বরগুনায় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা
মোঃ আল আমিন, বরগুনা
প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৫ ১১:০৫ এএম
ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বরগুনায় ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত এক সপ্তাহের বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, জেলার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর ঢল নেমেছে, এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ জনে। এই পরিস্থিতি জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও গবেষকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
হাসপাতালে রোগীর চাপ, অপ্রতুল সুবিধা
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় (২৬ জুন সকাল ৮টা থেকে ২৭ জুন সকাল ৮টা) জেলায় নতুন করে ৭০ জন আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে বেশিরভাগই বরগুনা সদর উপজেলার। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ২৪৩ জন রোগী চিকিৎসাধীন, যার মধ্যে ১৯৭ জনই বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে। চলতি বছরে জেলায় মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২,৬৩০ জন। এই তথ্য ২৭ জুন ২০২৫ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের হিসাবের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে। তবে, এর বাইরেও অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে ব্যক্তিগত চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন, ফলে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা মেঝেতে দেওয়া হচ্ছে, কারণ শয্যার তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। পরীক্ষার সুবিধা অপ্রতুল হওয়ায় রোগীদের শহরের বেসরকারি ক্লিনিকে পাঠানো হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি ও রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা না থাকায় গুরুতর রোগীদের বরিশাল বা ঢাকায় রেফার করতে হচ্ছে, যা রোগী ও স্বজনদের জন্য কষ্টকর।
মৃত্যু ও আক্রান্তের পরিসংখ্যান
গত সপ্তাহে (২২-২৭ জুন) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বরগুনায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। ২২ জুন রাবেয়া (১০০) নামে এক বৃদ্ধা এবং ২৬ জুন সাধনা রানী (৩৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। এ নিয়ে জেলায় মৃত্যুর সংখ্যা ২৩-এ পৌঁছেছে, যার মধ্যে ২২ জনই সদর উপজেলার। জুনের প্রথম ১৫ দিনে ৮৬১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন, যা মে মাসের ৭৮৪ এবং এপ্রিলের ১৮০ জনের তুলনায় অনেক বেশি। তবে এটা শুধু সরকারি হাসপাতালের তথ্য কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা এর ১০ থেকে ১৫ গুণ হতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।
একটি বেসরকারি ক্লিনিকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, "গত এক সপ্তাহে ১০০ জনের বেশি জ্বরের রোগী এসেছেন, যার ৩০-৩৫% ডেঙ্গু পজিটিভ।" তাঁর মতে, জেলার সবগুলো ক্লিনিকের তথ্য নির্দিষ্ট অ্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে জেলায় ডেঙ্গু রোগীর প্রকৃত সংখ্যার ধারণা পাওয়া যাবে।
একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ল্যাব টেকনিশিয়ান বলেন, "আমরা প্রতিদিন ২০-২৫টি ডেঙ্গু টেস্ট করি, যার ৪০% পজিটিভ আসে। কিন্তু এই তথ্য জাতীয় ডেটাবেজে আপলোড করার ব্যবস্থা নেই।"
প্রতিরোধে ঘাটতি ও জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেনসহ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হাসপাতালে ভর্তির বাইরেও প্রচুর রোগী শনাক্ত হচ্ছে না, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। সঠিক রেকর্ড রাখার অভাব এবং প্রতিরোধ কার্যক্রমে ঘাটতি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
আইইডিসিআরের একটি দলের জরিপে দেখা গেছে, বরগুনা সদরে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব স্বাভাবিকের তুলনায় ৮ গুণ বেশি। বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা, জলাবদ্ধতা এবং অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মশার প্রজনন বাড়িয়েছে।
প্রশাসনিক উদাসীনতা ও স্থানীয় অভিযোগ
স্থানীয় নাগরিক সংগঠন স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সভাপতি হাসানুর রহমান জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীলতার ঘাটতি এবং মশার অভয়াশ্রম হিসেবে পরিত্যক্ত জমি-জলাশয়ের অস্তিত্ব পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজীর আহমেদ বলেন, “বরগুনার পরিস্থিতি আমাদের প্রতিরোধ কৌশলের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরছে।”
করণীয়
বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে জমে থাকা পানি পরিষ্কার, শরীর ঢেকে রাখা পোশাক পরা এবং মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলার তাগিদ রয়েছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জরুরি ভিত্তিতে মশক নিধন, জনসচেতনতা ও সরকারি-বেসরকারি ডেটা সমন্বয় প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভোরের আকাশ/এসএইচ