মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫ ১২:৪১ এএম
ছবি: সংগৃহীত
রাজনীতির জটিল সমীকরণ আর গভীর এক আশঙ্কার ঘূর্ণাবর্তে রয়েছে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। জন আবেগের মূল্যায়নের পাশাপাশি বৈশ্বিক বাস্তবতার সূক্ষ্ম হিসেবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দূরদর্শি নেতৃত্বের দায় এখন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ঘাড়ে।
দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সেই বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জে থাকা দলটির সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের সমঝোতার চাপ। দীর্ঘ রাজনৈতিক মিত্রদের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ের হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা কোনো কোনো গ্রুপের দাবি দাওয়া বিষয়ে নতুন করে ভাবাচ্ছে দলটিকে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার এলোমেলো করে রেখে যাওয়া দেশের হাল ধরতে যাওয়া দল হিসেবে বিএনপিকে জন আকাঙ্ক্ষা ও প্রশাসনিক সম্বয়ের দায়ের বিষয়টিও মাথায় নিতে হচ্ছে।
এ সময়ে রাজনৈতিক এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে দলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থকে নানা ফর্মুলায় সামনে আনতে মরিয়া অনেকেই। যা মূলত আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আসন ভাগাভাগির ভেতরের বাস্তবাতকে সামনে আনছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই। এই বাস্তবতাতেই আসন সমঝোতার কৌশল হিসেবে পিআর পদ্ধতিতে ভোট চাই বলে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত রাখছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
যদিও এনসিপি কেন্দ্রীয় নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ দুদিন আগে বলেছেন, তারা আসন সমঝোতায় যাচ্ছে না। কিন্তু এ বক্তব্যকে রাজনৈতিক হিসেবেই দেখছেন অভিজ্ঞমহল। বিভিন্ন জরিপ ও মাঠের চিত্র বিশ্লেষণ করে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির ভোটের মাঠের সক্ষমতা সবার জানা। তারা কোনোভাবেই এককভাবে বা জোটগতভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো অবস্থানে নেই।
রাজনৈতিক বা ক্ষমতার আর্শীবাদই কেবল তাদের ফ্যাক্টর করে রেখেছে। যা কাজে লাগিয়ে আগামী সংসদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন নিশ্চিত করতে চায় দলটি। এখানে তারা বিএনপির কাছ থেকে বড় দাগের একটি আসন নানা চ্যানেলে দাবি করে আসছে বলে নানা সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক চ্যানেলে বেশকিছুটা সুবিধা পাচ্ছে জামায়াত। তাই ভোটের মাঠের হিসেবের বাইরে জামায়াতকে গুরুত্ব দেওয়ার একটা তাগিদ বিএনপির ওপর রয়ে গেছে।
একইভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের মসনদ উড়িয়ে দিয়ে জাতির আস্থায় আসা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের গড়া রাজনৈতিক দল এনসিপিও কূটনৈতিক চ্যানেলের বিশেষ আশির্বাদের মধ্যে রয়েছে। ছোট বাউন্ডারির হিসেবের বাইরে তাদের ঘিরে একটি বিশ্ব বলয় রয়েছে। সুপার ইকুয়েশনের সে হিসেবটিও মাথায় রেখে ছোট্ট এই দলটির সঙ্গে কৌশলী আচরণ করার দায় রয়েছে বিএনপির ঘাড়ে। সব মিলে একটি দৃশ্য এবং অদৃশ্য চাপে রয়েছে বিএনপি।
এসব বাস্তবতাকে সামনে রেখেই মাঠ গোচাচ্ছে বিএনপি। ভোটের মাঠের হিসেবে নিজেদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রমাণে এবং মাঠের রাজনৈতিক কৌশল মোকাবিলায় জামায়াতে ইসলামীকে পাশ কাটিয়ে হেফাজতে ইসলামসহ ছোট কিছু ইসলামী দলকে কাছে টানার চেষ্টা করছে দলটি। সেই সঙ্গে এনসিপি নেতাকর্মীদের অনেকেই মব ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার নেগেটিভ ইস্যুটিকে সামনে না এনেও তার সুফল নিতে ছাত্রদলকে পজেটিভ রাজনীতির নির্দেশ দিয়েছে দলটি।
গত আড়াই মাসে এনসিপির অন্তত ২৬ নেতা পদত্যাগ করেছেন। চাঁদাবাজি, দখলবাজ, তদবিরবাজ ও ক্ষমতা প্রদর্শনসহ নানা বির্তকে জড়িয়ে পড়েছে দলটি। সাম্প্রতিক সময়ের বক্তব্য বিবৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। অবাধ, সুষ্ঠু ও দেশ-বিদেশেসহ সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ভোট অনুষ্ঠানে আইন, স্বরাষ্ট্র ও অর্থসহ নিবার্চন সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আইন শৃঙ্খলার পাশাপাশি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ইসি।
একইসঙ্গে ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। সরকার ও ইসির ঘোষণা মতে, ফেব্রুয়ারিতেই ভোট মাথায় নিয়ে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। ইতোমধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচনী মাঠে থাকা ৪২ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। আরও ২২ দলের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য থাকে দু’ধরনের বিষয় সামনে আনা যাবে, এক হচ্ছে বাইরের চাওয়া ও দুই হচ্ছে আভ্যন্তরীণ। নির্বাচন ঘিরে জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের বক্তব্যকে রাজনীতির মাঠের বহিরাবরণ বক্তব্য। দলগুলোর তাদের স্ব স্ব অবস্থানের পক্ষে চাপ তৈরির বা দাবি আদায়ের চেষ্টা। কিন্তু সব দলই ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে ভোটসহ বিভিন্ন শর্ত বা দাবির ব্যাপারে যুক্তি দিয়ে ভোট থেকে বিরত থাকার হুমকি দেন জামায়াত ও এনসিপি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, জামায়াতের অবস্থান বোঝা খুব কঠিন। তবে ‘জামায়াত ও এনসিপি’ দল দুটোর এমন অবস্থান বিএনপির ওপর চাপ তৈরির কৌশল হতে পারে। সেখানে নির্বাচনে আসনের ব্যাপারে দরকষাকষির বিষয়ও থাকতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, যারা নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলছে সেটি তাদের কৌশল। মূলত আসন সমঝোতা বা দেন-দরবারের জন্যই তারা এগুলো বলছে। আসলে সবাই নির্বাচনমুখী।
তিনি আরও বলেন, কোনো কোনো দল পিআর পদ্ধতি নিয়ে ও অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হলে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলছে। আমার মনে হয় এগুলো তাদের কৌশল। শেষ পর্যন্ত এসব দল নির্বাচনে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, যারা বলছে নির্বাচনে যাবে না বা নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না, এটা তাদের এক ধরনের রাজনৈতিক চাপ। ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য তাদের মধ্যে আগে থেকেই আছে। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই, এটা তারাও বোঝে। ভোটই গণতন্ত্রের প্রথম সোপান।
এনসিপি বলেন, আর জামায়াত বলেন, দেশের কথা চিন্তা করে তারা নির্বাচনে যাবে। বিএনপিকে বড় দল হিসেবে প্রয়োজনে আরো ছাড় দিতে হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও কেন্দ্রীয় মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ইসলামী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
বিএনপির সঙ্গে আলোচনা বা জোট গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি আরো বলেন, দেশের স্বার্থে আমরা যেকোনো বিষয়ে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। রাজনীতিতে অনেক কিছুই সম্ভব।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে শরিক সব দলের সঙ্গে সম্মানজনক সমঝোতায় যেতে পারে। হতে পারে বড় জোট। আমাদের দল ও আরো কয়েকটি দলকে নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে একসঙ্গে ভোট করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা যে হয়নি তা নয়। তবে আমরা এখন দল গোছাচ্ছি।
আসন সমঝোতার বিষয়টি এখন প্রধান বিবেচ্য কি না জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই আমরা এগোতে চাই।
জামায়াতে ইসলামী নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, একটি দল বাদে কেউ শর্তহীনভাবে জুলাই ঘোষণাকে গ্রহণ করেনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কার জরুরি।
ভোরের আকাশ/এসএইচ