উত্তরাঞ্চলের ১০ জেলায় বন্যা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৫ ০৬:১১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
দেশের ১২ জেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা জানিয়ে পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। বেশ কয়েকটি জেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চলে ইতোমধ্যে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি ও উজানের ঢলে দেশের নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। বিশেষ করে তিস্তা, পদ্মা ও যমুনার পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার কাছাকাছি বা এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কয়েকটি জেলায় ডুবে গেছে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ও চরাঞ্চল। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। ঘরের ভেতরে পানি ঢোকায় দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ। শনিবার ‘দৈনিক ভোরের আকাশ’ এর নিজস্ব প্রতিবেদকদের পাঠানো তথ্যে দেশের বন্যা পরিস্থিতির এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।
গত বৃহস্পতিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, পাবনা, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকার নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এদিকে শনিবার পাবনা, রাজশাহী, নওগাঁও, সিরাজগঞ্জ, চাপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, নাটোর, লালমনিহাটসহ পদ্মা ও যমুনাবেষ্টিত অঞ্চলে বন্যা শুরু হয়ে গেছে।
পাবনায় ডুবেছে দেড় হাজার বিঘার সবজিক্ষেত
নিজস্ব প্রতিবেদক, পাবনা থেকে জানায়, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পাবনায় পদ্মার পানি বেড়েই চলেছে। এতে তলিয়ে গেছে তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ জমির ফসল। নষ্ট হয়েছে দেড় হাজার বিঘা জমির সবজি ও কলাক্ষেত। এদিকে বাজারে সরবরাহ কমায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সবজির দাম।
সরেজমিন দেখা গেছে, পাবনার হার্ডিঞ্জব্রিজ পয়েন্টে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই পদ্মার পানি। উজান থেকে প্রচণ্ড বেগে আসা তীব্র জলস্রোতে দুশ্চিন্তা বাড়ছে নদী পাড়ের মানুষের। পানি উন্নয়ন বোর্ড এর হিসেবে গত কয়েকদিনে প্রতিদিন পদ্মায় পানির উচ্চতা বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। পানির উচ্চতা আর ১ মিটার বাড়লেই তা ছাড়াবে বিপৎসীমা।
পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সদর উপজেলার চরাতারাপুর, ভাঁড়ারা, দোগাছি, হেমায়েতপুর, গয়েশপুর, দাপুনিয়া, আতাইকুলা, সুজানগরের ভায়না, সাতবাড়িয়া ও ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডাসহ আরও বেশকিছু এলাকার পদ্মার চরের ও অন্যান্য নিচু জমি পানিতে ডুবে গেছে।
এসব এলাকার জমিতে ব্যাপকহারে মরিচ, কলা, কুমড়া, লাউকুমড়া, চিচিঙ্গা, ঝিঙে, ধুন্দল, কড়লা, মিষ্টিকুমড়া ও মূলাসহ বিভিন্ন সবজির আবাদ হয়েছিলো। তবে গত ৩ থেকে ৪ দিনে এসব জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাজারে সবজির সরবরাহ কমেছে। এতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে অধিকাংশ সবজির দর বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
এ ব্যাপারে চর প্রতাপপুর গ্রামের কৃষক সানাউল্লাহ বলেন, পদ্মার চরে আমার ২৬০ বিঘা কলার জমি এখন পানির নিচে। অধিকাংশ জমিতে পানি কলা গাছের ওপরের অংশ অবধি উঠে গেছে। ২১ বিঘা জমিতে বিভিন্ন সবজির আবাদ করেছি। ৫ বিঘা মূলাসহ পানিতে ডুবে ১২ বিঘা জমির সব কিছু। লাখ লাখ টাকা লোন নিয়ে জমিতে চাষ করেছি। এই লোন কীভাবে শোধ করবো?
লক্ষ্মীকুন্ডার কৃষক হোসেন মালিথা বলেন, যার ৩০ বিঘা আবাদ আছে তার ২০, যার ২০ বিঘা তার ১৫ বিঘা সবজির জমিই পানি নিচে। আগাম জাতের সবজি করে কিছুটা লাভের মুখ দেখার আশা করছিলাম। এক বিঘা মূলা আবাদে ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ, বেচা বিক্রি ৭০-৮০ হাজার টাকা হবার কথা। সবজির অন্যান্য ৫ বিঘা থেকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা আয়ের কথা ছিল। কিন্তু সবই এখন পানির নিচে।
জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, সুজানগর উপজেলার ৩ দশকি ৫, ঈশ্বরদীর ২৫ ও সদর উপজেলার ২৯৭ দশমিক ৫ হেক্টরসহ জেলার ৩২৬ হেক্টর জমি বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ২০১ দশমিক ৫ হেক্টর জমির মরিচ, কলা ও সবজি আক্রান্ত হয়েছে।
নওগাঁয় ১৭ হাজার বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে
নিজস্ব প্রতিবেদক, নওগাঁ থেকে জানান, নওগাঁর আত্রাই নদীর পানি বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে আত্রাই ও রাণীনগর উপজেলার প্রায় ১৭ হাজার বিঘা জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে এবং কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৮-১০টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্টরা সেগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন।
নদী তীরবর্তী বেশকিছু বাড়িঘর ও আত্রাই উপজেলার পতিসর-সমসপাড়া সড়কের প্রায় ৩ কিলোমিটার অংশ ডুবে গেছে। এতে মাঝগ্রাম, হেঙ্গলকান্দি, পৈসাওতা, জগন্নাথপুর, ফটকিয়া, বাঁশবাড়িয়া, বিশা, দমদত্তবাড়িয়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
নদীর স্লুইসগেট, ব্রিজ ও কালভার্ট দিয়ে হু হু করে পানি প্রবেশ করায় কাশিয়াবাড়ী, ভোঁপাড়া, পালশা, কচুয়া, মারিয়া, নওদুলি, নৈদীঘি, মনিয়ারী, হেঙ্গলকান্দি, মাঝগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় ১০ হাজার ৫০০ বিঘা জমির রোপণকৃত আমন ধান ও অন্যান্য ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
আত্রাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রসেনজিৎ কুমার জানান, প্রতি ঘণ্টায় ফসলের ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।
রাণীনগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, তাদের উপজেলায় প্রায় ২ হাজার ৫০০ বিঘা জমির আমন ধান ও ফসল পানিতে ডুবে গেছে এবং আরও ৩ হাজার ৭৫ বিঘা জমির ফসল অর্ধনিমজ্জিত অবস্থায় রয়েছে। দ্রুত পানি কমলে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে।
আত্রাই উপজেলার ভোঁপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দীন জানান, তার নিজের ১৬ বিঘা জমির ধানও ডুবে গেছে। কৃষক আব্দুল হালিম জানান, তার ৯৫ বিঘা জমির ধান তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় ৬ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আরেক কৃষক রুবেল চৌধুরী জানান, তার ২২ বিঘা জমির আমন ধান পানিতে ডুবে গেছে।
নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী প্রবীর কুমার পাল বলেন, শুক্রবার থেকে উজানে বৃষ্টিপাত অনেক কমে যাওয়ায় আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে আত্রাই নদীর পানিও কমতে শুরু করবে বলে তারা আশা করছেন। আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান বলেন, বন্যার দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোনো বাঁধ ভেঙে যায়নি এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।
নাটোরে ডুবে গেছে রোপা আমন, দিশেহারা কৃষকরা
নিজস্ব প্রতিবেদক, নাটোর থেকে জানান, টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে নাটোরের বিলে রোপণ করা রোপা আমন ধান। ধার-দেনা করে অনেকে ধান রোপণ করলেও মৌসুমের শুরুতেই তা তলিয়ে যাওয়ায় দিশেহারা হাজারো কৃষক। অতিবৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতায় কৃষকরা শুধু আর্থিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, প্রভাব পড়বে মোট ধান উৎপাদনেও। তবে পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি জাতের ধান রোপণের পরামর্শ কৃষি বিভাগের।
নাটোর সদর উপজেলার বড়ভিটার কৃষক মানিক মিয়া। সম্প্রতি বড়ভিটা বিলে দুই বিঘা জমিতে লাগিয়েছেন রোপা আমন ধান। তবে অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় এখন জমির ধান পানির নিচে। হাঁটু সমান পানিতে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন কষ্টের ফসল। বিঘাপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে যে ধান লাগিয়েছিলেন তা নষ্ট হচ্ছে বৃষ্টির পানিতে।
মানিক মিয়া বলেন, ‘ঋণ নিয়ে চার বিঘা জমিতে ধানরোপণ করেছি। এরমধ্যে দুই বিঘা পানিতে ডুবে গেছে।’
মানিক মিয়ার মতো এমন দুর্দশায় জেলার হাজারো রোপা-আমন ধান চাষিরা। মৌসুমের শুরুতেই রোপণ করা ধান নষ্ট হওয়ায় দিশেহারা তারা। অনেকে ধার-দেনা করে ধান লাগালেও সবটুকু স্বপ্ন এখন যেন পানির নিচে।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক হাবিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা কৃষকদের ব্রি-ধান-২২, ব্রি-ধান-২৩, বীণা-ধান-১১ এ ধানগুলো রোপণের পরামর্শ দিয়ে থাকি। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে থাকি।’
এবছর জেলায় রোপা-আমন ধান লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭৬ হাজার ৮৮৫ হেক্টর জমিতে। তবে অতিবৃষ্টিতে এরইমধ্যে তলিয়ে গেছে প্রায় এক হাজার একশো হেক্টর জমি। যা থেকে উৎপাদন হতো অন্তত ৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ধান। আনুমানিক ক্ষতি অন্তত ১৪ কোটি টাকা বলে জানান কৃষকরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, পানিবন্দি ৯ হাজার পরিবার
নিজস্ব প্রতিবেদক, চাপাই নবাবগঞ্জ থেকে জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা নদীর পানি গত ১৩ আগস্ট বিপৎসীমার ৩১ সেমি নিচে সর্বোচ্চ ২১ দশমিক ৭৪ মিটার সমতলে প্রবাহিত হওয়ার পর বিগত ৪৮ ঘণ্টায় ৪ সেমি কমলেও মহানন্দা, পুনর্ভবাসহ জেলার নদীগুলোর পানি বাড়ছেই। পদ্মার পানিবৃদ্ধিতে তীরবর্তী ১২টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তবে কমে এসেছে পদ্মার পানি বৃদ্ধি। অন্য নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও কমেছে বৃদ্ধির হার।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, আগামী ২/১ দিনের মধ্যে অবস্থার উন্নতি হতে পারে। অবস্থা আরো খারাপ না হওয়ার আশা করছে সংস্থাটি।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শনের পর জানিয়েছেন, দুই উপজেলায় পদ্মার পানিবৃদ্ধিজনিত কারণে অন্তত ৯ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়েছেন। পানিবন্দি ও পানি ওঠায় পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত ৫৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠানের চারদিকে পানি থাকলেও পাঠদান বন্ধ হয়নি। এছাড়া আক্রান্ত সকল ইউনিয়নে কৃষি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মানুষ পানিবন্দি হয়নি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. ইয়াসিন আলী বলেন, শুক্রবার পর্যন্ত মূলত পদ্মার কারণে সদর ও শিবগঞ্জ, মহানন্দার কারণে জেলার সকল উপজেলা এবং পুনরায় কারণে গোমস্তাপুরে প্রায় ১৭ হাজার বিঘা ফসলি জমি (আড়াই হাজার হেক্টর) বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত ফসলের মধ্যে রয়েছে ধান, ভূট্টা, সবজি, হলুদ, কলা, পেঁয়াজের বীজতলা ইত্যাদি।
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নুরুল ইসলাম বলেন, উপজেলায় প্রায় দেড় হাজার পরিবার পানিবন্দি। অন্তত ১৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় পাঠদান বন্ধ। গত বুধবার থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। এটি অব্যাহত থাকবে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত।
ভোরের আকাশ/এসএইচ