শহীদুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫ ১২:২৯ এএম
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্র্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের দাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমলে নিলেও তার সমাধান করছে না বলে মনে করছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নারী শিক্ষার্থীদের ভোটার তালিকায় ছবি প্রকাশকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেছেন ছাত্রীরা। অন্যদিকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে ডাকসুর এক ভিপি প্রার্থীসহ দুজনের প্রার্থিতা বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এর আগে কয়েকজন প্রার্থী সিজারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের গুরুতর অভিযোগ তুলে তার প্রার্থিতা বাতিলের দাবি জানায়। সব মিলে ভোটের আগেই ডাকসু নির্বাচনের উত্তাপ ছড়ানো শুরু হয়েছে। গতকাল রোববার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী ছবি প্রকাশের বিরুদ্ধে রিট দায়ের করেন।
এছাড়া একই দিনে ঢাবি ট্রাইবুন্যাল কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ছাত্রলীগ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ভিপি পদপ্রার্থী হিসেবে লড়তে যাওয়া নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মো. জুলিয়াস সিজার তালুকদার ও বায়েজিদ বোস্তামী নামের আরো একজনকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইবুন্যাল কমিটির সুপারিশ বলছে, অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. জুলিয়াস সিজার তালুকদার ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী বায়েজিদ বোস্তামী সন্ত্রাসের দায়ে নিষিদ্ধ সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেও জড়িত ছিল। অনুরূপ ব্যক্তিদের নাম ভোটার তালিকা থেকে ইতঃপূর্বে বাদ দেওয়া হয়েছে বিধায় এই দুই শিক্ষার্থীদের নামও ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। ফলশ্রুতিতে মো. জুলিয়াস সিজার তালুকদার ও বায়েজিদ বোস্তামীর প্রার্থিতাও বাতিল করার জন্য সুপারিশ করা হলো।
সুপারিশ আরো বলা হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান জিলানী ও মো. খায়রুল আলমের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী কর্তৃক আনিত অভিযোগে যথাযথ প্রমাণাদি না থাকায় এবং অভিযোগপত্রে অভিযোগকারীর স্বাক্ষর না থাকায় কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে যথাযথ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিবেন।
ডাকসু নির্বাচনের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর বাতিলকৃত প্রার্থীদের আপিল নিষ্পত্তি ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগসমূহ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইবুন্যাল কমিটির সভার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাছাড়া তাদের নাম ভোটার তালিকা থেকেও বাদ দেয়া যেতে পারে পরে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিষয়টি নিয়ে ডাকসু নির্বাচনের চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন বলেন, এটি উচ্চতর কমিটি। এই কমিটির সুপারিশ আমরা মানতে বাধ্য। ফলে পূর্ণ কমিশন বসে এই দুইজনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ডাকসু নির্বাচনে নারী শিক্ষার্থীর ছবি প্রকাশে বিতর্ক, হাইকোর্টে রিট: ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভোটার তালিকায় থাকা নারী শিক্ষার্থীদের ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য সীমিত আকারে প্রদর্শনের নির্দেশনা রিট দায়ের করা হয়েছে।
রোববার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী এ রিট দায়ের করেন। রিটকারীরা হলেন- সাবিকুন্নাহার তামান্না, মো. জাকারিয়া, ফাতেমা, তাসনিম ঝুমা ও রেদোয়ান মন্ডল রিফাত। তাদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফয়জুল্লাহ ফয়েজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তাকে রিটে বিবাদী করা হয়েছে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটার তালিকায় প্রকাশিত নারী শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ছবি অপসারণ চেয়ে ভিসি বরাবর চিঠি দেন শিক্ষার্থীরা।
চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটার তালিকায় নারী শিক্ষার্থীদের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার গুরুতর লঙ্ঘন। ছবি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য, যা শিক্ষার্থীর অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে অনেক শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে মানসিক অস্বস্তি ও বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে ধর্মপ্রাণ নিকাবি শিক্ষার্থীদের জন্য এটি ছিল অত্যন্ত বিব্রতকর ও বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা এই সংবেদনশীল তথ্যগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রশাসনের নজরে আসেনি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এজন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
অতএব, আমাদের বিনীত অনুরোধ
১. দ্রুততম সময়ে নারী শিক্ষার্থীদের ছবি সম্বলিত ভোটার তালিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হোক।
২. ভবিষ্যতে এ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ না করে বিকল্প হিসেবে শিক্ষার্থী পরিষেবার মতো রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করে তথ্য দেখার একটি নিরাপদ ব্যবস্থা চালু করা হোক। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, উপাচার্য মহোদয় দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এরপরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় রিট দায়ের করা হয় বলে রিটকারীরা জানান।
ছাত্রদল ভিপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ : এদিকে ছাত্রদলের প্যানেলের ভিপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ জানিয়েছে ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত ভিপি প্রার্থী বিন ইয়ামিন মোল্লা ও ছাত্রশিবির সমর্থিত জিএস প্রার্থী এসএম ফরহাদ।
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের উদ্দেশে বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, তাদের প্রার্থীরা রিডিংরুমে গেলেও নির্বাচনী আচরণ বিধিমালার মধ্যে পড়ছে না। তারা স্লোগান দিয়ে মিছিল নিয়ে গেলেও নির্বাচনী আচরণ বিধিমালার মধ্যে পড়ছে না। টিএসসিতে তাদের দলীয় ব্যানার-ফেস্টুন আছে। সেটি কী শিক্ষার্থীদের নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে না? কিন্তু আমি যদি দলীয় ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো শুরু করি, তখন বলবে নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা ভঙ্গ করছে। আমার ক্ষেত্রে নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা ভঙ্গ হয়, আর তাদের ক্ষেত্রে নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা ভঙ্গ হয় না?
এসএম ফরহাদ বলেন, নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত আমাদের পক্ষ থেকে দেওয়া কনসার্নগুলো আমলে নিচ্ছেন না। আমরা দেখছি প্রার্থীদের কেউ কেউ রিডিংরুমে গিয়েও প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করছেন। এর ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও অন্যান্য কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করবো, কেউ যদি নীতিমালা ভঙ্গ করলে তাদের প্রতি যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ডাকসু নির্বাচনের চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন এক ব্রিফিংয়ে বলেন, অমর একুশে হলের এমন একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। আমরা নির্বাচন কমিশন বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।
এর আগে শনিবার বিকেলে নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় বিধিমালা লঙ্ঘনের বিষয়ে সাংবাদিকদের অভিযোগ করেছেন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের মনোনীত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার। তিনি বলেছেন, ডাকসুতে ছাত্রদল মনোনীত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম ডাকসু নির্বাচনের একের পর এক বিধিমালা লঙ্ঘন করলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন।
‘সম্মিলিত ছাত্র ঐক্য’ নামে ডাকসু প্যানেল ঘোষণা : কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ‘সম্মিলিত ছাত্র ঐক্য’ নামে ৩ জনের একটি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে। প্যানেলে ভিপি, জিএস ও সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তারা। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল প্রস্তুত করছে বলে জানা যায়। রোববার বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্যানেল ঘোষণা করা হয়।
সম্মিলিত ছাত্র ঐক্য প্যানেলের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সংসদে ভিপি পদপ্রার্থী হচ্ছেন জান্নাতি বুলবুল, জিএস পদপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান (সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম) এবং কার্যনির্বাহী সদস্য পদপ্রার্থী তালহা নেগাবান।
ভিপি প্রার্থী জান্নাতি বুলবুল বলেন, আগামী ২৬ আগস্ট মনোনয়ন চূড়ান্ত হবার পর আমরা পূর্ণাঙ্গ প্যানেল আপনাদের সামনে উপস্থাপন করব। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ডাকসু কেন্দ্রীয় সংসদে যারা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন তাদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সম্মিলিত ছাত্র ঐক্য পূর্ণাঙ্গ প্যানেল প্রস্তুত করছে। আমরা মনে করি, সংখ্যার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল কমিটমেন্ট এবং বিশ্বাস।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সর্বোপরি দেশের প্রতি আমরা যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছি, তার প্রতিটি শব্দ এবং তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আমরা বিশ্বাস করি। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৩ সালে ৩ জন মিলে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপন করেছিল যাদের নেতৃত্বে পরবর্তীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল, পল্টন ময়দানে পাঠ করা হয়েছিল স্বাধীনতার ইশতেহার।
২০২৪ এর ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর হাত ধরেই যা পরবর্তীতে এই অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ডাকসুর হল সংসদে ভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জয় নিশ্চিত ছাত্রদলের প্রার্থীসহ দুইজনের। এর মধ্যে রেহেনা আক্তার বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল থেকে বহিরাঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন। আর লামিয়া আক্তার লিমা শামসুন নাহার হলের বহিরাঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক পদের প্রার্থী।
জানা গেছে, হল সংসদে ছাত্রদল বাদে অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন প্যানেল দেয়নি। এর মধ্যে সংগঠনটির প্যানেল থেকে লামিয়া আক্তার লিমা শামসুন নাহার হলের বহিরাঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক পদের প্রার্থী হয়েছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম বলেন, লামিয়া ছাত্রদলের প্যানেল থেকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন। আর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল থেকে নির্বাচিত হতে যাওয়া রেহেনা আক্তার বাগছাসের সমর্থক বলে জানতে পেরেছি। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, প্রার্থিতা বাতিল, হাইকোর্টে রিট- সব মিলে দারুণ জমে উঠেছে এবারের ডাকসু নির্বাচন। তবে সবকিছুই চলছে সুন্দর পরিবেশে। যার যার কথা স্বাধীনভাবে বলছেন সকলেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ডাকসু নির্বাচন সবাইকে স্বাধীন মতপ্রকাশের চর্চা করা শেখাচ্ছে। যদিও ডাকসু নির্বাচন রয়েছে উত্তাপ, উত্তেজনা। তবে সেটা গ্রহণযোগ্য।
ভোরের আকাশ/এসএইচ