ রকমই, কোথাও না কোথাও ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া, কোথাও জারুল। এক-দুটো সোনালু, হয়তো লাল সোনাইল নীরবে ফুটেছে কোথাও। এখানে সবাই কত কিছু ভুলে যায়, তবু গাছগুলো সময় হলে ফুলে-ফলে জেগে ওঠে, রাঙা হয়ে ওঠে। এখনো গাছে গাছে বাংলার ঋতুকে কিছুটা কেন, অনেকটাই বোঝা যায়।
ভোরের আকাশ/এসআই