ট্রাম্প-পুতিনের শীর্ষ বৈঠক
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫ ১২:৪৭ এএম
ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধবন্ধের ‘সুনির্দিষ্ট বার্তা’ ছাড়াই শেষ হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আলোচিত বৈঠক। দুই দেশই বৈঠকটি ‘ইতিবাচক’ আখ্যায়িত করলেও তিন ঘণ্টার আলোচনায় যুদ্ধবিরতির আভাস ও চুক্তি- কোনোটিই হয়নি। তবে আরেকটি বৈঠকের সম্ভাব্য পূর্বাভাস দিয়ে গেছেন ট্রাম্প ও পুতিন। যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়া ইউক্রেনের ভূখণ্ড চায়-বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প। বৈঠকে কিছু বড় বিষয়ে একমত হতে না পারায় কোনো ধরনের চুক্তি হয়নি বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যকার বহুল প্রতীক্ষিত হাইভোল্টেজ এক বৈঠক আলাস্কা দ্বীপে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠকটি গত শুক্রবার স্থানীয় সময় বেলা ১১ টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১টা) শুরু হয়। তবে বৈঠকটি শুরুর আগেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হতে থাকে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বৈঠক ঘিরে প্রত্যাশার চাপ ছিল অনেক বেশি। বিশ^রাজনীতির সমীকরণ বদলে দিতে পারত ওই ঐতিহাসিক বৈঠক। আবার শঙ্কাও ছিল। পুতিনের সাথে আলাস্কা বৈঠকে সাফল্যের সম্ভাবনা ৭৫ শতাংশ বলে বৈঠকের আগে মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। কিন্তু পরবর্তীতে তা বাস্তবে রূপ নেয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের কোনো চুক্তি না করায় ইউরোপীয় মিত্র ও কিয়েভ আপাতত স্বস্তি পেয়েছে। তবে রাশিয়ার সঙ্গে মতপার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে। পুতিন আবারও যুদ্ধের মূল কারণগুলো তুলে ধরেছেন এবং ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী, ন্যাটো ও রাশিয়ান ভাষাভাষীদের সুরক্ষা সংক্রান্ত লক্ষ্য পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এছাড়া ক্রিমিয়া ও দখলকৃত অন্যান্য এলাকা ছাড়ার কোনো ইঙ্গিত দেননি তিনি।
অন্যদিকে, বৈঠকের আগেই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি না হলে রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়ে রেখেছেন। তবে বৈঠকের পর তিনি বলেছেন, দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি বিবেচনা করবেন। তবে তার মন্তব্য অস্পষ্ট থাকায় নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বৈঠক শেষে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি রাশিয়ার জন্যও ‘রাজসিক প্রত্যাবর্তন’ হিসেবে দেখেছে। পশ্চিমা দেশগুলো যত হুমকি দিয়েছে, পুতিন সেগুলোকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলেছেন। ইউক্রেনের জন্য কিছু স্বস্তি থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি শান্তি এখনো অনিশ্চিত।
ট্রাম্প-পুতিনের যৌথ সংবাদ সম্মেলন
সিএনএন জানায়, প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে বৈঠকের পর দুই প্রেসিডেন্ট অগ্রগতি ঘোষণা করতে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু তারা ঠিক কী অর্জন করেছেন তা ব্যাখ্যা না করেই সংবাদ সম্মেলন থেকে বেরিয়ে যান তারা। কোনো চুক্তি হয়নি। ট্রাম্প যে যুদ্ধবিরতি চেয়েছিলেন, বৈঠক শেষে বাস্তবে তেমন কিছুই দেখা গেল না।
সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, আমরা অনেক বিষয়ে একমত হয়েছি। যার বেশির ভাগই আমি বলব। কয়েকটি বড় বিষয় আমরা অর্জন করতে পারিনি। তবে আমরা কিছুটা অগ্রগতি করেছি। একটি চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আলোচনা চালিয়ে যাব।
ট্রাম্প পুতিনকে বলেন, আমরা খুব শিগগির আপনার সঙ্গে কথা বলব এবং সম্ভবত খুব শিগগির আমাদের দেখা হবে। এ সময় পুতিন ইংরেজিতে বলেন, পরেরবার মস্কোতে। পরে দুজন সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যান। এতে স্পষ্ট হয়, বৈঠকটি সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। পরিস্থিতি এমনই হবে, তা বৈঠক শুরুর পর থেকে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল।
যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়া ইউক্রেনের ভূখণ্ড চায় : ট্রাম্প
সিএনএন জানায়, বৈঠক ও সংবাদ সম্মেলন শেষ করেই ফক্স নিউজকে সাক্ষাৎকার দেন ট্রাম্প। এতে তিনি জানান, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ হবে রাশিয়ার কাছে ইউক্রেনের কিছু ভূখণ্ড তুলে দিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা গ্যারান্টির মাধ্যমে।
ফক্স নিউজের সাংবাদিক ও সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সিন হ্যানিটি তখন ভূখণ্ড দেওয়া এবং মার্কিনিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে ট্রাম্প বলেন,‘আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি এবং এসব বিষয়ে আমরা অনেকটা সম্মত হয়েছি। আসলে, আমরা অনেক বিষয়ে সম্মত হয়েছি। আমি আপনাকে বলতে পারি, এ বৈঠকটি ছিল উষ্ণ বৈঠক।’
পুতিনকে ‘শক্তিশালী ব্যক্তি’ এবং ‘কঠোর’ হিসেবে অভিহিত করেন ট্রাম্প। তবে তা সত্ত্বেও তাদের বৈঠক বেশ ইতিবাচক হয়েছে বলে জানান তিনি।
ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন, যুদ্ধে বন্ধে রাশিয়ার চাহিদা অনুযায়ী ইউক্রেনকে তাদের ভূখণ্ড দিতে হবে। এগুলো মেনে নিয়ে ইউক্রেনকে চুক্তি করতে হবে। তিনি বলেন,‘আমি মনে করি আমরা (যুদ্ধ) শেষের খুব কাছে আছি। এবং দেখুন, ইউক্রেনকে এটি মেনে নিতে হবে।’
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য কোনো উপদেশ আছে কি না? এমন প্রশ্ন ট্রাম্প বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধের চুক্তি করুন।’
বৈঠক সম্পর্কে ইউরোপীয় নেতাদের জানালেন ট্রাম্প
রয়টার্স জানায়, আলাস্কায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট এবং ন্যাটো ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি আগামী সোমবার ওয়াশিংটন সফর করবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি।
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, ট্রাম্প ওয়াশিংটনে ফিরে আসার পথে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট এবং মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ট্রাম্পের সঙ্গে ৯০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে চলা এই কথোপকথনকে ‘দীর্ঘ এবং সারগর্ভ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
জেলেনস্কি জানান, ইউক্রেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য ট্রাম্পের প্রস্তাবকে ইউক্রেন সমর্থন করে।
তিনি আরও বলেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে ‘আমেরিকান পক্ষের কাছ থেকে ইতিবাচক সংকেত’ নিয়ে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
জেলেনস্কি এক্স হ্যান্ডলে বলেছেন, ‘মূল বিষয়গুলো নেতাদের পর্যায়ে আলোচনা করা যেতে পারে এবং এর জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক উপযুক্ত-এ বিষয়েই ইউক্রেন জোর দিচ্ছে। সোমবার আমি ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করব, যাতে যুদ্ধ এবং হত্যাকাণ্ড বন্ধের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যায়।’
অ্যাক্সিওস প্রতিবেদক বারাক রাভিদ একটি সূত্রের বরাত দিয়ে বলেছেন, ট্রাম্প ফোনে জেলেনস্কি এবং ইউরোপীয় নেতাদের বলেছেন যে পুতিন যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী নন, বরং যুদ্ধের অবসান ঘটাতে একটি বিস্তৃত চুক্তিতে আগ্রহী।
রাভিদ তার সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ট্রাম্প ফোনকলে বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, দ্রুত একটি শান্তি চুক্তি যুদ্ধবিরতির চেয়ে ভালো।’
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লিয়েন, ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুটে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এবং জার্মানি, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, ইতালি ও যুক্তরাজ্যের নেতারাও এই ফোনকলে যোগ দিয়েছিলেন। ফোনকলে ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলন সম্পর্কে মিত্রদের ব্রিফ করেছেন।
ট্রাম্পের সঙ্গে সোমবার বৈঠকে বসছেন জেলেনস্কি
সিএনএন জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সোমবার বৈঠকে বসবেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। গতকাল শনিবার জেলেনস্কি নিজে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ওয়াশিংটন ডিসিতে তাদের দুজনের আলোচনা হবে। শুক্রবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাস্কায় বৈঠক করেন ট্রাম্প। এরপর তিনি জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন।
জেলেনস্কি জানিয়েছেন, ট্রাম্পের সঙ্গে তার দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ আলাপ হয়েছে। এরপরই ওয়াশিংটনে তাদের তাদের বৈঠকের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
দুই নেতার বৈঠক ‘খুবই ইতিবাচক’ হয়েছে : ক্রেমলিন
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ‘খুবই ইতিবাচক’ আলোচনা হয়েছে।
বিবিসি জানায়, স্থানীয় সময় শুক্রবার দুই নেতার ওই বৈঠকের পর প্রতিক্রিয়ায় এমন কথা বলেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ।
পেসকভ বলেন, ‘আলাস্কায় দুই নেতার বৈঠক ‘খুবই ইতিবাচক’ হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পেতে এ আলোচনা উভয় দেশকে ‘আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে’ সহায়তা করবে।’
বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন ট্রাম্প ও পুতিন। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্ন না নেওয়া প্রসঙ্গে রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম আরইএ নভোস্তিকে পেসকভ বলেন, দুই নেতা ‘পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য’ দিয়েছেন। এ কারণে অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তরের প্রয়োজন পড়েনি।
ভোরের আকাশ/এসএইচ