বিএনপির উল্টোসুর জামায়াত-এনসিপিতে
রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই জুলাই সনদ ঘোষণা করা হবে। এ লক্ষ্যে দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার দীর্ঘ সংলাপের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। অনেক মৌলিক ইস্যুতে অনৈক্য থাকায় ফের দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে কমিশন। বিভিন্ন ইস্যু বিশেষ করে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে বিএনপির বিপরীত অবস্থানে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের আনুষ্ঠানিক মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৫ আগস্ট। ফলে সময় ও অনৈক্যের প্রবল চাপে রয়েছে ঐকমত্য কমিশন। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে আটকে যাচ্ছে জুলাই সনদ ঘোষণা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আনুষ্ঠানিক আলোচনা গত ৩১ জুলাই শেষ হয়েছে।পূর্বঘোষিত জুলাইয়ের মধ্যে সনদ ঘোষণা করতে পারেনি কমিশন। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় মাসের জন্য কাজ শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তাই, স্বভাবতই কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ১৫ অগাস্ট। প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য ছিল, চলতি বছরের জুলাই মাসের মধ্যে সনদ চূড়ান্ত করা হবে। কিন্তু তা হয়নি, বরং মেয়াদের একদম দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে কমিশন। এখন যদি ঐকমত্যে পৌঁছে চূড়ান্ত সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর করা সম্ভব না হয়, তখন কী হবে, এই আলোচনাও রয়েছে। আর এই সনদ চূড়ান্ত হলে এর বাস্তবায়ন কিভাবে হবে-এ নিয়েও বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য প্রকাশ্যে এসেছে। জনমনে প্রশ্ন উঠছে, সংস্কার প্রশ্নে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না কেন, সংকটটা কোথায়?জুলাই সনদ তৈরি করতে দফায় দফায় দলগুলোর সাথে আলোচনায় বসেছে ঐকমত্য কমিশন এবং দলগুলোর কাছে একাধিকবার সনদের খসড়াও পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৮ জুলাই সনদের খসড়া পাঠানো হয় দলগুলোর কাছে। দলগুলোও তার জবাব দিয়েছে। তবে আগামী দুই একদিনের মাঝে দলগুলোর কাছে ফের সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।আইনি ভিত্তি নিয়েই মূল সংকট : গত বছরের ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কার আনার জন্য নানারকম উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই লক্ষ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ মোট ১১টি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনগুলো রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়, যা নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সাথে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশন। কমিশনগুলোর প্রস্তাবিত যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নে সকল রাজনৈতিক দল একমত হবে, সেগুলো নিয়ে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ তৈরি হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু দলগুলো সকল প্রস্তাবের সাথে একমত না হওয়ায় সনদের খসড়া তৈরি হলেও এখনো পর্যন্ত এটিকে চূড়ান্ত করা যায়নি। ওই খসড়ায় বলা আছে, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে দলগুলো। এই দুই বছরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের বিষয়ে বিএনপি’র আপত্তি না থাকলেও কিছু দলের এখানে আপত্তি রয়েছে। বিশেষ করে, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই বাস্তবায়ন চাইছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলে, তা শেষপর্যন্ত কতটা বাস্তবায়ন হবে এই প্রশ্ন জামায়াত ও এনসিপির। তারা চায়, জুলাই সনদকে একটি আইনি ভিত্তি দেওয়া হোক।এ নিয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘যেসব বিষয়ে সবাই একমত, সেগুলো জাতির সামনে ঘোষণা করা হলেও দ্রুত সনদে স্বাক্ষর করিয়ে নির্বাচনের পূর্বেই এটিকে আইনি রূপ দিয়ে এর ভিত্তিতে নির্বাচনে যেতে হবে।’এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীবেরও বক্তব্য একই রকম। তিনি বলছিলেন, ‘নির্বাচনের পূর্বে জুলাই সনদকে আইনি, সাংবিধানিক ভিত্তি দিয়ে ওই সনদ অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচন হতে হবে।’এটি আমাদের প্রধান দাবি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘মূল বিষয়টি স্বাক্ষরের জায়গা নয়। বাংলাদেশে এরকম শত শত কাগজে দলগুলো স্বাক্ষর করে। কিন্তু আইন ও জনগণের অভিমত দ্বারা বাস্তবায়নযোগ্য না হলে এটি কার্যকর হয় না।’এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘স্বাক্ষর করার জন্য সকল দল একমত। শুধুমাত্র দুই-তিনটি দল বলেছে, এটি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে এবং এর আইনি ভিত্তি কী হবে, তা নির্ধারণ না হলে তারা স্বাক্ষরের বিষয়ে চিন্তা করবেন।’তিনি বলেন,‘আমরা বলেছি, সাংবিধানিক সংশোধনীগুলো বাদে বাকী সকল সংস্কার প্রস্তাব এই সরকার এই সময়ের ভেতরেই বাস্তবায়ন করতে পারে। এজন্য সর্বোচ্চ প্রয়োজন, আইনের সংশোধনীর জন্য অধ্যাদেশ জারি ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশ এবং অফিস আদেশ। এটি প্রতিদিন বাস্তবায়ন হচ্ছে। সাংবিধানিক সংশোধনীগুলো বাস্তবায়নের বৈধ ফোরাম জাতীয় সংসদ।’এদিকে, এনসিপি নেতা আরিফুল ইসলাম আদীব জানান, উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, দলীয় পদে প্রধানমন্ত্রীর না থাকা, দুই সংসদের নির্বাচিত প্রার্থীদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের মতো কিছু বিষয়ে একমতে আসা না গেলে এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না।বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, তারা সবসময় জুলাই সনদ নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য রাজি। তবে কমিশন চূড়ান্ত জুলাই সনদ পাঠালে ‘আলোচনা অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেই’ বিএনপি তাতে স্বাক্ষর করবে। যেকোনও সাংবিধানিক ও আইনি প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের সম্মতি আছে। এর বাইরেও যদি কোনও প্রক্রিয়া কেউ প্রস্তাব করে, সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। আমরা নিশ্চয়ই আলোচনায় অংশগ্রহণ করবো।’এ প্রসঙ্গে কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, কমিশনের পরবর্তী কাজ জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ করা। তবে দলগুলোকেই বাস্তবায়নের পথ খুঁজে বের করতে হবে। ঐকমত্য কমিশন অনুঘটকের কাজ করতে পারে। সনদে যেসমস্ত জায়গায় ঐকমত্য হওয়ার, তা হয়েছে। এরপর আর এটা নিয়ে নতুন কিছু করার আমরা চেষ্টা করছি না। যেগুলো নোট অব ডিসেন্ট আছে। ওগুলো নিয়েই সনদ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সব বিষয় নিয়ে ঐকমত্য তৈরি করতে গেলে তো বছরের পর বছর লেগে যাবে। এগুলো পরামর্শ হিসাবে থাকল। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে এগুলো দেখবে ও তার ভিত্তিতে সরকার পরিচালনা করবে বলে আমরা আশা করছি।’তবে স্বাক্ষর কবে নাগাদ হবে, তা সুনির্দিষ্ট না করে আলী রীয়াজ বলেন, ‘এটি নির্ভর করছে, চূড়ান্ত খসড়া ও দলগুলোর প্রতিক্রিয়ার ওপর। আমরা চাই দ্রুততার সাথে করতে।’জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আবার সংলাপ : জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবার সংলাপে বসবে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রোববার থেকে মতামত নেওয়া হবে বিশেষজ্ঞদেরও। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি।গত শুক্রবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক রীয়াজ জানান, ২৮ জুলাই প্রণীত সনদের খসড়ায় আগেই মতামত দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। শনি বা রোববারের মধ্যে মতামত দেওয়ার কথা জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। পরবর্তী সংসদে দুই বছরের মধ্যে সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নের যে অঙ্গীকার খসড়ায় রয়েছে, এতে একমত বিএনপি। তবে সনদের আইনি ভিত্তি চাওয়া জামায়াত নির্বাচনের আগেই সংস্কারের বাস্তবায়ন চেয়েছে। এখনও আনুষ্ঠানিক মতামত না দিলেও এনসিপিরও একই অবস্থান।রোববার থেকে আবার আলোচনা শুরু হবে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘খসড়া সনদের অঙ্গীকারের অংশটি কমিশনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নয়। দলগুলোর মতামতে তা চূড়ান্ত করা হবে। এতে দলগুলোর ঐকমত্য হলে ঠিক করা হবে জুলাই সনদ সইয়ের দিনক্ষণ।’ জুলাই সনদে বলা থাকবে কী কী সংস্কার হবে এবং তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে। এতে সব দল সই করবে। এ বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘সনদের যে খসড়া করা হয়েছে, তা প্রাথমিক। ঐকমত্যের ভিত্তিতে রচিত চূড়ান্ত সনদ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।’কবে নাগাদ সনদ সই হবে প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘এটি নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার তৃতীয় পর্বে, বিশেষত বিশেষজ্ঞদের মতামত পাওয়ার পর। প্রাথমিক খসড়া দেওয়া হয়েছে সবাইকে মতামত দিতে। সবার মতামতের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ খসড়া আবার পাঠানো হবে আগামী দুদিনের মধ্যে। সবাই একমত হয়ে স্বাক্ষরের দিন-তারিখ ঠিক করা যাবে।’১৫ আগস্ট কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। এর আগে সনদ সই করতে চান জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হবে না। সরকার যদি মনে কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি প্রয়োজন, তবে করবে।তৃতীয় ধাপের সংলাপ দীর্ঘমেয়াদি হবে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘স্বল্পতম সময়ে আলোচনা করতে চাই। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।’গত ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের ২৩ দিনের সংলাপে মোট ২০টির মধ্যে ১১টি ইস্যুতে দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে। বাকি ৯টিতে কমিশন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। তবে এর সাতটিতে বিএনপির, একটিতে জামায়াতের নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) আছে।ভোরের আকাশ/এসএইচ