ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫ ০৮:২৬ এএম
এস আলমের সহযোগী ফখরুল এমপি হতে চান!
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন আলোচিত প্রতিষ্ঠান পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম এখন খোলস পাল্টে বিএনপি থেকে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি এলাকায় জামায়াত নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
ফখরুল ইসলাম নোয়াখালী-৫ আসনের এমপি হওয়ারও স্বপ্ন দেখছেন। সম্প্রতি তাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের একজন সাংবাদিক ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় বিএনপি নেতারা বলছেন, তিনি এক সময় জামায়াত করতেন।
এছাড়া তিনি এস আলমের সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তাই, বিএনপি থেকে ফায়দা নিতে পারবেন না। তাকে দলের কমিটিতে পদ দেওয়ায় নানা প্রশ্ন রয়েছে। তবে, এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ফখরুল ইসলাম বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে থেকেই তিনি বিএনপির রাজনীতি করেন। তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।
জানা গেছে, বিগত পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পদ্ম লাইফ ইন্সুরেন্সের চেয়ারম্যান ছিলেন ফখরুল ইসলাম। গ্রাহকের টানা দিতে না পেরে পদ্মা লাইফের সঙ্গে চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলামের নাম বারবার উঠে এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। এলাকায় শিবির কর্মী ও পরবর্তীতে জামায়াত নেতা হিসেবে পরিচিত ফখরুল ইসলাম ইবনে সিনা চাকরি করা থেকে শুরু করে ডেভেলপার ব্যবসাও করেছেন।
পরবর্তীতে তিনি বীমা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর একপর্যায়ে এস আলমের সুনজরে এসে পদ্মা লাইফের শীর্ষ চেয়ারে বসেন। ফখরুল ২০২১ সালে হঠাৎ করেই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য পদ বাগিয়ে নিয়ে আলোচনায় আসেন।
সম্প্রতি তাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কর্মরত সাংবাদিক জুলকার নাইন সায়ের ফেসবুক একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার লুটপাটের অন্যতম দোসর দেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ লুটেরা চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মালিক পলাতক সাইফুল আলম মাসুদের বহু অপকর্মের সহযোগী সাবেক জামায়াত নেতা ফখরুল ইসলাম এবার খোলস পাল্টে বিএনপি সংসদ সদস্য হতে চান।
এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ছিলেন এই ফখরুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান থাকাকালীন দেশ বিদেশে এস আলম গ্রুপের নানা আর্থিক অনিয়মের সহযোগী ছিলেন এই ফখরুল। আশির দশকের শুরুর দিকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে চাকরির উদ্দেশ্য ঢাকায় পাড়ি জমান এই বহুরুপী। ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ফখরুল, ইবনে সিনা ক্লিনিকের রিসিপশনিস্ট হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এক সময় তিনি জামায়াত ইসলামীর রোকনও নির্বাচিত হন বলে কথিত আছে। তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় একটি স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে। সেসময় তার নিয়মিত মধ্যপ্রাচ্য যাতায়াত ছিল। সমসাময়িক সময়ে ঢাকায় জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
নব্বইয়ের দশকে ইবনে সিনা হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মোকাদ্দেস আলী এবং মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকের সঙ্গে ফখরুল ডেভলপার ব্যবসা শুরু করেন। ডা. মোকাদ্দেস একজন নিতান্তই ভদ্রলোক এবং সমভ্রান্ত পরিবারের সদস্য ছিলেন। ডা. মোকাদ্দেসের পরিবারিক বেশ কিছু সম্পত্তি ছিল ধানমন্ডি এলাকায়, সেখান থেকেই মূলত তাদের আবাসন ব্যবসা শুরু হয়। ডা. মোকাদ্দেস এই ফখরুল ইসলামের উপর ভরসা করেন এবং এর সুযোগে ফখরুল নানাবিধ অনিয়ম করে ব্যবসাকে প্রচুর ক্ষতির মুখে ফেলেও গোপনে নিজের পকেট ভারী করেন। একপর্যায়ে যৌথ ব্যবসাটি বন্ধ হয়ে গেলে, ফখরুল মেট্রো হোমস নামে নিজের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করে। মূলত জামায়াত এবং শিবিরে নিজ পরিচিতি কাজে লাগিয়ে তাদের মাধ্যমেই ফ্ল্যাট কেনাবেচা শুরু করেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, এই আবাসন ব্যবসায় অনেককেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন ফখরুল, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রাহকদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট এর বুকিং অর্থ নিয়ে দীর্ঘ দিন ফ্লাট না বুঝিয়ে দিয়ে হয়রানি করেছেন। তার ভুক্তভোগীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মধ্যপ্রাচ্য বেসবাসকারি জামাতপন্থী প্রবাসীরা।
২০২১ সালে ফখরুল প্রথম কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির মাধ্যমে দলটির রাজনীতিতে সরাসরি প্রবেশ করেন। ২০২১ সালে বিতর্কিত একটি কমিটির মাধ্যমে ফখরুল কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির একজন সদস্য হিসেবেও মনোনীত হয়। বর্তমানে ফখরুল নোয়াখালী জেলা বিএনপির নেতা হওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তার লক্ষ্য বিএনপির ব্যানারে থেকে জাতীয় সাংসদ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়া।
২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপি এবং জামায়াতের জোট সরকারের সময় জামায়াত ঘরানার আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানির একজন ফাউন্ডার ডাইরেক্টর এবং জামায়াতের এক শীর্ষ নেতার মাধ্যমে ফখরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। সেসময় জামায়াত এবং শিবিরের পরিচিতি ব্যবহার করে ফারইস্ট খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ফারইস্টে চেয়ারম্যান থাকাকালীন ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে এই ব্যক্তি লুটপাটের এক সাম্রাজ্য কায়েম করে, তার ঘনিষ্ঠজনদের প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে ফখরুল এ সকল অপকর্ম করেন। ফারইস্টের মালিকপক্ষের কাছে বিষয়গুলো খোলাসা হয়ে গেলে বোর্ড অফ ডাইরেক্টরস তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করে।
ফখরুল ইসলাম ২০০৯ সালে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী হিসাবে উপজেলা নির্বাচন করেন এবং পরাজিত হন। উল্লেখ্য উপজেলা নির্বাচনের আগে তাকে বিএনপি তে যোগদানের জন্য আহ্বান করা হয়, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। একপর্যায়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির নেতা ব্যরিস্টার মওদুদ আহমেদ (মরহুম) এর সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যান ফখরুল।
২০২২ সালে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর ও দেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ লুটেরা চট্টগ্রাম ভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম মাসুদের (বর্তমানে পলাতক) সঙ্গে আঁতাত করে ফখরুল ইসলাম। সেই সূত্রে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন পদ্মা লাইফ ইনসুরেন্সের চেয়ারম্যান পদে তাকে বসানো হয়। ফখরুল তার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মাসুদের লুটের অবৈধ অর্থ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচারে সহযোগিতা করেন।
ফখরুলের নিকটজনদের কাছ থেকে জানা যায়, এস আলমের লোপাট করা অর্থের একটি বড় অংশ তুরস্কের আবাসন খাতে বিনিয়োগ করা হয় আওয়ামী সরকার পতনের আগেই এবং ফখরুলকে ওই আবাসন প্রকল্পের দায়িত্ব দেন সাইফুল ইসলাম মাসুদ। ২০২১ সালে ফখরুল প্রথম কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির মাধ্যমে দলটির রাজনীতিতে সরাসরি প্রবেশ করেন।
২০২১ সালে বিতর্কিত একটি কমিটির মাধ্যমে ফখরুল কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির একজন সদস্য হিসেবেও মনোনীত হন। বর্তমানে ফখরুল নোয়াখালী জেলা বিএনপির নেতা হওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তার লক্ষ্য বিএনপির ব্যানারে থেকে জাতীয় সাংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া। বিএনপি কি বহুরুপী ফখরুলের সাংসদ নির্বাচনের খোয়াব পূরণ করবে? এই ফেসবুক পোস্টে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের সঙ্গে ফখরুল ইসলামের বৈঠকের ছবিও যুক্ত করা হয়। তার এ ফেসবুক পোস্টের পর এখন নোয়াখালী-৫ (কোম্পাানীগঞ্জ-কবিরহাট) এলাকায় নানা প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। পতিত সরকারের আমলে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা এস আলমের সহযোগী গিসেবে পরিচিত ফখরুল ইসলামের বিএনপি থেকে সাংসদ নির্বাচনের স্বপ্ন নিয়ে অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করছেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিএনপির সদ্য বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি নুরুল আলম শিকদার দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ফখরুল ইসলাম এলাকায় এস আলমের সহযোগী হিসেবে পরিচিত। দলে তার কোনো ত্যাগ আছে বলে আমার জানা নেই।
ছাত্রদল থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসা নুরুল আলম শিকদার বলেন, হঠাৎ করে ২০২১ সালের উপজেলা কমিটিতে সদস্য হিসেবে তার নাম দেখতে পাই। তিনি কীভাবে পদ পেলেন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, এলাকায় ফখরুলের তেমন কোনো লোকজন নেই। এছাড়া তাকে কেউ ভালোভাবে নেয়নি। তিনি যে এস আলমের সহযোগী এটি তো পরিষ্কার। এছাড়াও তিনি জামায়াতের লোক হিসেবেও আগে পরিচিত ছিল। নুরুল আলম শিকদার ছাড়াও পদধারী বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতারা ফখরুলের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন।
এদিকে, ফখরুল ইসলাম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। এস আলমের সঙ্গে কোনোদিনও ব্যবসা ছিল না। জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না।
তিনি বলেন, আমি উপজেলা বিএনপির সদস্য (সদ্য বিলুপ্ত)। আমি রাজনীতি করি, এলাকায় যাই। ভোট করতে চাইবো এটাও স্বাভাবিক।
ভোরের আকাশ/এসএইচ