জামায়াতের সঙ্গে তিন দলের দূরত্বের নেপথ্যে কী
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনসহ পাঁচ দফা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করছে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল। জুলাই সনদের স্বীকৃতি আদায়ে মূলত বিএনপি ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই জামায়াতের নেতৃত্বে এই কর্মসূচিতে যাচ্ছে দলগুলো। সে জন্যই জামায়াত ইসলামীসহ দলগুলোর দাবির সঙ্গে এতমত নন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি।প্রসঙ্গত, জুলাইসনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চুলছেঁড়া বিশ্লেষণসহ আলোচনা-সমালোচনা উঠে ঐক্যমত্য কমিশনে। ১৮টি রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতির পক্ষে। আর বিপক্ষে রয়েছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ ২৮টি দল।বিএনপি বলছে, পিআর পদ্ধতিতে তারা কোনোভাবেই রাজি নয়। পিআর পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়া হলে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবে তারা। এদিকে, জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন থেকে পিছু হটেছে এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টি।এ বিষয়ে এনসিপি বলছে, সংস্কারের সব দাবিতে একমত না হওয়া ও নির্বাচনী জোট হওয়া নিয়ে নানা অস্পষ্টতা থাকায় আপাতত জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ কোনো ধরনের কর্মসূচি নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি এনসিপি। দলটি আরও বলছে, যুগপৎ আন্দোলনের যে দাবিগুলো রয়েছে, সবগুলোর সঙ্গে একমত না থাকায় আপাতত জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনে নামছে না তারা।এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন খেলাফত মজলিসসহ কিছু দল উচ্চ ও নিম্নকক্ষ দুই কক্ষেই পিআর পদ্ধতি চায়। কিন্তু আমাদের দাবি শুধু উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে। যুগপৎ আন্দোলনে না যাওয়া এটি অন্যতম একটি কারণ। দ্বিতীয়ত : এখনই বিভেদ-বিভাজন নয়, পারস্পারিক সমঝোতা ও ঐক্য থাকার কৌশল। তৃতীয়ত : রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য বিভেদ সৃষ্টি হলে ফ্যাসিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ উত্থানের পথ সুগম হতে পারে। কারণ হিসেবে এনসিপির ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, দলটির নেতাদের একাংশ ধর্মভিত্তিক কোনো দলের সঙ্গে জোটে রাজি নন। গণঅধিকার পরিষদ এবং এবি পার্টিও জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর কর্মসূচিতে একমত নন। দুইটি বলছে, জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।রাজনীতির মাঠে দলগুলোর নীতি-আদর্শগত মতপার্থক্য থাকলেও দেশ ও জাতির স্বার্থে কোনো বিভেদ-বিভাজন নয়, পারস্পারিক সমঝোতা ও ঐক্যমতই জাতিকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে পারে- এমটাই ভাবছেন রাজনৈতিক দল। দলগুলো নেতাদের তাদের ভাবনা, জুলাই অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পলায়নের মধ্য দিয়ে গত দেড় দশকের আওয়ামী স্বৈরশাসনের শোষণ ও নির্মম অত্যাচারের খড়গ থেকে জনগণ স্বস্থির নিশ্বাস পেলেও এখনো দেশে-বিদেশে বসে পতিত স্বৈরাচার দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এই মুহূর্তে হাসিনার অপশাসনবিরোধী দলগুলোর মধ্য বিভেদ-বিভাজন দেখা দিলে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার হরণকারী ফ্যাসিবাদের উত্থান শঙ্কা থাকবে বলেও মনে করছেন তারা। তা ছাড়া, ফ্যাসিবাদ সরকার না থাকলেও দেশের প্রতিটি সেক্টরে রয়েছে ফ্যাসিবাদের দোসররা।রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য মতানৈক্য দেখা দিলেই বর্ণচোড়া গুপ্ত চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সম্ভবনা রয়েছে। তাই এমন পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য কোনো বিভাজনের কোনো সুযোগ নেই বলে ধারণা রাজনৈতক দলের নেতাদের। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের সঙ্গে এই মুহূর্তে একমত নয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টি।রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, একটি বিষয় সবার মনে রাখা দরকার, এত রক্ত বিসর্জনের পরে আমরা কেউই আর ’৭১ ও ’৯০-এর ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি চাই না। আমরা চাই না দেশে নতুন করে ফ্যাসিস্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক, তেমনই চাই না যে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে পুনরায় কোনো বহিঃশক্তির আধিপত্য কায়েম হোক। দেশ ও দেশের জনগণের স্বার্থে এই মহৎ লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমাদের সকলের একতা বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বিচার নিশ্চিতকরণে এই মুহূর্তে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের ঐক্য অপরিহার্য। সুতরাং কোনো বিভেদ-বিভাজন নয়, ঐক্য চাই। ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্য থাকতে হবে।বিএনপি বলছে, মহান মুক্তিযুদ্ধকে ২৪ অভ্যুত্থানের সমান্তরাল করার কোনো প্রচেষ্টাকে তারা সমর্থন করে না। পাশাপাশি সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে নির্বাচিত সংসদেই সবকিছু নির্ভর করছে। অন্য কোনো বিকল্পে সম্মত নয় বিএনপি।গণঅধিকার পরিষদ বলছে, বিএনপিকে বাইরে রেখেই এই ঐক্য গড়া হচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে, জামায়াতসহ ইসলামী ঘরানার শক্তিগুলো বিএনপিকে চাপের মুখে রাখতেই এই যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে আমরা একমত নই।গণঅধিকার পরিষদ নেতারা বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির বিভাজনের ফলে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার পথ সুগম হয়, এমন কোনো পদক্ষেপের সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদ যুক্ত হবে না।এ প্রসঙ্গে, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই। কারও সঙ্গে খারাপ চাই না। আমাদের সব দলের সঙ্গেই কথা হচ্ছে। এসব অনানুষ্ঠানিক। কিন্তু চার দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের যে কথা বলা হচ্ছে এমন কোনো ধারণা আমাদের নেই।তিনি বলেন, আমরা জুলাই সনদ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন চাই। আমাদের আসলে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য কীভাবে আরও মজবুত করা যায় সে জন্য কাজ করছি। আমাদের মধ্যে কোনো কারণে বিভেদ দেখা দিলে ফ্যাসিবাদ সুযোগ নেবে। সেটা আমরা দিতে পারি না।এ বিষয়ে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বা সখ্যতা কোনোটিই নেই। তাদের সঙ্গে এখনই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই।তিনি বলেন, আমাদের অবস্থান সীমিত : কেবল উচ্চকক্ষে পিআর বাস্তবায়ন ও জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিতের বিষয়ে তারা একমত।এ বিষয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, এবিপার্টি শুধুমাত্র পিআর সাপেক্ষে উচ্চকক্ষের বিষয়ে একমত। ফ্যাসিবাদের সহযোগী হিসেবে ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির কার্যক্রম স্থগিতের বিষয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর দাবিকে এবিপার্টি সমর্থন করে। তবে, কোনো রাজনৈতিক জোট কিংবা যুগপথ আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দলগুলো নির্বাচনী কৌশল হিসেবে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে হয়তো। আন্দোলন করা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। এ নিয়ে কিছু বলার নেই।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আরও বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, সাধারণভাবে সেগুলো অগ্রহণযোগ্য এবং যৌক্তিক নয়। আলোচনার মাধ্যমে একটা জায়গায় যেতে পারলে বিএনপি সবচেয়ে খুশি হবে। কারণ, এই অনিশ্চয়তা বেশি দিন অব্যাহত রাখা যাবে না।সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা চলমান রয়েছে। এ অবস্থায় আন্দোলনে যাওয়া এটা জামায়াতের দ্বিচারিতা বলা যেতে পারে।জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো দলকেই নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধের পক্ষে নয় বিএনপি। আইনে এখন দলের বিচারের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কারও আপত্তি থাকলে জাতীয় পার্টির বিষয়ে আদালতে যেতে পারে।ভোরের আকাশ/এসএইচ