নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৫ ০৯:০১ এএম
সংগৃহীত ছবি
দফায় দফায় আলোচনার পর মার্কিন শুল্কারোপ ৩৫ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে বাংলাদেশ। এটাকে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয় ও ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসহ অনেকে। আর পাল্টা শুল্ক কমিয়ে আনা আশাব্যঞ্জক, তবে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশি পণ্যে মার্কিন শুল্কের পরিমাণ পুরনো ১৫ শতাংশের সঙ্গে নতুন ২০ শতাংশ যুক্ত হয়ে মোট ৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বাড়তে পারে, যার প্রভাব বিক্রিতে পড়তে পারে। পাল্টা শুল্ক ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের নতুন করে বাজার কৌশল বিবেচনা করা জরুরি হয়ে পড়বে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশে নতুন এ হার ঘোষণা করা হয়। সবশেষ বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কের কথা জানিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। সে হিসাবে শুল্ক ১৫ শতাংশ কমিয়ে নতুন হার ঘোষণায় করা হয়েছে। ট্রাম্পের ওই নির্বাহী আদেশ হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
গত ২ এপ্রিল বাণিজ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। পরে ৯ এপ্রিল বিভিন্ন দেশের ওপর ওই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। এ সময় শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশকে আলোচনার সুযোগ দেয় ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের তিন মাসের সময়সীমা গত ৯ জুলাই শেষ হয়। এর আগের দিন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে ট্রাম্প জানান, বাংলাদেশের পাল্টা শুল্ক ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও ৯ জুলাইয়ের পর পাল্টা শুল্ক কার্যকর করেনি মার্কিন প্রশাসন। শুল্কের হার কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির জন্য ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন দেশকে সময় দেওয়া হয়।
বাংলাদেশকে বর্তমানের গড় ১৫ শতাংশ ও নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ, অর্থাৎ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। ৭ আগস্ট থেকে সব দেশে নতুন এই শুল্ক কার্যকর হবে বলে নতুন ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছে। শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে টানা তিনদিন আলোচনা করেন প্রতিনিধিদলের সদস্য।
গত মঙ্গল ও বুধবারের পর গত বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের মতো আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এছাড়াও দলে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
কিছুটা হ্রাস পেলেও নতুন ও পুরনো মার্কিন শুল্ক যুক্ত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর ‘ত্রিমুখী চাপ’ তৈরি করেছে। একদিকে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সমস্যা, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ জ্বালানি সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া- এই দুই সংকটের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক। এই তিন সংকটের মিলিত প্রভাবে শুধু ২০২৫ সালেই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি অনেক কমে যেতে পারে। দেশের মোট রপ্তানির ৮১ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তাই এই ক্ষতি পুরো অর্থনীতির জন্য একটি বড় আঘাত।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে এখন আমাদের শুল্কহার প্রায় সমান অথবা কিছুটা কম- এটি আমাদের জন্য স্বস্তির খবর। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বায়ারদের (ক্রেতা) এখন আগের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা এবং স্থানীয় ভোক্তাদের ভোগব্যয় কমে যেতে পারে। ফলে প্রাথমিকভাবে আমাদের রপ্তানিতে কিছুটা ধাক্কা লাগতে পারে এবং মূল্য নিয়ে চাপ তৈরি হতে পারে।
তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম রপ্তানিকারক সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “এটা কিছুটা স্বস্তির। আমাদের শুল্ক বৃদ্ধির হার ভারতের চেয়ে কম। তবে সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বাড়তে পারে, যার প্রভাব বিক্রিতে পড়তে পারে।”
পাল্টা শুল্ক কমিয়ে আনা আশাব্যঞ্জক, তবে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের হারের এ হ্রাস আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই বা জায়গা তৈরি করে না; বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে একটি সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্য কৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।
তিনি বলেন, এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যে ওপর পাল্টা শুল্কের নতুন হার এখন প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা বাণিজ্যবিচ্যুতির ঝুঁকি হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানিতে বড় ধরনের বিঘ্নের ঝুঁকি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে।
সেলিম রায়হান বলেন, অবশ্য বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে, যেহেতু চীনের ওপর পাল্টা শুল্কের হার এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বৈশ্বিক উৎপাদন ব্যবস্থায় চীনের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতামূলক মিল থাকায় যুক্তরাষ্ট্র চীনের জন্য কী হার নির্ধারণ করে, সেটি ভবিষ্যতের বৈশ্বিক বাণিজ্যপ্রবাহ গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
যদি চীনের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রপ্তানিকারক দেশগুলোর অনুকূলে চাহিদার সঞ্চালন ঘটতে পারে। অন্যদিকে যদি চীন অপেক্ষাকৃত অনুকূল হারে সুবিধা পায়, তাহলে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হতে পারে। সুতরাং চীনের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক বাণিজ্য গতি-প্রকৃতি পুনঃসংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি কৌশলগত অগ্রাধিকার স্পষ্টভাবে উঠে আসে। প্রথমত, বাংলাদেশকে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য ও নতুন বাজারে প্রবেশের প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে। একটি সংকীর্ণ পণ্যভিত্তিক ও কিছু নির্দিষ্ট গন্তব্যনির্ভর রপ্তানিকাঠামো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিনির্ভরতা, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেছেন, আমরা আমাদের শুল্ককে এই অঞ্চল এবং প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে পেরেছি, যা একটি ভালো দিক। তবে কিছু কিছু শিল্পের জন্য এই শুল্ক স্বস্তিদায়ক হলেও আমদানির যন্ত্রাংশ বা ট্রানজিট চালানের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আমাদের ব্যবসায়িক মডেলকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করবে।
তিনি বলেন, যদি আমরা চীন বা ভারতের কাপড় বা সুতা ব্যবহার করে তৈরি পোশাক রপ্তানি করি, তবে আমাদের শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ