শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল
ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৫ ১০:০২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও গণফোরামের সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টুর দ্বিতীয় জানাজার নামাজ ঢাকার কেরানীগঞ্জের নেকরোজবাগ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি, স্বজনসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ অংশ নেন।
সোমবার সকাল সাড়ে নয়টায় কেরানীগঞ্জে মোস্তফা মোহসীনের দ্বিতীয় জানাজার নামাজের সময় নির্ধারিত ছিল। এর আগেই সকাল আটটা থেকে বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষ মোস্তফা মোহসীন মন্টুর পৈতৃক বাড়ির পাশের নেকরোজবাগ মাঠে এসে জড়ো হতে থাকেন। সকাল নয়টার দিকে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ রাজস্ব সার্কেল সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মামুন তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করেন। এ সময় জাতীয় পতাকা দিয়ে আচ্ছাদিত মরহুমের মরদেহে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়।
জানাজায় অংশ নিতে আসেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান, কেরানীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. শাহাবুদ্দিন, কৃষক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নাজিমউদ্দিন মাস্টার, ঢাকা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইরফান ইবনে আমান প্রমুখ।
জানাজার আগে মোস্তফা মোহসীন মন্টুর একমাত্র ছেলে কনক মোস্তফা শোকাহত কণ্ঠে বলেন, ‘বাবা কেরানীগঞ্জকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তিনি এখানকার মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য সবসময় কাজ করে গেছেন। আমি বাবার দেখানো পথে হাঁটব ও তাঁর শেখানো আদর্শ ধরে রাখব। তিনি যেভাবে পরিবারকে আগলে রেখেছিলেন, আমিও সেভাবে চেষ্টা করব। আপনারা সবাই বাবার জন্য দোয়া করবেন।’
সহযোদ্ধা, রাজনৈতিক সহকর্মী, আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি অনেক সাধারণ মানুষও আওয়ামী লীগ ছেড়ে গণফোরামে যোগ দেওয়া মোস্তফা মোহসীনের জানাজায় অংশ নিতে আসেন।
নেকরোজবাগ এলাকার সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ হারুন মিয়া বলেন, ‘চোখে দেখছি কেমন কইরা মন্টু সাহেব যুদ্ধের সময় মানুষজনরে একসাথে কইরা রাখতেন। যুদ্ধের সময় বড় বড় নেতারা আইলে উনিই তাগো কেরানীগঞ্জে ঠাঁই দিতেন। কাওরে ভয় পাইতেন না মন্টু সাহেব। কেউ বিপদে পড়লে আগাইয়া আসতেন। ওই রকম সোজা আর সাহসী মানুষ এখন আর দেহা যায় না। জানাজায় আইসা তার লাশ দেইখ্যা মনটা কেমন জানি করতাছে। মনে হইতাছে মন্টু ভাই না, আমার আপনজন মারা গেছে।’
কালিন্দী এলাকা থেকে একসঙ্গে তিন বন্ধু এসেছিলেন জানাজায় অংশ নিতে। তাঁদের মধ্যে একজন ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী আহনাফ হোসেন বলল, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি; কিন্তু মন্টু সাহেবের কথা ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছে শুনে আসছি। তিনি শুধু রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একজন সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তখন তিনি বুক চিতিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অনেক সফল অপারেশন করেছেন, যা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক ছিল। সেটা আমাদের জন্য একটা বড় অনুপ্রেরণা।’
কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া এলাকা থেকে আসা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমি ওনার এলাকায় থাকি না; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে ওনার অবদানের কথা এত শুনেছি যে মনে হতো উনি আমাদের সবার নেতা। আজ জানাজায় এসে ওনার প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। সত্যি বলতে, এমন মানুষগুলো হারিয়ে গেলে সমাজ একেকটা আলো হারায়।’
মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেরানীগঞ্জের সভাপতি নুরউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকার মানুষকে আশ্রয় দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হওয়ায় ২ এপ্রিল মোস্তফা মোহসীনকে হত্যার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কেরানীগঞ্জের বেশ কয়েকটি জায়গায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। গণহত্যা শুরুর আগে পাকিস্তানি সেনারা বুড়িগঙ্গার অপর প্রান্ত কেরানীগঞ্জের ঘাটে ঘাটে মন্টুকে খুঁজতে এসেছিল, তখন কোনো মানুষ একবারের জন্যও তাঁর অবস্থান চিনিয়ে দেয়নি। আমাদের কাছে জনপ্রিয় ও সাহসী ব্যক্তিত্ব ছিলেন মোস্তফা মোহসীন মন্টু।’
রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) ক্লাবের সভাপতি কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা জেলা গেরিলা বাহিনীর প্রধান হিসেবে মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্ব ও ত্যাগ আজও মানুষের মনে গেঁথে আছে। আমৃত্যু তিনি কেরানীগঞ্জের মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নের কথা চিন্তা করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে কেরানীগঞ্জবাসী একজন অভিভাবক এবং সৎ, নির্লোভ ও আদর্শবান নেতাকে হারিয়েছে।’
উল্লেখ্য, গতকাল রোববার বিকেল সাড়ে চারটায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মোস্তফা মোহসীন মন্টু। তিনি ঢাকা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। গতকাল রোববার বাদ এশা রাজধানীর কাঁটাবন ঢালের বাইতুল মামুর জামে মসজিদে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। কেরানীগঞ্জের নেকরোজবাগ মাঠে দ্বিতীয় জানাজা শেষে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
ভোরের আকাশ/এসএইচ