মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:১৫ এএম
ছবি: সংগৃহীত
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রসহ নানামুখী রাজনৈতিক কৌশলের ফাঁদে এখন বিএনপি- এমনটাই ভাবছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাবনা, ’৭১ ও ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী অশুভ শক্তি ঐক্য হয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। বিএনপিকে জনবিরোধী দল হিসেবে উপস্থাপনের বিভিন্ন ছক ইতোমধ্যে করছে বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রদলের পরাজয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন বর্জনের পরই দেশব্যাপী রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত জল্পনা-কল্পনা চলছে রাত-দিন। ভোটের ফলাফল ধরে সব মহলেই নানামুখী বিচার-বিশ্লেষণ হচ্ছে যে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত ডাকসুর প্রার্থীরা এত খারাপ করলেন কেন আর ছাত্রশিবির এত বড় বিজয় পেল কীভাবে।
ছাত্রদল তাদের নিজস্ব ভোট পেয়েছে কিন্তু ছাত্রশিবির ছাত্রলীগের ভোট পেয়েছে বলে মনে করছে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাবনা, জুলাই অভ্যুথানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশ থেকে পলায়নের পর আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে যে সব পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে, সেটাকে বিএনপি ওপর দায় চাপিয়েছে জামায়াত ইসলামী।
কারণ, গত ৫ আগাস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরই জামায়াত ইসলামী এক জনসভায় দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলছে, আওয়ামী লীগকে মাপ করে দিলাম। দ্বিতীয়, ডাকসুর নির্বাচনের কয়েকদিন আগেই দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের এক সভায় তার বক্তব্যে বলেছেন, প্রয়োজনে আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বানচাল করা হবে। তৃতীয়, জামায়াত ইসলামী ভোটে পিআর নামক অযোক্তিক দাবি সংযুক্তি করেছে ঐক্যমত্যে কমিশনে।
এনসিপি ও ইসলামী কয়েকটি দল পক্ষে জোড় দাবি উত্থাপন করছে। এটাও বিএনপির বিরুদ্ধে একটা বড় ধরনের ষড়যন্ত্র বলে ভাবছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। জুলাই-অভ্যুথানের পর রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে বিএনপির ইমেজ ক্ষুণ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একটি চক্র। অনলাইনসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে দলটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এমনকি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা। তাই চাঁদাবাজ, দখলবাজসহ পরিকল্পিত বিভিন্ন অপবাদ চাপানোর কৌশলের শিকার হচ্ছে দলটি। কোন ধরনের ঘটনা ঘটলেই সেটা বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অনলাইনে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
অনেক সময় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দিয়ে ভুয়া ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই সব দেখে জন সাধারণের মনে বিএনপি সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশিষ্টজনদের মতে, দেশ ও জনকল্যাণমুখী দল হিসেবে দেশ-বিদেশে বিএনপির যে সুনাম রয়েছে, সেই মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে নানামুখী চক্রান্ত। পাশাপশি মিডিয়াগুলোতে এখনও স্বৈরচারের দোসরা রয়েছে, তারা একটি বিশেষ গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বলেও ভাবছেন বিশিষ্টজনরা।
সাবেক মন্ত্রী ও বিএলডিপি-এর প্রেসিডেন্ট এ. নাজিম উদ্দিন আল আজাদ বলেন, পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে এক সময়ে যে সব রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে একযোগে আন্দোলন করেছে, এর মধ্যে কতিপয় রাজনৈতিক দল এখন ক্ষুদ্র স্বার্থে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। দেশে কোনো ধরনের অপকর্ম হলে তারা সরকারকে দায়ী না করে বিএনপিকে জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর হীন চেষ্টা করছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর মো. শাহ আলম বলেন, জনগণের কাছে ভুল তথ্য উপস্থান করছে কিছু মহল। একইসঙ্গে দলীয় আধিপত্য বিস্তার নিয়েও রয়েছে নানামুখী ষড়যন্ত্র। দেশে কোনো ঘটনা ঘটলেই কোনো কোনো স্বার্থন্বেষী রাজনৈতিক দল বিএনপির হাইকমান্ডের ওপর দায় চাপাচ্ছে দেশকে বিরাজনীতিকরণের নীল নক্সারই অংশ।
তিনি বলেন, বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়, এখন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সকল ষড়যন্ত্রেও বিরুদ্ধে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু সোশ্যাল মিডিয়া আইডি ও পেজ থেকেও বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি বিশেষ মহল।
এদিকে, বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান এখন বাংলাদেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করায় একটি গোষ্ঠী তার ইমেজ নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী বলেন, ডাকসুর এই ভোট হলো পুরোনো রাজনীতির বিরুদ্ধে ভোট। একটা পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হয়েছে- আগের যে রাজনীতি, দখলবাজের রাজনীতি, সেন্টার দখল করে জিতে যাওয়ার রাজনীতি, বাংলাদেশে আর চলবে না। জনগণের মনোজগৎ বুঝে জনগণের রাজনীতি করতে হবে। এখন মানুষের কাছে যেতে হবে। রাজনীতিবিদদের এখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে চা খেতে হবে, তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেন, তরুণ প্রজন্মের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে গেছে। পুরোনো রাজনৈতিক বয়ান তারা আর শুনতে চাইছেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে এবং দেশের মঙ্গলের কথা তারা ভাবেন। দুর্নীতি-লুটপাট ও দখল-চাঁদাবাজিকে তারা পছন্দ করছেন না।
তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এই ফলাফল বিচার-বিশ্লেষণ করে রাজনীতিবিদদের শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। এই নির্বাচনের ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করে নেতিবাচক দিকগুলো পরিহার করা দরকার।
বিএনপির বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশের সর্ববৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতক দল বিএনপি। এ দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য দেশ-বিদেশে চক্রান্ত রয়েছে। যারা রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট এবং জাতীয় নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত ও অনিশ্চিত করতে চান এবং প্রকারান্তরে ফ্যাসিবাদ উত্থানের পথ সৃষ্টি করতে চান, তারাই বিএনপি বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, গুটিকয়েক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারীর অপচেষ্টায় বাংলাদেশ ব্যর্থ হতে পারে না। তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করার যেকোনো ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার এবং প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সব গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের অঙ্গীকার করেন। পাশাপশি যারা বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য জনগণের মধ্য উপস্থাপন করছে তাদের চিহ্নিত করা ও প্রতিহত করার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন তিনি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরও বলেন, পতিত স্বৈরাচার আর কাপুরুষ ষড়যন্ত্রকারীদের মিলিত অপচেষ্টা সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং আগামীর বাংলাদেশ গড়ার পথে যদি কোনো বাধা হয়ে আসে তবে সেটা ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক শক্তির মাধ্যমে প্রতিহত করা হবে।
দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবনতির ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে দায়িত্বশীল সব রাজনৈতিক দল সচেতন হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বাধাগ্রস্ত হলে তার দায় সংশ্লিষ্টদেরই বহন করতে হবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ৭১ ও ২৪-এর অশুভ শক্তি ঐক্য হয়ে গণতন্ত্রবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।
তিনি বলেন, একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি আমরা অতিক্রম করছি। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বাংলাদেশ চায়নি এবং গণহত্যা চালিয়েছিল, এছাড়াও ২৪ এ আওয়ামী লীগ যে গণহত্যা চালিয়েছিল, এই দুই গণহত্যাকারী কোথায় যেন একটু মিল হওয়ার চেষ্টা করছে। বাতাসে ছড়াচ্ছে যে, নানাভাবে তারা এক হচ্ছে। এক হওয়া মানে- গণহত্যাকারীরা হলো অশুভ শক্তি। এই অশুভ শক্তির একজন প্রকাশ্যে আছে, আরেকজন অপ্রকাশ্যে আছে। ইলেকশন হলে বিএনপি ভালো করবে, এটা যেন তারা মানতে পারছে না।
তিনি বলেন, কিভাবে নির্বাচন ঠেকানো যায়, সে জন্য নতুন নতুন বয়ান সামনে নিয়ে আসছে। যে বয়ানের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু, স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে ঠেকানো ও বাধাগ্রস্ত করা যায়, সেদিকে তারা হাঁটছে।
ছাত্রদলের সাবেক এই সভাপতি বলেন, নির্বাচন যাতে না হয় এর জন্য বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। আমি অশুভ শক্তিকে বলবো আপনাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি জনগণের কাছে নিয়ে যান। পিআরসহ আরও কিছু থাকলে জনগণের কাছে নিয়ে যান। আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু, নির্বাচন বন্ধ করা যাবে না। নির্বাচন বন্ধ করলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে আধিপত্যবাদী শক্তি আসবে। এই আধিপত্যবাদী শক্তি বাংলাদেশে ভালো কিছু চায় না।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, জাতীয়তাবাদী শক্তিকে আধিপত্যবাদী শক্তি কখনও পছন্দ করে না। তারা জানে, জাতীয়তাবাদী শক্তি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে ছাড় দেবে না। গণতন্ত্রের প্রশ্ন ছাড় দেবে না, জনগণের অধিকারের প্রশ্নে ছাড় দিবে না। এ কারণেই আজকে একটার পর একটা সংঘাতমূলক ও সহিংস ঘটনা, রক্তপাতের ঘটনা তৈরি করা হচ্ছে।
আধিপত্যবাদী শক্তি এবং তার দালালরা গভীর চক্রান্ত করছে জানিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, তাদের পাতানো ষড়যন্ত্রের জালে আমাদের নেতাকর্মী বা আমাদের পক্ষের যারা সমর্থক, পেশাজীবী সংগঠন কাউকে পা দেওয়া যাবে না।
কোনো ইসলামী সংগঠন প্রোপাগান্ডা ও বিভিন্ন কন্টেন্ট ক্রিয়েট করে ফেসবুকে ছড়াচ্ছে অভিযোগ করে রিজভী বলেন, বিএনপির নামে শুরু থেকে অপপ্রার চালানো হচ্ছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ