নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫ ১২:৫৮ এএম
ফাইল ছবি
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের তীব্র চাপে অনেক দেশ। কয়েকটি মোড়ল দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ইতোমধ্যে অঘোষিত বাণিজ্যযুদ্ধের পদধ্বনিও শোনা যাচ্ছে। কিছুটা অস্বস্তিতে থাকলেও ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য মহাবিপদ অনেকটা আশীর্বাদ ও সুযোগে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি ‘পোশাক রপ্তানি আদেশ’ বাড়তে শুরু করেছে। গার্মেন্টস পণ্যে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রথম সারির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও চীন উচ্চশুল্কে আক্রান্ত।
২০ শতাংশ শুল্কারোপ নিয়ে একই অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের আরেক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। তবে শ্রমিকের সহজলভ্যতা ও কম মজুরির বিবেচনায় পিছিয়ে পড়েছে ভিয়েতনামও। ফলে ওই সব প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পোশাক রপ্তানি আদেশ’ নানাভাবে বাংলাদেশে স্থানান্তর শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের কারখানা গুলোয় তৈরি পোশাকের বাড়তি ক্রয়াদেশ দিতে দরকষাকষি করছে অনেক মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। ভারত ও চীনে উচ্চশুল্কের কারণে সেখান থেকে রপ্তানি আদেশ সরিয়ে আনতে চায় অনেক
মার্কিন ব্যবসায়ী।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানিতে একক বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই বাজারে শীর্ষ ১০ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে ভিয়েতনাম, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও কোরিয়া।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৩১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে পাল্টা শুল্ক সংশোধন করে ২০ শতাংশ করেন। তার বিপরীতে চীনা পণ্যে এখন শুল্ক ৩০ শতাংশ। তবে ভারতের পণ্যে শুল্কের হার ২৫ শতাংশ, যা প্রতিযোগী দেশের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার জ্বালানি কেনার ‘অপরাধে’ ভারতের পণ্যে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। ২৭ আগস্ট ভারতের বাড়তি ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে। যদিও সব দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যে শুরুতে যে হারে বাড়তি শুল্ক বসানোর কথা ছিল, তা বাংলাদেশের জন্য মহাবিপদস্বরূপ ছিল। কারণ ওই বাড়তি শুল্কের কারণে অনেকের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। কিন্তু ওই শুল্ক এখন ২০ শতাংশে নেমে আসার ফলে ‘মহাবিপদ সুযোগে পরিণত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানের জন্য শুল্ক হার ১৯ শতাংশ হলেও ‘এক শতাংশের সুবিধা পাওয়ার জন্য বায়াররা পাকিস্তানে যাবে না। কারণ পাকিস্তানের সেই সরবরাহ ক্যাপাসিটি নেই। পোশাক শিল্প প্রমাণিত শিল্প। এই এক শতাংশের জন্য বাংলাদেশের মতো নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী বাদ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানের কাছে যাবে বলে মনে হয় না।’
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ভারতের জন্য ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের পর থেকে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ তৈরি হয়। এখন এটি আরও ২৫ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যা কার্যকর হলে আরও বেশি সুযোগ তৈরি হবে। কারণ বাড়তি ৫০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ভারত থেকে ক্রেতারা পণ্য কিনবে না। একই সঙ্গে বাড়তি শুল্ক ও অন্যান্য কারণে চীন থেকেও রপ্তানি কমে যাবে।
তিনি আরও বলেন, দুই বড় দেশের রপ্তানি কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সরবরাহের ঘাটতি পূরণ করার ক্ষমতা বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম ছাড়া আর কারও নেই। ফলে বাংলাদেশের সামনে রপ্তানি বাড়ানোর বড় ধরনের সুযোগ আছে। তবে সেই সুযোগ নিতে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ দরকার। কিন্তু বেশকিছু দিন থেকে জ্বালানি পরিস্থিতি ভালো নয়। একই সঙ্গে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতের নানা সমস্যা, কাস্টমসের বহুমুখী হয়রানি বন্ধ না হলে এ সুযোগ নেওয়া সম্ভব হবে না। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি অর্ডার ও বিনিয়োগ আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সহসভাপতি এনামুল হক বাবলু বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতীয় পণ্যে নতুন করে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ বাংলাদেশকে অবশ্যই বাড়তি সুবিধা দেবে। কারণ তাদের মোট শুল্কহার দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৬৬ শতাংশ। এ হারে শুল্কের কারণে কঠিন প্রতিযোগিতায় পড়বে ভারত। ইতোমধ্যে ভারতে রপ্তানি আদেশ দেওয়া অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএর সদস্য বিভিন্ন কারখানায় খোঁজখবর নিচ্ছে।
বেড়েছে পোশাক রপ্তানি আদেশ : দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন রপ্তানি আদেশ ধরে রাখার কৌশল হিসেবে ভারতের বড় রপ্তানিকারকেরা তৈরি পোশাক উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এছাড়া চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। গত দুই সপ্তাহে দুটি চীনা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে চুক্তিও সম্পাদন করেছে।
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, গত দুই সপ্তাহে মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি রপ্তানি আদেশের অনুসন্ধান আসছে। আগের স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশও ফিরতে শুরু করেছে। তবে যারা দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন ক্রেতাদের কাজ করছে, তাদের কাছেই এখন বেশি অনুসন্ধান আসছে। তার একটি বড় অংশ ভারত থেকে স্থানান্তরিত ক্রয়াদেশ। দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে স্নোটেক্স গ্রুপ। বিদায়ী অর্থবছরে ৩০ কোটি ডলারের কাছাকাছি তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গেছে ২৮ শতাংশ পোশাক। ইতোমধ্যে তারা কয়েকটি মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়তি ক্রয়াদেশের অনুসন্ধান পেয়েছে।
জানতে চাইলে স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএম খালেদ বলেন, ‘আমাদের কারখানায় গত বছর একটি মার্কিন ক্রেতার জ্যাকেটের কাজ হয়েছে ৭ লাইনে। তারা বাড়তি যে ক্রয়াদেশ দিতে চাচ্ছে, তাতে মোট ১৭ লাইন লাগবে। আবার আরেকটি মার্কিন ক্রেতার জন্য গত বছর ২০টি লাইনে পণ্য উৎপাদন করেছি। তারা বাড়তি ১০ থেকে ১৫ লাইনের পণ্য উৎপাদনের ক্রয়াদেশ দিতে চাচ্ছে। এসব ক্রয়াদেশ মূলত চীন ও ভিয়েতনাম থেকে সরিয়ে আনতে চাচ্ছে ক্রেতারা।’
এসএম খালেদ আরও বলেন, ‘বাড়তি ক্রয়াদেশের কাজ করতে আমাদের আড়াই লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ লাগবে। আমাদের প্রত্যাশা, সবকিছু অনুকূলে থাকলে চলতি অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি ৩৫ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।’
এদিকে, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৬ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। গত অর্থবছর রপ্তানি হয়েছে ৭৫৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক।
আরেক শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম বলেন, ভারত থেকে ক্রয়াদেশ সরিয়ে আনতে একাধিক মার্কিন ক্রেতার সঙ্গে আলোচনা চলছে। শুধু তাই নয়, পরবর্তী বছরের গ্রীষ্মে ভিয়েতনাম থেকে ক্রয়াদেশ সরিয়ে আনতে একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তার কারণ, ওই ক্রেতা চীন থেকে উচ্চমূল্যের তৈরি পোশাক ভিয়েতনামে সরাচ্ছে। আর ভিয়েতনাম থেকে মাঝারি মূল্যের তৈরি পোশাক সরিয়ে আনছে বাংলাদেশে।
এক প্রশ্নের জবাবে শোভন ইসলাম বলেন, ‘আগামী বসন্তের জন্য আমাদের কাছে ৫-১০ শতাংশ বাড়তি ক্রয়াদেশ রয়েছে। আর গ্রীষ্মের জন্য ১০-১৫ শতাংশ বাড়তি ক্রয়াদেশ আছে। এ জন্য আমরা ক্রেতাদের কাছ থেকে ২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৩ ঘণ্টার ওভারটাইম করানোর অনুমতি নিয়েছি। ভারত ও চীন থেকে সরে আসা ব্যবসা ধরে রাখতে সরকারের কাছ থেকে সহায়তা লাগবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।’
চীনা কোম্পানি হান্ডা (বাংলাদেশ) গার্মেন্টস কোম্পানি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনের জন্য প্রায় চার কোটি ডলারের বিনিয়োগ করবে। এ জন্য ৩০ জুলাই বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) সঙ্গে জমি ইজার চুক্তি করেছে হান্ডা।
এ ছাড়া চীনের তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান খাইশি গ্রুপ চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করবে। প্রতিষ্ঠানটি চার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে অন্তর্বাসসহ অন্যান্য পোশাক উৎপাদনের কারখানা করবে। এ জন্য গত বুধবার বেপজার সঙ্গে চুক্তি করেছে খাইশি গ্রুপ।
জানা যায়, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩৪টি চীনা বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে বেপজা। গত জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আটটি চীনা প্রতিষ্ঠান শিল্প স্থাপনের লক্ষ্যে বেপজার সঙ্গে চুক্তি করেছে। তাদের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ১৫ কোটি ডলার। এসব কোম্পানি তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ব্যাগ, হালকা প্রকৌশল পণ্য ইত্যাদি উৎপাদন করবে।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘চীনা বিনিয়োগ আসা খুবই ইতিবাচক। কারণ, তারা বিনিয়োগ করার পাশাপাশি ক্রেতাও নিয়ে আসবে। তাতে আমাদের রপ্তানি বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, প্রতিযোগী দেশের তুলনায় শুল্ক কম হওয়ায় আমরা সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছি। তবে বাড়তি ক্রয়াদেশ নিতে হলে ব্যাংকের সহযোগিতা, চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ ও কাস্টমসের সহযোগিতা লাগবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন জানান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই চীনের ক্রয়াদেশ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। এরপর গত বছর নির্বাচনী প্রচারণার সময় চীনের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বহু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বাড়তি ক্রয়াদেশ দিতে শুরু করে, যার ফলে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এ প্রসঙ্গে আরশাদ আলী বলেন, ‘সেপ্টেম্বর থেকে আগামী গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করবে। তখন বোঝা যাবে কতটা বাড়তি অর্ডার এসেছে। তবে আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছি। মার্কিন ক্রেতাদের পাশাপাশি ইউরোপীয় ক্রেতাদের অর্ডারও বৃদ্ধি পাবে। কারণ ইউরোপের অনেক ক্রেতার ১০-১৫ শতাংশ ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের সঙ্গে যুক্ত।’
ভোরের আকাশ/এসএইচ